গাড়োয়ালে ইতিউতি ৩/ কার্তিকস্বামীকে দেখে বানিয়াকুণ্ড হয়ে ধারী দেবী দর্শন

sunset on Chowkhamba, kanakchouri
সূর্যাস্তে চৌখাম্বা, কনকচৌরি।
ashok ghosh
অশোক কুমার ঘোষ

গাড়ি এগিয়ে চলল কনকচৌরির দিকে। ভিরি, বাসওয়ারা, ভানাজ হয়ে চন্দ্রনগর। বেশ বড়ো নগর। কিছু জায়গায় ধাপচাষ। তার পরেই বেশ ঘন জঙ্গল। এল মোহনখাল। এখান থেকে রাস্তা দু’ ভাগ – একটি গিয়েছে পোখরি, আমরা ধরলাম কনকচৌরির পথ। কনকচৌরিতে আগের বারের কটেজেই থাকা হল। সামনে বাগান, তার পর ঢাল নেমে গিয়েছে নীচের গ্রামের দিকে। আগের বারের তোলা ছবি দিতেই বাচ্চাদের এবং তাদের মায়েদের কী আনন্দ। কিছুটা পাহাড়ে উঠে চৌখাম্বা শিখর এবং তার প্রতিবেশীদের উপর অস্ত রবির আভা মন ভরিয়ে দিল। সন্ধ্যাটা গানের মজলিসেই কাটল।

on the way to kartikswami
কার্তিকস্বামীর পথে শেষ চড়াই।

পর দিন সকাল সকাল উঠে রওনা কার্তিকস্বামীর উদ্দেশে। হালকা চড়াই, মুখ্যত রোডোডেনড্রন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। পাখিরা জেগে উঠেছে, ডাকছে, ব্ল্যাক বার্ড, রামদাঙরা (সিনেরিয়াস টিট) আছে, হোয়াইট চিক্‌ড বুলবুলিও আছে। গাছের ফাঁক দিয়ে চৌখাম্বারা সব সময়ে  দেখা দিচ্ছে। অল্প ফাঁকা জায়গায় একটা বার্কিং ডিয়ার দাঁড়িয়েছিল, আওয়াজ পেয়েই গাঁক গাঁক ডাক ডেকে এক ছুটে জঙ্গলের ভিতর। স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে দেখা গেল অন্তিম রিজটি, যার শেষ বিন্দুতে আছে কার্তিকস্বামী মন্দির। তবে এখন‌ও দূর, রাস্তাটা পুরো হেয়ারপিন বাঁক নিলে তবে আসবে ওই রিজটি। এ ভাবেই চড়াই উঠতে উঠতে বাম দিকের রিজ ছেড়ে ডান দিকের রিজে চড়া। কিছু পরেই পুরোহিত মশাইদের থাকার জায়গা, তার পর থেকেই সিঁড়ি শুরু। আগের বার যখন এসেছিলাম তখন সিঁড়ি শুরু হয়েছিল আরো অনেক পর থেকে। রাস্তা বাঁধানাও হয়েছে। মহাদেবের মন্দিরের পর সিঁড়ি আরও খাড়া হল। গাছের সংখ্যা কমে গিয়েছে, তবে সারা রাস্তায় প্রচুর প্রজাপতি এখনও আছে।

 kartikswami temple
কার্তিকস্বামী মন্দির।

অবশেষে কার্তিকস্বামী মন্দির। উত্তর ভারতে একমাত্র কার্তিকের মন্দির। কথিত, গণেশ মাতাপিতাকে প্রদক্ষিণ করেই পৃথিবী পরিক্রমা সেরে ফেলেন। বর‌ও পান, যে কোনো  পুজোয় প্রথম পুজো পাওয়ার অধিকার। কার্তিকের অভিমান হল। কঠোর ধ্যানের মাধ্যমে শরীরের মাংস ত্যাগ করলেন, তার পর এখানে এসে হাড় ত্যাগ করলেন। তাই এই মন্দিরের পূজিত মূর্তিতে হাড়ের অবয়ব। মন্দিরের বাইরে কার্তিকের একটি মাটির মূর্তি দেখলাম, আগের বার ছিল না। মন্দিরের পিছনেই ১৮০ ডিগ্রি তুষারশিখরের প্যানোরামা। বাঁ দিক থেকে জাঁওলি, বন্দরপুঞ্ছ, গঙ্গোত্রী ১, ৩, ২, যোগীন ২, ১, থ্যালাইসাগর, ভাতৄকুন্ঠা, কেদারনাথ, কেদারডোম, সুমেরু, খরচাকুণ্ড, ইয়ানবক, ভাগীরথী, সতোপন্থ, মান্দানী, জানুকোট, চৌখাম্বা ৪,৩,২,১ এবং নীলকন্ঠ।  ঘণ্টা বাজিয়ে ফিরে চলা। চার পাশ খোলা থাকায় এই ঘন্টাধ্বনি বহু দূর থেকে শোনা যায়।   কনকচৌরিতে ফিরে মধ্যাহ্ণভোজ সেরে রওনা বানিয়াকুণ্ডের পথে।

বানিয়াকুণ্ডে  সূর্যোদয়

সাময়িক চা পানের বিরতি চোপতায়। হিমালয়ের কোনো জায়গা  প্রথম দেখার যে মুগ্ধতা থাকে, পরবর্তী দর্শনে ততটা থাকে না বিভিন্ন কারণে।  হোটেলের সংখ্যা বৃদ্ধি দৃষ্টিদূষণ ঘটাচ্ছে। মঙ্গল সিং-এর চটির পাশেই  তাঁর পুত্রের তৈরি বিলাসবহুল হোটেল কেমন যেন বেমানান।  আমাদের রাত্রিকালীন বিশ্রামস্থল বানিয়াকুণ্ড এখান থেকে তিন কিমি।

পাহাড়ি পথে এ-ধারে ও-ধারে বাঁক ঘুরতে ঘুরতে কিছুক্ষণের মধ্যেই বানিয়াকুণ্ড। উত্তর দিক ধু ধু খোলা। পাহাড়ি ঢাল নেমে গিয়েছে, ফলে উন্মুক্ত তুষারশ্রেণি। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় মায়াবী আভা চার পাশে। দক্ষিণ দিকে পাহাড়ের অপর দিক উপরে উঠে গিয়েছে গাছের কম্বল গায়ে দিয়ে। পাখির ডাক কানে আসছে। আলো পড়ে আসছে। সঙ্গের মালপত্র রিসর্টের ঘরে তোলা হয়ে গিয়েছে।  গা সির সির করছে, তবু ঘরে ঢুকতে ইচ্ছা করছে না। নিস্তব্ধতা নামছে। সোলার আলোর ছটা ঘরের ভিতর থেকে চুঁইয়ে বাইরে আসায় আধিভৌতিক পরিমণ্ডল তৈরি হয়েছে। টর্চের আলোয় মূল রাস্তা থেকে নেমে, ছোটো একটি শৌখিন সাঁকো পার হয়ে, ঘাসের জমি মাড়িয়ে কটেজের ঘরে প্রবেশ। হাত-মুখ ধুতে হবে। কটেজের দেওয়াল ভালো রকম ইনসুলেটেড, বেশ আরাম লাগছে। এ বার চা পান পর্ব শুরু হবে, চলবে সান্ধ্য আড্ডা। 

আরও পড়ুন গাড়োয়ালে ইতিউতি ১ / তুষারাবৃত বদরীনাথকে প্রণাম

২০১৩ সালে তুঙ্গনাথ থেকে ফেরার পথে এখানে শকুন দেখে গাড়ি থেকে নেমেছিলাম ছবি তুলব বলে। তখন জায়গাটা একেবারে ফাঁকা ছিল। শকুনদের জমায়েতের কাছে হাড়গোড় পড়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম, শকুনরা চিতাবাঘের মারা জন্তুর অবশিষ্ট অংশ‌ই ভক্ষণরত। ভাবার কারণ হল এ অঞ্চলে চিতাবাঘ প্রায়শ‌ই দেখা যায়। ২০১৩ সালে আমরা চোপতা পৌঁছোনোর পাঁচ মিনিট পরে যে গাড়িটি আসে, তারা সাড়ে চার ফুটিয়া চিতাবাঘের দর্শন পেয়েছিল। দেখা যাক এ বারে আমাদের দর্শন দেন কি না।

baniyakund
বানিয়াকুণ্ড।

আরামদায়ক পরিবেশে ঘুম ভালোই হল, শুধু মাঝে বেশ কয়েক বার কুকুরের ডাক শোনা গিয়েছিল। জানা ছিল, বন্যজন্তু বিশেষ করে চিতাবাঘ এলে কুকুর চেঁচিয়ে সবাইকে সাবধান করে। তা হলে কি তিনি এসেছেন? সাহস হয়নি, বাইরে বেরিয়ে সত্যতা যাচাই করার। গাড়ির ভিতর থেকে দেখাই ভালো, অথবা দরজার ফাঁক দিয়ে, যেমনটা ঘটেছিল রুদ্রনাথ যাওয়ার পথে পানার বুগিয়ালে, তবে সে অন্য পর্ব।         

ভোর ভোর ওঠা, সূর্যোদয় দেখতে হবে। গরম জামাকাপড় চাপিয়ে বাইরে এলাম, আধো আলোয় মনোরম পরিবেশ। ধীরে ধীরে রং ধরতে লাগল তুষারশৃঙ্গের গায়ে। বানিয়াকুণ্ডের যে ঢাল নেমে গিয়েছে উত্তর দিকে, তার পরেই তুষারপ্রাচীর সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ডান দিক থেকে বাঁ দিকে বয়ে গিয়েছে। ঢেউয়ের মাথাগুলি কেদারনাথ, চৌখাম্বা, জানুকোট নাম ধারণ করে নিজেদের উপস্থিতি জানাচ্ছে। ‘আহা কী দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না’। এই তুষারশ্রেণি শ্রেণী আরও কাছ থেকে দেখেছি চন্দ্রশিলা  ও চন্দ্রবদনী থেকে। এখান থেকে যা দর্শন করছি তা কেমন ধীরে ধীরে সামনের সবুজ অঞ্চল অপসৃয়মান হতে হতে নীচের জীবকুলকে রক্ষা করার জন্য নিজেকে খাড়া দেওয়ালে রূপান্তরিত করল। পাখির ডাক শুনছি। তিনটি রেড বিল্‌ড ব্লু ম্যাগপাই উড়ে গেল। ঘন গাছের মধ্যে লাফিং থ্রাশ ওড়াউড়ি করছে। বুলবুলি আছেই, আর আছে শালিক এবং দাঁড় কাক। কুকুর দেখা যাচ্ছে না, হয়তো গত রাতে ডিউটি দেওয়ার পর বিশ্রাম নিচ্ছে।       

 baniyakund in early morning
বানিয়াকুণ্ডে ভোর।

বলা হয়ে থাকে যে ব্যবসায়ীরা অর্থাৎ বানিয়ারা কোনো এক সময়ে এখানে শিবির স্থাপন করতেন ব্যবসার উদ্দেশ্যে যাত্রার সময়, তাই এই নাম। কুণ্ডের কোনো হদিস পা‌ইনি, কেবলমাত্র একটি ঝরনা দক্ষিণ দিকের পাহাড়ি ঢাল দিয়ে একাধিক ধারায় নেমে এসেছে। কোনো  কোনো ধারায় নল লাগিয়ে প্লাসটিকের ড্রামে জল ভরা হচ্ছে। এই জলধারার উৎসমুখে যাবার উদ্দেশ্যে দক্ষিণ দিকের চড়াই ভাঙতে শুরু করেছি, দেখি একটি কুকুর ডাকতে ডাকতে একটি বানরকে তাড়া করছে। বানরটি গাছে উঠে রক্ষা পেল, এবং তার পর‌ই বানরটা মুখ ভেংচাতে লাগল কুকুরটার দিকে। ঠিক যেন ‘কুমির জলকে নেমেছি’ খেলা।  মাথার ওপর দিয়ে সাদা কালো ডানা ছড়িয়ে উড়ে গেল কয়েকটি শকুন। বেশ কয়েক জায়গায় হাড়গোড় পড়ে আছে, আয়তন দেখে গবাদি পশু বলেই মনে হল। অর্থাৎ, প্রথমে আমরা যেটাকে চিতাবাঘ মারি বলে ভেবেছিলাম, সেটা নয়। এ স্থানকে হয়ত ভাগাড় হিসাবেই ব্যবহার করা হত।               

পায়চারি করে প্রকৃতি উপভোগ করে এবং পাখি দেখে সকাল কাটল। এ বার বানিয়াকুণ্ডের পরিবেশ ছেড়ে যাওয়ার সময়। মধ্যাহ্নভোজ সেরে রওনা দে‌ওয়া হল ধারি দেবীর উদ্দেশে।

ধারি দেবী দর্শন

গাড়োয়ালে বিভিন্ন যাত্রাপথে বহু স্থানের উপর দিয়ে যাওয়া হয়, থাকা আর হয় না। এ বারে ঠিক হল ধারি দেবীতে রাত্রিবাস করা হবে। স্থানটির আসল নাম কালিয়াসৌর। একেবারে অলকানন্দার তীরে। এখানে অলকানন্দা অনেক বদলে গিয়েছে গত কয়েক বছরে। ড্যাম তৈরির কারণে, নদী তার স্বাভাবিক বহমান ছন্দ হারিয়েছে, এখন আর সে নৄত্যরতা কিশোরী নয়। এখন ধীরস্থির সরোবর সম। সবজে নীল বসনে সমাহিত। জলস্তর বৃদ্ধির ফলে তীরবর্তী গাছ প্লাবিত হয়ে মনে হত নদীর মধ্য থেকে মাথা তুলে আছে। ‘বন্যরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। তাই মাঝ-নদী ডাঙার গাছের মাতৃক্রোড় নয়, গাছগুলি ধীরে ধীরে শুকিয়ে গেল।  এবারে দেখলাম তাদের কঙ্কাল। ধারী দেবীতে থাকার জায়গা ভারত সেবাশ্রম সংঘ। দু’ তলা, আরও ঘর তৈরি হচ্ছে, সামনে ছোটো বাগান, পিছনে অলকানন্দার পান্না জল।                       

dhari devi
ধারী দেবী।

পর দিন ভোরে কুয়াশাছন্ন আবহাওয়ায় রাস্তার অপর পারের পাহাড়ি ঢালের গাছগুলিকে জলছবি বোধ হচ্ছিল। সামনের ছোটো বাগানের এক জায়গায় জমা জলে এক জোড়া বুলবুল স্নান পর্ব  সারছে, হয়তো আমাদের মতো পুজো দিতে যাবে। আমরাও বার হলাম ধারীদেবী মন্দিরেরর পথে। অল্প কিছু হেঁটে মন্দিরের প্রবেশ দ্বার, বাঁধানো রাস্তা দিয়ে এঁকেবেঁকে নামা। পাশের ঝোপে পাহাড়ি চড়াই, সিলবার বিল আর বুলবুলির দাপাদাপি। সাঁকোর উপর দিয়ে গিয়ে মন্দিরচত্বর। ধারী দেবী মূর্তি, দেবীর ঊর্ধ্বাংশ। কালো পাথরে গড়া। কথিত যে দেবীর নিম্নাংশ কালীমঠে পূজিতা হন। সর্ববিধ প্রথা মেনে পূজাপাঠ চলছে, নারকেল ভেঙে প্রসাদ হিসাবে বিতরণ হচ্ছে। বেশ সংগঠিত এবং সুষ্ঠ ব্যবস্থা, কোনো হুড়োহুড়ি তাড়াহুড়ো নেই। শান্ত পরিবেশ। ড্যাম তৈরির প্রাক্কালে, দেবীমূর্তি স্থানান্তরিত করা হয়। তার কিছু দিনের মধ্যেই প্রলয় কাণ্ড ঘটে কেদারখন্ডে, মেঘফাটা জলে তাণ্ডব ঘটে যায়। দেবীর রোষ থেকে বাঁচতে নদীর বুকে থাম গেঁথে পূর্ব স্থানেই দেবীর পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। 

আরও পড়ুন গাড়োয়ালে ইতিউতি ২ / তিন বদরী, কল্পেশ্বর ছুঁয়ে মক্কুমঠে

মধ্যাহ্ণভোজ সারা। এ বার হরিদ্বারের উদ্দেশে র‌ওনা। গাড়োয়ালের পাহাড় ছেড়ে যেতে হবে এ বারের মতো। পাশের ঝোপ থেকে পুটুস ফুল (ল্যান্টানা কামারা) এনে গাড়ির চালক বাপিকে দিলাম। এক বছর বয়সি মেয়েকে আদর করে পুটুস বলে ডাকে। এই নামকরণের কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। ওই নামের যে কোনো ফুল আছে তা-ই জানত না। বাপির মুখে হাসি, খুব খুশি। গাড়ীর চাকা গড়াল, রাস্তার পাশের গাছ থেকে বিদায় জানাল কোকিলের কুহু কুহু। (শেষ)

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *