ওয়ানাড় থেকে মালাবার ২/ বাঙালির মা দুর্গাকে পেয়ে গেলাম কোড়িকোড়ে

শ্রয়ণ সেন

গাড়িটা জোরে ব্রেক কষে লক্কিড়ি ভিউ পয়েন্টে দাঁড়াতেই আমার সংবিৎ ফিরল। তিন বছর আগে এই লক্কিড়ি ভিউ পয়েন্ট দেখেই তো ফিরে গিয়েছিলাম সে বার। কোড়িকোড়ের পথে আর এগোইনি আমরা। সে বারই দর্শন হয়েছিল মুথাঙ্গা, বাথেরি, এড়াক্কাল, পুকোট ইত্যাদি। সে বারই কর্নাটক দর্শনের দীর্ঘ সূচির মধ্যেই কুর্গ থেকে এসেছিলাম ওয়ানাড়। তিন বছর পরে আবার সেই পথে। আর এই পথই আমায় ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল স্মৃতির রাজ্যে।

ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে পড়েছি বেঙ্গালুরু থেকে। মহীশূর হয়ে পৌঁছোলাম গুন্দলুপেট। সেখান থেকে বাঁ দিকে কোড়িকোড়ের জাতীয় সড়ক। শুরু হয়ে গেল বন্দিপুর অভয়ারণ্য। জাতীয় সড়ক চলে গিয়েছে জঙ্গলের পেট চিরে। তাই যে কোনো মুহূর্তে বন্যপ্রাণী দেখতে পাওয়ার আশা। বিশেষ করে হাতি দর্শন তো হতেই পারে।

আরও পড়ুন: ওয়ানাড় থেকে মালাবার ১/ সুলতান বাথেরির পথে মিলল হরিণ, হাতির দেখা

কিলোমিটার খানেক অন্তর অন্তর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সতর্কবার্তা – গাড়ি আসতে চালানোর অনুরোধ। জঙ্গলের মধ্যেই রাজ্য পালটে গেল, কর্নাটক থেকে আমরা কেরলে ঢুকে গেলাম। আর বন্দিপুর নয়, অভয়ারণ্যের নাম মুথাঙ্গা। মনে পড়ে গেল তিন বছর আগের সেই দিনটার কথা। এই গেট দিয়েই আমরা মুথাঙ্গায় প্রবেশ করেছিলাম। তবে আগের বারের মতো এ বার আর হাতি দর্শন হল না।

সুলতান বাথেরি থেকে লক্কিড়ির রাস্তাটা এখন বেশ চওড়া হয়েছে। বাজার-দোকানপাট অনেক বেড়েছে। এই পথ পাহাড়ি বলে এখন আর মালুম হয় না তেমন।

কিছুক্ষণ সময় লক্কিড়িতে স্মৃতি রোমন্থনে কেটে গেল। পাহাড়ের ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে দূরের সমতলভূমি, জঙ্গল-পাহাড়ের মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে জাতীয় সড়ক। বোঝাই যাচ্ছে, পাহাড়ের গা বেয়ে ক্রমশ নীচে নেমে গিয়েছে সে। চেরাপুঞ্জি-মৌসিনরামের পর সব থেকে বেশি বৃষ্টি হয় এখানেই, এই লক্কিড়িতে। এক দিকে খাড়া পাহাড় আর অন্য দিক বাধাহীন। তাই সমুদ্র থেকে উঠে আসা সব জলীয় বাষ্প এখানে পুঞ্জীভূত হয়ে ব্যাপক বৃষ্টি নামায়।

লক্কিড়ি থেকে।

লক্কিড়িতে বেশ কিছু ক্ষণ কাটিয়ে ফের পথ চলা শুরু।

রাস্তা এ বার ক্রমে নামতে শুরু করল। আড়াই হাজার ফুট উচ্চতা থেকে একেবারে সমুদ্রতলে নামছি। বেশ রোমাঞ্চকর রাস্তা। ন’টা হেয়ারপিন বেন্ড। পাহাড় ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে। আবহাওয়ারও আমূল বদল। প্যাচপ্যাচে গুমোট গরম।
কালিকট পৌঁছোনোর পর প্রথমেই চমক। জাতীয় সড়ক থেকে ডানহাতি রেড ক্রস রোডে ঢোকার মুখে ট্র্যাফিক জ্যাম। সামনে কিছু মিছিল চলেছে। বাজনার আওয়াজ আসছে। মনে হচ্ছে যেন বাংলার ঢাকের আওয়াজ।

যা-ই হোক, পুলিশের ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণের সুবিধা নিয়ে মিছিলের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে এক ঝলক নজর গেল মিছিলকারীদের দিকে – বঙ্গললনারা না? সিঁদুর খেলেছেন সবাই। দু’টি ট্রাকে চলেছেন সপরিবার মা দুর্গা। দশভূজা মহিষাসুরমর্দিনী। আজ তো বিজয়াদশমী। কী আশ্চর্য! এই সুদূর কালিকটে।

হোটেলে চেক-ইন করার সঙ্গে সঙ্গেই সেই মিছিলের হট্টগোল কানে এল। না, এই সুযোগ ছাড়তে দেওয়া যায় না। এক ছুট্টে চলে এলাম নীচে।

প্রথম ট্রাকটির সামনে ব্যানার। তাতে ইংরেজিতে লেখা – ‘শারদীয়া দুর্গাপূজা ২০১৫, স্থান জুবিলি হল, টালি, কালিকট। বেঙ্গলি সমিতি, কালিকট। ১৮ অক্টোবর থেকে ২৩ অক্টোবর’। আজ দশমী, তাই বোঝাই যাচ্ছে মা চলেছেন কৈলাসে। কিন্তু বাংলা থেকে এত দূরে এই কোড়িকোড়ে এত বাঙালি কী করে!

বেঙ্গলি সমিতির দুর্গা বিসর্জন।

আমাদের কৌতূহল মেটালেন প্রসেনজিৎ রায়, উপকূলরক্ষী বাহিনীর কর্মী। তাঁর কর্মস্থল বন্দরশহর কোচি। পুজোর ছুটিতে চলে এসেছেন এই কালিকটে, এখানকার বেঙ্গলি সমিতির পুজোয় শামিল হতে। প্রসেনজিৎ জানালেন, কালিকটের বাঙালিরা গত চার বছর ধরে এখানে দুর্গাপুজো করছেন। এখানে বেশ কয়েক হাজার বাঙালি থাকেন, যাঁরা অলংকারশিল্প এবং নির্মাণশিল্পের বিভিন্ন কাজে জড়িত।

কালিকট শহরের এক বর্ধিষ্ণু এলাকা টালি। সেখানকার জুবিলি হলে পঞ্চমী থেকে দশমী, এই ছ’দিন ধরে পুজো চলে। শহরের বাঙালি সমাজ সেখানে একত্রিত হয়। পুজোর পাশাপাশি চলে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আর তার সঙ্গে খাওয়াদাওয়া।

মিছিল দেখতে জড়ো হয়েছেন আশপাশ থেকে আসা স্থানীয় বাসিন্দারা। অনেকেই নিজস্ব ক্যামেরায় তুলে রাখছেন এই মুহূর্ত। দেবী দুর্গাকে বিদায় জানিয়ে ঘরে ফিরলাম ৩৭০ কিমি দীর্ঘ যাত্রার ধকল থেকে একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য। তবে বেশি ক্ষণ ঘরে থাকতে পারলাম না। হাতে সময় খুব অল্প। এখান থেকে ১০ কিমি দূরের বেপোর সৈকতটা এখনই দেখতে হবে যে। (চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *