তিন দিনের অজ্ঞাতবাস ৪/ দারিংবাড়ি বিদায়

শম্ভু সেন

চন্দ্র গুছিয়েই খাওয়াল। কিন্তু আজ আমাদের তর সইছে না। ইকো হোমে ঘরের সামনে বসানো আরামকেদারাটা রোদে মাখামাখি হয়ে আমাকে ডাকছে। জানি, ডাকে সাড়া দিয়ে যদি একটু আয়েশ করি, তা হলে দু’ চোখের পাতা এক হয়ে যাবে। কিন্তু উপায় নেই। টুরিস্টি ভাষায় যাকে বলে স্পট, তারই কিছু দেখা এখনও বাকি যে। দারিংবাড়িকে চেনা এখনও তো সম্পূর্ণ হয়নি। তাই মনে মনে ‘আরাম হারাম হ্যায়’ আওড়ে আবার রওনা।

আরও পড়ুন: তিন দিনের অজ্ঞাতবাস ১/ দারিংবাড়ির পথে

পৌনে চারটেয় আবার যাত্রা। ইকো হোমের রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে এসে জাতীয় সড়কে পড়ে এ বার বাঁ দিকে ছুট। চৌমাথায় এসে সোজা এগিয়ে চলা। কয়েকশো মিটার পর্যন্ত দারিংবাড়ির ঘরসংসার। তার পর দু’ পাশের গাছগাছালি ভেদ করে ছুটে চলা। ঠিক যেন বলছে ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’। সামনে পাহাড়ের প্রাচীর। সেই প্রাচীরকে এ-দিক ও-দিক কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়া। এই পথে বসতি অনেক কম। তাই গাড়িঘোড়াও কম। নিরিবিলি এই পথই চলে গিয়েছে বামুনিগাঁও হয়ে হরভঙ্গি।

এমডিউবন্ডা ফলস্, এখন নিরীহ, বর্ষায় এর পাগলপারা রূপ।

চৌমাথা থেকে ১৩ কিলোমিটার আসার পর বিচ্ছেদ। আমরা ধরলাম ডান দিকের মোরাম পথ। শালের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে কিছুটা গিয়ে সেই পথও শেষ হল। এ বার পদব্রজে এগিয়ে চলা। মাটির পথ ক্রমশ নেমেছে নীচে। মহা আনন্দে গড়গড়িয়ে নেমে চলেছি। খেয়াল নেই, ফেরার পথে কিন্তু এই পথই ভাঙতে হাঁফ ধরবে। সে যা-ই হোক, ফেরার কথা ফেরার সময় ভাবব।

এ পথও শেষ হল। এ বার সিঁড়ি।

“কোথায় চলেছি আমরা?”

দিব্য ভাঙল না – “চলুন না, গেলেই বুঝবেন।”

পাইনের জঙ্গলে।

তরতরিয়ে নেমে চলেছি। ক্ষীণ একটা জলধারার আওয়াজ কানে আসছে মনে হচ্ছে। পৌঁছে গেলাম। শ’খানেক ফুট উঁচু খাড়া পাথরের গা দিয়ে তিরতির করে গড়িয়ে পড়ছে জল। সেই জল জমা হচ্ছে সামনে একটা ছোট্টো জলাশয়ে, তার পর জঙ্গল ভেদ করে বয়ে যাচ্ছে।     

“এমডিউবন্ডা ফলস্‌” – দিব্য জানিয়ে দিল। বর্ষায় এই ফলস্‌ আর ঝরনাধারা থাকে না, হয়ে যায় জলপ্রপাত। এর আওয়াজ শোনা যায় পিচের সড়ক থেকে। এখন দেখে মনে হয় যেন, কত নিরীহ, ভাসিয়ে দিতে কত সংকোচ।

ফেরার পথে ঢুঁ মারলাম পাইনের জঙ্গলে। পৌঁছে গেলাম নানা আকারের পাথরের উপর দিয়ে নেচেকুঁদে ভেসে চলা দুলুরি নদীর ধারে।

দুলুরির কোলে কিছুক্ষণ কাটিয়ে চলে এলাম দারিংবাড়ির একমাত্র কফি বাগানটিতে। বাগানকর্মীদের কাছে কফি গাছের ঠিকুজি-কোষ্ঠী জেনে পৌঁছে গেলাম চৌমাথায়।

দুলুরির চলা।

সন্ধে হব হব। আমরা ধরলাম বাঁ দিকের পথ। গ্রিন বাড়ি পেরিয়ে কিলোমিটার দুয়েক যাওয়ার পরই পৌঁছে গেলাম ‘সায়লেন্ট ভ্যালি’তে।

হ্যাঁ, এই হল দারিংবাড়ির সানসেট পয়েন্ট, ‘সায়লেন্ট ভ্যালি’। মোরাম রাস্তার ধারে দিব্য গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল। সত্যি, এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছে এই খানে। হাওয়া, পাতা, পাখি – কোনো কিছুরই আওয়াজ নেই এখানে। এই রাস্তাই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ক্রমাগত নেমে গিয়েছে নীচে। আমরা অনেকটা ওপর থেকে সামনের উপত্যকায় রাস্তার বিলীন হয়ে যাওয়া প্রত্যক্ষ করছি।

আর গোল লাল-হলুদ সূর্যটার দিকেও তাকাতে কোনো কষ্ট হচ্ছে না। সূর্য তো পাহাড়ের আড়ালে ডুব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। পশ্চিম আকাশে চলছে নানা রঙের কেরামতি। ক্রমশ কমে আসছে দিনের আলো। তার পর এক সময়ে ডুব। ঝুপ করে সন্ধে নামতেই ঠান্ডাটা যেন চেপে বসল।

চৌমাথায় চা খেয়ে গা-টা গরম করে যখন জাতীয় সড়ক ছেড়ে ইকো হোমের উঠতি পথ ধরলাম, দিব্যকে গাড়ির হেডলাইট জ্বালাতে হল।  

সূর্যাস্ত দিয়ে দিন শেষ করেছিলাম, সূর্যোদয় দিয়ে শুরু করলাম।  

কফি গাছের সঙ্গে আলাপ।

আর গড়িমসি করিনি। কম্বলের আরাম উপেক্ষা করেই উঠে পড়লাম। শীতের কামড় জোরদার। সোয়েটারের ওপর চাদর চাপিয়ে চলে এলাম দারিংবাড়ির ‘সানরাইজ পয়েন্ট’-এ, পরিত্যক্ত পান্থশালার চত্বরে। একটা পাথরে গুছিয়ে বসলাম।

“একটু বেশি আগে চলে এসেছি?”

ঋভুর প্রশ্নে সায় দিলাম। অন্ধকারটা এখনও গাঢ়। তবে শেষ চাঁদের আলোয় কেমন একটা মায়া মাখানো আশপাশটা। বেশ লাগছে। এখনও দারিংবাড়ির ঘুম ভাঙেনি। নীচে জাতীয় সড়কের ভেপার ল্যাম্পগুলো শুনশান শহরকে পাহারা দিচ্ছে।

আরও পড়ুন: তিন দিনের অজ্ঞাতবাস ২ / দারিংবাড়ির প্রেমে

বসে বসে ঘুম আসছিল। ঘুম তাড়ানোর জন্য আমরা দু’ জনে আমাদের পুরোনো ভ্রমণের জাবর কাটছিলাম।

একটু একটু করে অন্ধকারের চাদরটা সরছে। পুবের পাহাড়ের আড়ালে একটা তোড়জোড় চলছে যেন। এক চিলতে লালচে আভা। ধীরে ধীরে সেই আভা বিস্তার ঘটাল এ-দিক ও-দিক।

লাল ফিকে হতে হতে হলুদ বর্ণ ধারণ করল। পুবের আকাশে এখন এক বর্ণময় খেলা। পাহাড়ের আবডাল থেকে কেউ যেন উঁকিঝুঁকি মারছে। অবশেষে বেরিয়ে এলেন তিনি। একটু একটু করে সামনের জঙ্গল-পাহাড়, পিছনের উপত্যকা ভাসিয়ে দিলেন রোদে।

এতদ অঞ্চলের সব চেয়ে উঁচু জায়গাটায় গিয়ে পৌঁছোলাম। একটা আমগাছ ছায়া বিছিয়ে রেখেছে এখানে। সেই ছায়ায় দাঁড়িয়ে চোখ চালালাম যত দূর যায়। দারিংবাড়িকে মন-প্রাণ ভরে উপভোগ করলাম।

এ বার ফেরার পালা। (শেষ)

সায়লেন্ট ভ্যালি থেকে গাঁয়ের পথে।

কী ভাবে যাবেন

হাওড়া-বিশাখাপত্তনম লাইনে ব্রহ্মপুর স্টেশন। হাওড়া-যশোবন্তপুর এক্সপ্রেস বা হাওরা-চেন্নাই মেল সবচেয়ে ভালো ট্রেন ব্রহ্মপুর আসার। রাতে চেপে সকালে পৌঁছে যাওয়া যায় ব্রহ্মপুর। স্টেশন থেকে বাস-গাড়ি মেলে দারিংবাড়ি যাওয়ার। যেখানে থাকবেন, সেখানে বলে রাখলে তারাও পিক আপের ব্যবস্থা করে। ব্রহ্মপুর থেকে দারিংবাড়ির দূরত্ব ১২৫ কিমি। ট্রেনের বিস্তারিত সময়সূচির জন্য দেখে নিন erail.in।

আরও পড়ুন: তিন দিনের অজ্ঞাতবাস ৩ / দারিংবাড়ি ছাড়িয়ে

কোথায় থাকবেন

বেসরকারি পর্যায়ে দারিংবাড়িতে থাকার এখন প্রচুর জায়গা আছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডিয়ার্স ইকো হোম, ০৯৪৩৮৪ ২২৪৫২; হোটেল পদ্মা, ০৭৯৭৮১ ৬৬৭৩৩; হোটেল ইউটোপিয়া, ০৭০০৮২ ৪০৫৪৮; ইউটোপিয়া রিসর্ট ০৭০০৮২ ৪০৫৪৮; নেচার ভ্যালি রিসর্ট, ০৯০৪০৪ ২৩৫৩৪।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *