গাড়োয়ালে ইতিউতি ২ / তিন বদরী, কল্পেশ্বর ছুঁয়ে মক্কুমঠে

temple at Makkumath
ashok ghosh
অশোক কুমার ঘোষ

বদরীনাথ থেকে ফিরতিপথে জমাট তুষার ছিল পথের দু’ পাশে, যেন টুথপেস্ট লাগানো। যাওয়ার সময় যে গাছগুলোকে দেখে মনে হয়েছিল কেউ যেন  তাদের গায়ে ওপর থেকে আটা ঢেলে দিয়েছে, তারা এখন সেটা ঝেড়ে ফেলেছে। এই ভাবে নামতে নামতে অলকানন্দা পার হলাম বলরাম মেমোরিয়াল ব্রিজের উপর দিয়ে। সাঁকো তৈরি করতে গিয়ে যাঁর প্রয়াণ হয়েছিল, তাঁর নামেই নামকরণ।

চলে এলাম পাণ্ডুকেশ্বর (১৯২০ মি)। কথিত যে এখানেই পাণ্ডু এবং কুন্তীর বিয়ে হয়েছিল। আর আছে যোগধ্যান বদরী মন্দির। সিঁড়ি দিয়ে বেশ কিছুটা নেমে মন্দিরচত্বর। রাস্তার দু’ পাশের বাড়িগুলিতে ঝলমল করছে এনিমোন গাঁদার ঝাড়। দু’টি মন্দির পাশাপাশি, একটি যোগ বদরীর, অপরটি বাসুদেবের। বড়োই সুন্দর মূর্তি। গ্রামটি বর্ধিষ্ণু।

আরও পড়ুন গাড়োয়ালে ইতিউতি ১ / তুষারাবৃত বদরীনাথকে প্রণাম

yog dhyan badri temple
যোগধ্যান বদরীনাথ মন্দির, পাণ্ডুকেশ্বর।

আবার চলা। একটু থেমে দর্শন হল বিষ্ণুপ্রয়াগ (১৪৫৮ মি), ধৌলিগঙ্গা এবং অলকানন্দার মিলনস্থল। চড়াইপথে উঠে চলা। দেওয়ালির ভিড়ের জন্য যোশীমঠে ঢোকার মূল রাস্তা বন্ধ, তাই বাইপাস ধরে এগিয়ে যাওয়া। রাস্তার দু’ পাশে পয়েনসেটিয়া ফুটতে শুরু করেছে। বাড়ির গামলায় বিভিন্ন রঙের জেরেনিয়াম জ্বলজ্বল করছে।

এ বার থামা হল উনিমঠ গ্রামে, এখানেই আছে বৃদ্ধ বদরীনাথের মন্দির (১৪৮৫ মি)। সিঁড়ি দিয়ে নামা গ্রামের মধ্য দিয়ে। মন্দিরচত্বর পরিছন্ন, শান্ত, মনোরম। ছোটো ফুলবাগান আছে। মধ্যাহ্ণভোজের বিরতি হল হেলাং-এর কাছেই।

A local child
বৄদ্ধ বদরীনাথ মন্দিরের কাছে এক স্থানীয় শিশু।

এর পরের পথ বেশ খারাপ। কাঁচা রাস্তা এবং অসমান। জায়গায় জায়গায় জল জমে কর্দমময়। কিছু জায়গায় কাজ চলছে রাস্তা মেরামতের।  অল্প পরেই পথের দু’ পাশে অরণ্য। চোখে পড়ল বাঁদর (রেসাস) এবং কিছু পাখি, হোয়াইট চিক্‌ড বুলবুল এবং ব্ল্যাক বার্ড। এ ভাবেই উরগম পার হয়ে হাজির দেবগ্রামে। গ্রামে গাড়ি ঢুকবে না, মালপত্র নিয়ে পায়ে চলার পথ ধরে উপস্থিত পথিক লজে। আজকের বিশ্রামস্থল।

শেষ বার এখানে থেকেছিলাম ২০১৪ সালে, রুদ্রনাথ থেকে ডুমক হয়ে ফেরার পথে। খুব একটা বদল হয়নি গ্রাম। দূরে দেখা যাচ্ছে নন্দাদেবীর তুষারশৃঙ্গ। কিছুক্ষণ বাদেই সূর্যাস্তের অস্তরাগে রাঙা হবে। সামনের একটা গাছে কাঠঠোকরা ঠকঠক করছে। আলো পড়ে আসছে, তাই প্রজাতি চিনতে পারলাম না। পরে ছবি দেখে যদি প্রজাতি চেনা যায়! চা পান করে লটবহর নিয়ে ঘরে প্রবেশ। আরামদায়ক শীতলতা। হালকা কম্বলেই হয়ে যাবে। এখানে রাতের খাবার সাড়ে সাতটার মধ্যেই সারতে হবে, জানালেন লজের মালিক রাজেন্দ্র নেগি। এদের দিন শুরু হয় রাতের অন্ধকার পরিষ্কার হওয়ার আগেই।

কল্পেশ্বর কেদারনাথ

nandadevi peak from devagram
অস্তরাগে নন্দদেবী শিখর, দেবগ্রাম।

পরের দিন সকাল সকাল যাত্রা শুরু কল্পেশ্বর মহাদেবের মন্দিরের উদ্দেশে। একটি ছোটো নালা পার হলাম সাঁকোর ওপর দিয়ে। দু’ পাশে ঘরসংলগ্ন জায়গায় লাগানো হয়েছে বাঁধাকপি, লঙ্কা, রাইশাক ইত্যাদি। ডালিয়া এবং ছোটো এনিমোন গাঁদাও ফুটে আছে। গত বারে একটি বেশ বড়ো ন্যাসটারসিয়ামের ঝাড় দেখেছিলাম, এ বার সেটা নেই। গ্রামের পথে চলতে চলতে অনেক মহিলাকে দেখলাম, যাঁরা ঘাড়ে বিশাল ঘাসপাতার বোঝা নিয়ে আসছেন। গবাদিপশুর খাদ্য। অন্ধকার থাকতেই ওঁরা র‌ওনা হয়েছেন পাহাড়ের উঁচুতে ঘাসভূমিতে। পরিশ্রমে কপালে ঘাম, একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন মাঝেমাঝে। দলে দলে যান এবং এক‌ই ভাবে ফেরেন, বন্যজন্তুর ভয় রয়েছে তো।

on the way to kalpeshwar
কল্পেশ্বরের পথে।

পথরেখা দু’ ভাগে ভাগ হল। বাঁ দিকেরটি গিয়েছে গ্রামের ওপর দিকে, যে পথ ধরে আমরা গত বার ফিরেছিলাম ডুমক গ্রাম থেকে। আমরা ধরলাম ডান দিকের পথ। আমাদের পথের ডান দিকের খেত খালি, রামদানা কেটে নেওয়া হয়েছে, গোলাপি ডালগুলো দাঁড়িয়ে আছে। এ-ডাল থেকে ও-ডালে উড়ে যাচ্ছে লেজ ঝোলা রেড বিল্‌ড ব্লু ম্যাগপাই। বুলবুলি এবং চড়াই আছেই। আর আছে পাতার গভীরে ওয়ার্বলার, দেখা দিয়েই ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। আমাদের পরমপরিচিত ছাতারের ক্যাঁচর ম্যাচর শোনা যাচ্ছেই।

পথ জায়গায় জায়গায় বাঁধানো। মৃদু চড়াই। গ্রাম ছেড়ে মাটির পথ হালকা গাছালির মধ্য দিয়ে। একটা ফাঁকা জায়গায় যাযাবরেরা আস্তানা গেড়েছে। বাচ্চাদের বেলুন ফুলিয়ে দিতে কী আনন্দ! ডান দিকে একটি সুন্দর ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড।

একটু পরেই কল্পগঙ্গা পার হলাম মজবুত সাঁকোর ওপর দিয়ে। গত বার এটা ছিল না। কয়েকটি সিঁড়ি উঠে তীর্থস্থানের গেট। ঘণ্টা বাজিয়ে প্রবেশ। ডান দিকে পাহাড়ি ঢালে খান দুয়েক ঘর, ভ্রাম্যমাণ সাধুরা থাকেন। রঙিন পতাকাশোভিত ত্রিশুল গাঁথা আছে পর পর। জুতো খুলে প্রবেশ গুহামন্দিরে। গুহা্র ওপরে মন্দিরের চূড়া বানানো আছে। গুহার ভিতরে পাথরের উঁচু চাতালে কল্পনাথ লিঙ্গ। মালা, ফুল দেওয়া আছে। আমরা, নিজেদের সঙ্গে আনা বেলপাতা, ধুতরো ফুল আর গঙ্গাজল সহযোগে নিজেদের মতো করে পুজো করলাম। ধূপ জ্বালিয়ে আরতিও করা হল। পূজারি পরে আসবেন নিত্যপূজার জন্য।

এই ফাঁকে কল্পেশ্বরের কাহিনিটা বলে নেওয়া যাক। স্বজনহত্যার পাপস্খালনের জন্য পাণ্ডবরা মহাদেবকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তিনিও ধরা দেবেন না। অবশেষে তিনি মহিষরূপ ধারণ করলেন ছদ্মবেশ হিসাবে। তবুও ধরা পড়ে গেলেন। এড়াতে না পেরে পাতালে প্রবেশ করতে লাগলেন, শেষ সময়ে পাণ্ডবরা যাতে তাঁকে ধরতে না পারেন। সেই অবস্থায় মহিষের যে যে অংশ মাটির উপর ছিল সেগুলি এক একটি কেদারতীর্থ। কল্পেশ্বরনাথ সেই হিসাবে মহাদেবের জটা। পরিপূর্ণ হৃদয়ে ফিরে চললাম। যাযাবর পরিবার হাত নেড়ে বিদায় জানাল। প্রাতরাশ সেরে এ বার আমাদের দেবগ্রাম ছেড়ে যাওয়ার পালা।

আরও এক বদরীনাথ এবং তুঙ্গনাথদেবের শীতকালীন আবাস

প্রাতরাশের পর নেগি পরিবারকে সম্ভাষণ জানিয়ে বিদায় নিলাম। দেবগ্রাম ছাড়ার কিছু পরেই ধ্যান বদরীনাথের মন্দির। ২০১৪ সালে যখন এসেছিলাম তখন দরজা খুলেছিলেন এক বৄদ্ধা, মুখে সব সময় ‘পরমাত্মা’ শব্দ।। খোঁজ করে ওঁর বাড়ি গেলাম – অথর্ব, কথাও বলতে পারেন না, বুঝতেও পারেন না। ওঁর ছবি দিতে উনি হাতে নিলেন কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। বয়সকালের ডিমেনসিয়া, যেটা আমরা দেখছি বাইরে থেকে। ওঁর মনের ভিতরের অবস্থান জানার জাদুকর আমরা নই। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠার ছবি পেয়ে সকলে খুশি। কয়েক জন সঙ্গেও এলেন মন্দির অবধি। মন্দিরপ্রাঙ্গণ বেশ প্রশস্ত, পাথর দিয়ে বাঁধানো।

woman with bundle of grass
ঘাস পিঠে মহিলা, দেবগ্রাম।

এর পরের পাহাড়ি রাস্তার পাশে কখন‌ও বসতি, কখন‌ও জঙ্গল। টান টান হয়ে চোখ খোলা রাখছি। মাঝে মাঝে লেপার্ড বাবাজীবন দেখা দেন এ অঞ্চলে। এ যাত্রায় দেখা দিলেন না, হয়তো তিনি অথবা তেনারা পাতার চিকের আড়াল থেকে আমাদের দর্শন করেছেন। একটি বসতি, জগপুরা, চোখে পড়ল একটি হোম স্টে, ব্রহ্মকমল কলোনি। কিছুটা যাওয়ার পর গাড়ি নীচে নামতে লাগল। পৌঁছোলাম মক্কুমঠ। সিঁড়ির ধাপ উঠে গিয়েছে বসতবাড়ির পাশ দিয়ে। কৌতূহলী বাসিন্দারা দেখছেন। স্থানটির চার পাশ পাহাড় দিয়ে ঘেরা থাকায় তুষারশৃঙ্গ দেখা যায় না।

local old lady
ভক্তিমতী বৄদ্ধা।

মন্দিরচত্বরটি বাঁধানো। মুখোমুখি তুঙ্গনাথদেবের শীতকালীন আবাসস্থল (মন্দির) এবং গঙ্গাদেবীর মন্দির। গঙ্গাদেবী মন্দিরের ভিতরে একটি মুখ দিয়ে ঝর্ণাধারা অবিরাম বয়ে চলেছে। দর্শনার্থীরা সেই জলে আচমন করে তুঙ্গনাথদেবকে দর্শন করছেন। প্রচলিত বিশ্বাস, তুঙ্গনাথদেব মহাদেবের বাহু। মন্দিরএলাকা লোহার বেড়া দিয়ে ঘেরা। এক দিকে পূজারির থাকার ঘর। আমাদের দেখে কয়েক জন বাসিন্দা এগিয়ে এলেন। আলাপচারিতায় জানা গেল, পড়াশোনার চল আছে। ওদের মধ্যে একটি মেয়ে গোপেশ্বরে পলিটিক্যাল সায়েন্স বিষয়ে এমএ পড়ছেন।

এই অঞ্চলের এক অশীতিপর ব্যাক্তি প্রতি বছর মন্দির বন্ধের সময় তুঙ্গনাথ যেতেন। তুঙ্গনাথদেবকে সঙ্গ দিয়ে মক্কুমঠে ফিরিয়ে আনতেন। ২০১৩ সালে ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তুঙ্গনাথে। ওঁরও ছবি আনা হয়েছে ওঁর হাতে দেওয়ার জন্য। কিন্তু জানা গেল, দু’ বছর আগে উনি প্রয়াত হয়েছেন। ভারাক্রান্ত মনে অনুপম ছবিটি একজনকে দিল, ওঁর বাড়ির কাউকে দেওয়ার জন্য। ফিরতিপথে চোখে পড়ল নির্মীয়মাণ কিছু অত্যাধুনিক রিসর্ট। এই স্থানটি পক্ষীপ্রেমীদের স্বর্গ বলে পরিচিত। (চলবে)

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *