ওয়েনাড় থেকে মালাবার/শেষ পর্ব: বেকাল থেকে অসাধারণ সূর্যাস্তের সাক্ষী থাকলাম

শ্রয়ণ সেন

বিকেল সাড়ে চারটে। পৌঁছে গেলাম বেকাল দুর্গ। কোড়িকোড় থেকে ১৭০ কিমি পথ পাড়ি দিতে সময় লাগল পাক্কা ছ’ ঘণ্টা। আসলে জাতীয় সড়ক হলেও কেরলে রাস্তা খুব সংকীর্ণ, তাই গাড়ির গতি ছিল বেশ শ্লথ। দুর্গের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকেই শ্রীমুখ্যপ্রাণা মন্দির। বিগ্রহ হনুমান। এর পর টিকিট কাউন্টার। জনপ্রতি পাঁচ টাকা আর ক্যামেরার জন্য ২৫ টাকার টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম দুর্গে। বিকেলের বেকালের সৌন্দর্যে আমরা মোহিত। তর্কাতীত ভাবে দেশের সেরা দুর্গগুলির মধ্যে অবলীলায় জায়গা করে নেবে এই বেকাল।

আরও পড়ুন: ওয়েনাড় থেকে মালাবার/১: পথের ধারেই হাতি-হরিণের সঙ্গে সাক্ষাৎ

১৬৫০ সালে শিবাপ্পা নায়ক আরব সাগরের ধারে তৈরি করেন এই দুর্গ। পর্তুগাল আর বাকি ইউরোপীয় দেশের সঙ্গে সামুদ্রিক বাণিজ্যে মুখ্য ভূমিকা পালন করত বেকাল। তার এই ‘স্ট্র্যাটেজিক লোকেশন’-এর জন্যই অষ্টাদশ শতকে হায়দার আলি আর ব্রিটিশদের মধ্যে অনেক যুদ্ধের সাক্ষী থেকেছে এই দুর্গ। টিপু সুলতানের সময় এই বেকাল ছিল তুলুনাড়ু আর মালাবারের প্রশাসনিক রাজধানী। ১৭৯৯ সালে টিপুর হাত থেকে ব্রিটিশদের ক্ষমতায় চলে আসে বেকাল।

বেকাল ফোর্ট থেকে।

বিশাল জায়গা নিয়ে তৈরি এই দুর্গ। রয়েছে ১২ মিটার উঁচু পাঁচিল। দুর্গের উত্তর দিক ঘেরা রয়েছে জলপূর্ণ পরিখায়। ১৯৯৭ থেকে ২০০১, এই চার বছর ধরে খননকাজ হয়েছে এখানে। মন্দির, আবাসিক স্থান, দরবার হল, টিপুর সময়ের টাঁকশাল এবং আরও অনেক কিছুই খননের পর পাওয়া যায়। উঠলাম অবজারভেশন টাওয়ারে। এখান থেকে দুর্গের তিন দিকেই সাগর দৃশ্যমান। কিছুটা সময় টাওয়ারে কাটিয়ে এ বার আউটার ওয়াল বরাবর হাঁটা। পাঁচিলের দিকে যাওয়ার পথে দেখে নিলাম ধাপওয়ালা জলাধার (স্টেপ্‌ড ট্যাঙ্ক)। একটি টানেল দেখতে পেলাম। তার দরজা বন্ধ। এই টানেল দিয়ে নাকি চলে যাওয়া যায় সাগরের ধারে। এখানে অস্ত্রভাণ্ডারও ছিল।

দুর্গের পাঁচিলের ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নজরে পড়ল পাঁচিলের গায়ে একটা গলতা। সেটা দিয়ে গলে একেবারে সমুদ্রের ধারে চলে যাওয়া যায়। অগুনতি পর্যটকের মতো আমরাও সেই পথ ধরলাম। পাহাড়ি পথের মতো করে ঘুরতে ঘুরতে নেমে গেলাম সমুদ্রের ধারে। এটাও দুর্গেরই অংশ। এখান থেকেই উপভোগ করলাম অসাধারণ সূর্যাস্ত। এ বার ফেরার পালা।

সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গেই এলাম কাসারগড়। বেকাল থেকে কাসারগড়, মাত্র বারো কিমি পেরোতে আমাদের সময় লাগল প্রায় এক ঘণ্টা। সৌজন্য, দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা। সন্ধের অন্ধকারে এই শহরটা সম্পর্কে কোনোও ধারণাই করতে পারলাম না।

