শ্রয়ণ সেন
ভাস্কো ডা গামার কালিকট কোঝিকোড় নামেই বেশি পরিচিত। তবে স্থানীয় উচ্চারণে এই শহর কোড়িকোড়। প্রাচীন শহর, এখনও সে ভাবে অতি আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। রাস্তাঘাট সে রকম চওড়া নয়। বাড়ি, ঘরদোরে কেরলের প্রাচীন ঐতিহ্যের পরশ। রেড ক্রস রোড দিয়ে এসে ১৭ নম্বর জাতীয় সড়কে উঠলাম। বিখ্যাত মানানচিরা স্কোয়ারকে একটা বেড় দিয়ে এগিয়ে চললাম দক্ষিণে। কিলোমিটার পাঁচেক যাওয়ার পর জাতীয় সড়ক ছেড়ে ডান দিকে পায়ানাক্কাল রোড। আরও ৫ কিমি পথ। ক্রমশ এগিয়ে এল সমুদ্র। এই ভ্রমণে আমাদের প্রথম সমুদ্র দর্শন।
আরও পড়ুন: ওয়েনাড় থেকে মালাবার/১: পথের ধারেই হাতি-হরিণের সঙ্গে সাক্ষাৎ
খুব সুন্দর সৈকত। এখানকার সব থেকে আকর্ষণীয় ব্যাপার হল, সমুদ্রের মধ্যে দিয়েই বাঁধানো রাস্তা। পশ্চিম দিকে এগিয়ে যাচ্ছি রাস্তাটা দিয়ে। ডান দিকে আরব সাগরের ক্লান্তিহীন ঢেউ, আর বাঁ দিকে শান্ত ব্যাকওয়াটার, যা চেলিয়ার নদী নামেই পরিচিত। ও পারেই রয়েছে জাহাজ তৈরির কারখানা, দেড় হাজার বছরের পুরোনো। কিলোমিটার খানেক হাঁটার পর রাস্তাটা শেষ। সামনে জল, বাঁ দিকে জল, ডান দিকে জল। ডাঙা বলতে শুধু যে রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে এসেছি। সূর্যাস্তের সাক্ষী থাকতে ভিড় জমেছে বেশ। সাগরের ঢেউয়ে ডুব দিলেন দিবাকর আর আমরাও ফেরার পথ ধরলাম।
হোটেলে ফেরার পথে এক বার ঢুঁ মারলাম মানানচিরা স্কোয়ারে। ঘড়িতে সন্ধে সাতটা, তাই মানুষজনের ভিড় দেখার মতো। এখানে রয়েছে মানানচিরা দিঘি। সেই সঙ্গে আনসারি পার্ক। আটটা পর্যন্ত খোলা থাকে। কিছু ক্ষণ সময় কাটিয়ে ফিরলাম হোটেলে।
বেপোরে সূর্যাস্ত।
একটা জমজমাট শহরের সৈকত যেমন হওয়া উচিত, কোড়িকোড়ের বিচ ঠিক তেমনই। সাতসকালেই ভিড় করেছেন স্থানীয় মানুষজন। কেউ মেতে আছেন শারীরিক কসরতে, কেউ ছোট্ট বাচ্চাকে প্যারাম্বুলেটরে ঘোরাচ্ছেন। একেই ফুটবল-পাগল রাজ্য, তার ওপর আইএসএল-জ্বরে আক্রান্ত। এক দল ছেলে এই সক্কালেই নেমে পড়েছে তাদের প্রিয় খেলা নিয়ে। আবার এক দল দেদার সেলফি তুলে চলেছে সমুদ্রকে পেছনে রেখে।
মর্নিংওয়াকের অছিলায় চলে এসেছি বিচে। হোটেল থেকে মেরেকেটে ১০০ মিটার। একটু পরেই কোড়িকোড় শহর ছেড়ে পাড়ি দেব আরও উত্তরে, তার আগে শহরের নিঃশ্বাসের জায়গাটাকে একটু ভালো করে চিনে নিচ্ছি। কাছেই আছে ১০০ বছরের পুরোনো দু’টি বিধ্বস্ত সেতুস্তম্ভ।
এক টুকরো কোড়িকোড়।
প্রাতরাশ করলাম শহরের বিখ্যাত প্যারাগন হোটেলে। ১৯৩৯-এ স্থাপিত হওয়া এই হোটেল ঐতিহ্য আর আধুনিকতার দুর্দান্ত মিশেল। দাঁড়িয়ে আছে রেড ক্রস রোড আর জাতীয় সড়ক ১৭-এর সংযোগস্থলে। যেমন দারুণ খাওয়া, ঠিক তেমনই সস্তা। ব্যস্ত ভ্রমণসূচিতে মাত্র আঠারো-উনিশ ঘণ্টা কোড়িকোড়কে সময় দিতে পেরেছি। তাই অনেক ভালো লাগা আর অনেক কিছু না-দেখতে পাওয়ার আপশোশ নিয়ে শহর ছাড়লাম। আমাদের আজকের রাত্রিবাস এখান থেকে ১৮০ কিমি দূরে কাসারগড়ে।
দারুণ একটা জায়গা বেছেছিলেন ভাস্কো ডা গামা নোঙর ফেলার জন্য। ১৪৯৮ সালের সেই স্মৃতি নিয়ে আজও কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে কাপ্পাড় সৈকত। কোড়িকোড় থেকে ১৮ কিমি। গাঢ় নীল জল আর ধবধবে সাদা বালির এক অসাধারণ মেলবন্ধন ঘটেছে এখানে। প্রকৃতির খেয়ালে এই সাদা বালির মধ্যে গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য রঙবেরঙের ফুল। ভাস্কোর পদার্পণের সাক্ষী হিসেবে রয়েছে একটি স্মারকস্তম্ভ।
কাপ্পাড় সৈকতে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আবার পথ চলা শুরু। ১৭ নম্বর জাতীয় সড়ক এক কথায় অনবদ্য। ডান দিকে পশ্চিমঘাট পর্বত আর বাঁ দিকে আরব সাগর। মাঝখান দিয়ে আমরা চলেছি। রাস্তা মাঝে মাঝে পাহাড়ে উঠে যাচ্ছে, আবার কখনও মনে হচ্ছে এই বুঝি সাগরকে ছুঁয়ে ফেলবে। ব্যাকওয়াটার বা খাঁড়ির জন্য বিখ্যাত কেরল। মাঝেমধ্যেই পেরিয়ে যাচ্ছি এ রকম খাঁড়ি। ডান দিকে দু’পাশে নারকেলবাগানের মধ্যে এঁকে বেঁকে ঢুকে যাচ্ছে জল, আর বাঁ দিকে সমুদ্রের মোহনা।
(উপরে) কাপ্পাড় সৈকত। (নীচে) ঐতিহ্যশালী প্যারাগন রেস্তোরাঁ।
কোড়িকোড় থেকে ৬০ কিমি। এল মাহে। কেরল থেকে হঠাৎ ঢুকে পড়লাম পন্ডিচেরি তথা পুদুচেরির প্রশাসনিক এলাকায়। চার দিকের চেহারাও যেন পালটে গেল। বিদেশে এসে পড়েছি মনে হচ্ছে। রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন। রাস্তার নাম, ধারের ঘরবাড়ি সব কিছুতেই ফরাসি ছাপ। তবে সড়ক এখানে বেশ সংকীর্ণ, তাই যানজটের সমস্যা আছে। মাহের সীমানা শেষ, আবার কেরল।
একটু পরেই পেরিয়ে গেলাম মুড়াপ্পিলানগাড় সৈকত যাওয়ার রাস্তা। এই সৈকতের বৈশিষ্ট্য, এর ওপর দিয়ে গাড়ি চলে। আমাদের মন্দারমণির মতো। আরও কয়েকটা স্পট দেখার ইচ্ছে ছিল, যেমন কান্নুরের একটু আগে থোটাড্ডা সৈকত আর সেন্ট অ্যাঞ্জেলো ফোর্ট, কান্নুর থেকে ৩২ কিমি উত্তরে অন্নপূর্ণেশ্বরী মন্দির আর এড়িমালা ভিউ পয়েন্ট, কিন্তু সময়ের অভাবে এ যাত্রায় অদেখাই থেকে গেল। (চলবে)
আরও পড়ুন: ওয়েনাড় থেকে মালাবার/২: কোড়িকোড় পৌঁছোতেই চমক, চলেছেন দশভুজা মা দুর্গা