শ্রয়ণ সেন
“মৃত্যুর আগে পর্যন্তও আমার দাদু নেতাজির কথা বলতেন। আমরা তাঁকে তাঁর যোগ্য সম্মানটা দিতে পারিনি, এই বলে বার বার আপশোশ করতেন তিনি।”
ষাটোর্ধ্ব ইন্দরবীর সিংহ যখন এই কথাগুলি বলছিলেন, নিজের মধ্যে কী রকম অনুভূতি হচ্ছিল ঠিক বলে বোঝাতে পারব না। হিমাচলের ডালহৌসি যে নেতাজি স্মৃতিধন্য, সে তো জানতাম, কিন্তু স্বয়ং নেতাজির এক সঙ্গীর নাতির সঙ্গে এ ভাবে কথা বলব ভাবতেই পারিনি।
ভাগ্য অতি প্রসন্ন না হলে এই অসাধারণ মুহূর্তটা আসতও না অবশ্য।
ডালহৌসির দু’টি মূল কেন্দ্র, সুভাষ চক এবং গান্ধী চক। এই দু’টি চকের মাঝামাঝি একটি জায়গায় হিমাচল পর্যটনের গীতাঞ্জলি হোটেলে আমাদের ঠাঁই। দুপুরের মধ্যাহ্নভোজনের পর কিছু কেনাকাটার উদ্দেশ্যেই চলে এসেছিলাম গান্ধী চক।
![exchange with Inderbeer](https://www.bhramononline.com/wp-content/uploads/2020/01/netaji-dalhhousie-1-2301.jpg)
গান্ধী চকের একটা কোণায় রয়েছে মূল মার্কেট। রয়েছে হরেক রকমের দোকানপাট, তবে বেশিটাই শীতবস্ত্রের। এমনই অনেক দোকান ঘুরে দেখার পরে নভেল্টি স্টোর্সে ঢুকে পড়লাম। দোকানে বসে রয়েছেন বছর তিরিশের এক তরুণ।
কেনাকাটি করার ফাঁকেই দোকানে চলে এলেন এক শিখ প্রৌঢ়। সম্বোধনে বুঝলাম ওই তরুণের বাবা। কেনাকাটির মধ্যেই চোখ গেল একটি ছবিতে। দোকানের দেওয়ালে ছবিটি এমন ভাবে লাগানো, যাতে সবার চোখ পড়বেই।
বুঝতে কোনো অসুবিধা হল না যে ছবিতে মধ্যমণি রয়েছেন নেতাজি। তাঁকে ঘিরে রয়েছেন একাধিক মানুষ। ছবিটির ওপরে উর্দুতে অনেক কিছুই লেখা। শুধু তারিখটি ছাড়া কিছুই বুঝতে পারলাম না। ১৯৩৭ সালের ৫ মে তোলা হয়েছিল ছবিটি।
![the picture which drew our attention](https://www.bhramononline.com/wp-content/uploads/2020/01/netaji-dalhousie-2-23.01.jpg)
এই ছবির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই তাঁর পরিবারের সঙ্গে জড়িত গর্বের এক ইতিহাসের কথা বললেন দোকানের মালিক এই প্রৌঢ় ইন্দরবীর সিংহ। ১৯৩৭ সালে এই ডালহৌসিতেই এসেছিলেন নেতাজি। তখন তাঁর সব সময়ের সঙ্গী হয়েছিলেন ইন্দরবীরের দাদু গোপাল সিংহ।
লাহোরে ইন্দরবীরদের আদি বাড়ি হলেও, দেশভাগের আগেই ভারতে চলে আসেন তাঁরা। পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করেন ডালহৌসিতে। এই নভেল্টি স্টোর্সও তাঁর তৈরি করা। তবে নেতাজি যখন এসেছিলেন তখন এই দোকান ছিল সুভাষ চকে। পরে অবশ্য গান্ধী চকে চলে আসেন তাঁরা।
নেতাজিকে নিয়ে কিছুক্ষণ জমে উঠল আমাদের কথোপকথন। কিন্তু তখনও জানি না, কিছুক্ষণের মধ্যে আরও একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকব।
এক সুখস্মৃতি সঙ্গে নিয়ে বিদায় জানালাম ইন্দরবীর এবং তাঁর ছেলে তরুণপ্রীতকে।
![subhash bowli](https://www.bhramononline.com/wp-content/uploads/2020/01/netaji-dalhousie-3-2301.jpg)
গান্ধী চক থেকে সুভাষ চকের রাস্তাটি মল রোড হিসেবে পরিচিত। স্থানীয়রা এই রাস্তাকে আবার ‘ঠান্ডী সড়ক’ বলে। বোধহয় এই রাস্তায় রোদের দেখা বেশি মেলে না তাই তার এ রকম নাম।
এই রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতেই চোখে পড়ল মেহর হোটেল। এই হোটেলে নেতাজি থাকতেন, এটা কিছু দিন আগেই জেনেছি। নেতাজি যে ঘরে থাকতেন সেটা দেখা যাবে, এই আশাতেই কিছু চিন্তা না করেই ঢুকে পড়লাম হোটেলের ভেতর। ম্যানেজারকে নেতাজির ঘর দেখানোর আবদার করতেই তা মিটে গেল। যে ঘরে নেতাজি থাকতেন, সেই ঘরে তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন। ঘরটা দেখতে দেখতে শরীর লোম প্রায় খাড়া হয়ে যায়! একটা দারুণ অভিজ্ঞতা তো ছিলই, কিন্তু আরও ভালো লাগা একটা জিনিস ঘটল একটু পরেই।
হোটেলে না থাকা সত্ত্বেও তিনি কেন অবলীলায় আমাদের নেতাজির ঘর দেখিয়ে দিলেন? এই প্রশ্ন করাতে উত্তর এল, “নেতাজি বলে কথা! তাঁর ঘর যদি বাইরের কেউ দেখতে চান, সেটা তো আমাদের কাছে গর্বের ব্যাপার।” বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে আরও একটা কথা বললেন তিনি, “ডালহৌসিতে আপনার পরিচিত যিনিই আসবেন, তাঁকে একবার আমাদের হোটেলে ঘুরে যেতে বলবেন।”
কিন্তু এই দু’টি সুখের স্মৃতির পর হঠাৎ করে তাল কেটে গেল সুভাষ বাউলি দেখে। ডালহৌসির প্রধান তিনটে দ্রষ্টব্য স্থানের অন্যতম এই সুভাষ বাউলি। এটি আসলে একটা প্রস্রবণ। ১৯৩৭-এ নেতাজি প্লুরেসিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। হাওয়া পরিবর্তনের জন্য চিকিৎসকরা তাঁকে ডালহৌসিতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কথিত আছে, ডালহৌসিতে থাকার সময়ে প্রতি দিন নেতাজি এখানে আসতেন আর এই প্রস্রবণের জল খেতেন। এর পরেই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন নেতাজি।
![the present condition of water flow](https://www.bhramononline.com/wp-content/uploads/2020/01/netaji-dalhousie-4-2301.jpg)
কিন্তু এ কি অবস্থা সুভাষ বাউলির। সব কিছু ভেঙে চুড়ে গেছে। জায়গাটিকে সংরক্ষণ করার কোনো উদ্যোগই নেই। হিমাচলের প্রতি পাঁচ বছর সরকার পালটে যায়, কিন্তু সুভাষ বাউলির হাল যে বদলায় না, সেটা এই ছবিটা দেখেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।
এ সবের মধ্যে আশার আলো দেখাচ্ছে ভারত বিকাশ পর্ষদ নামক স্থানীয় একটি সংস্থা। তাদের উদ্যোগে তাও এখনও টিকে রয়েছে এই বাউলি। পর্ষদকে আন্তরিক অভিনন্দন এবং ভবিষ্যতে কোনো সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হবে এই আশায় ডালহৌসি থেকে বিদায় নিলাম।
২৪ ঘণ্টাও থাকলাম না ডালহৌসিতে। কিন্তু একটা জিনিস ভালো করে বুঝে গেলাম। সুভাষের সুবাসে এখনও মম করছে এ শহরের বাতাস।