কাসারগড়ের এক টুকরো।

সকাল হল কাসারগড়ে। ছোটো কিন্তু সাজানোগোছানো শহর। কাছেই বাসস্ট্যান্ড। আমাদের হোটেলটা শহরের একদম শেষ প্রান্তে। চারি দিকে একটা অদ্ভুত বৈচিত্র্য। নারকেল গাছের সারি, তার পরেই পশ্চিমঘাটের শ্রেণি। দেখে বোঝার উপায় নেই যে হোটেল থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার গেলেই দেখা মিলবে সমুদ্রের। তবে আমাদের হাতে সময় খুব অল্প। কোনো ভাবেই কাসারগড়ের সৈকত দেখা হবে না। কেরল ছেড়ে কর্নাটকে ঢোকার আগে একটা মন্দির দেখতেই হবে। এই অঞ্চলের খুব বিখ্যাত।

কাসারগড় থেকে ৮ কিমি দূরে মধুবাহিনী নদীর ধারে অবস্থিত শ্রী মদনেশ্বর মন্দির তার স্থাপত্যেই মাতিয়ে দিয়েছে। মাধুর মন্দির নামে পরিচিত এই মন্দির দক্ষিণ ভারতের আর পাঁচটা মন্দিরের থেকে একেবারেই আলাদা। প্রবেশাধিকারে কোনো পুরুষ-মহিলা বাছবিচার নেই, পোশাকবিধিও নেই। আদতে শিবমন্দির হলেও এখন গর্ভগৃহে সিদ্ধিদাতা গণেশের বাস। এক পুরোহিতের ছেলে খেলার ছলে গণেশের মূর্তিটি তৈরি করেন।

আরও পড়ুন: ওয়েনাড় থেকে মালাবার/২: কোড়িকোড় পৌঁছোতেই চমক, চলেছেন দশভুজা মা দুর্গা

হাতির পিঠের আদলে তৈরি এই তিনতলা মন্দির কেরলের মন্দির-স্থাপত্যের এক চমৎকার নিদর্শন। কথিত আছে, টিপু সুলতান মালাবার-কুর্গ আক্রমণের সময়ে এই মন্দির ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখানকার কুয়োর জল পান করার পর তাঁর মত বদল করেন। তবে তাঁর সৈন্যদের তুষ্ট করার জন্য টিপু আক্রমণের চিহ্ন হিসেবে তাঁর তলোয়ার দিয়ে মন্দিরের গায়ে একটি দাগ করে যান। এই দাগ এখনও দেখা যায়।

বেশ কিছুটা সময়ে কাটিয়ে আবার যাত্রা শুরু। গত দু’ দিন ধরে না-জানা কেরলের আরও কিছুটা অংশ দেখে এগিয়ে চললাম কর্নাটকের উদ্দেশে। (শেষ)

মাধুর মন্দির।

কী ভাবে যাবেন

কলকাতা থেকে দু’ রকম ভাবে যাওয়া যেতে পারে। এক, বেঙ্গালুরু পৌঁছে সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে প্রথম রাত্রিবাস সুলথান বাথেরিতেই করা ভালো। দূরত্ব ২৫৮ কিমি। এখান থেকে কোড়িকোড় ৭০ কিমি। দুই, সাঁতরাগাছি থেকে সাপ্তাহিক বিবেক এক্সপ্রেস। প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টে ৫০ মিনিটে ছেড়ে কোড়িকোড় পৌঁছোয় শনিবার ভোর ৪টে ৫৫ মিনিটে, কান্নুর পৌঁছোয় সকাল ৬টা ৩৫ মিনিটে আর কাসারগড় পৌঁছোয় সকাল ৮টা বেজে ৪মিনিটে।

কোথায় থাকবেন

সুলথান বাথেরি, কোড়িকোড়, কান্নুর আর কাসারগড়ে রয়েছে প্রচুর হোটেল। তবে কোড়িকোড় আর কান্নুরে কেরল পর্যটনের হোটেল দু’টিই সমুদ্র থেকে অনেক ভেতরে। সুলথান বাথেরিতে কেরল পর্যটনের হোটেলে থাকতে পারেন। থাকা-খাওয়া ভালো। অনলাইনে হোটেল বুকিং করতে পারে। কেরল পর্যটনের সঙ্গে যোগাযোগ www.ktdc.com

মনে রাখুন

এই ভ্রমণ কয়েক বছর আগের। সুতরাং বিভিন্ন জায়গায় দর্শনী, ক্যামেরার চার্জ, মুথাঙ্গায় জিপের ভাড়া বাড়তেই পারে।

ছবি: লেখক

আরও পড়ুন: ওয়েনাড় থেকে মালাবার/৩: ১৪৯৮-এর স্মৃতি নিয়ে কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে কাপ্পাড় সৈকত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *