
‘আঁকা বাঁকা পথে যদি, মন হয়ে যায় নদী, তীর ছুঁয়ে বসে থাকি না…আমাকে ধরে রাখি না’ – আরতি মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠসুধা ‘বিলম্বিত লয়’ সিনেমায়। আমার পাঠককুলকে জানিয়ে রাখি, মানুষটা আমি একটু সেকেলে ধরনের যাকে বলে ব্যাক ডেটেড, অর্থাৎ বাবাকে বাবা আর মাকে মাম্মি নয়, মা-ই ডাকি। মেঝেতে বসে ভাত খাই, পুকুরে স্নান করি আর মাথায় মাখি সরষের তেল। আরও আছে, উত্তমকুমারের সিনেমা দেখি সেই ডানপিটে বয়স থেকেই, মান্না দে শুনি এবং চণ্ডীমণ্ডপের দুগ্গাঠাকুর দেখতে বড্ড ভালোবাসি। জাতে ভেতো বাঙালি, বাংলা ও বাঙালির চর্চা পুঁই-চচ্চড়ির মতোই প্রিয় আমার। এত দিন নজরুলের ‘দেখব এবার জগৎটাকে’ আঁকড়ে ছিলাম, কিন্তু প্রথমে ট্রাম্প আর পরে জিএসটি এসে ‘জগত’ তালাবন্ধ আপাতত। ইত্যবসরে আরতি দেবীই শেষমেশ বাঁচালেন, আঁকাবাঁকা পথে যদি…..দিয়ে। আরতি দেবীর বাড়ি এক বার গিয়েছিলাম বয়সকালে, ইউনিভার্সিটির সোশ্যালে আমন্ত্রণ জানাতে। তৃষ্ণার্ত আমাদের উনি সবুজ শরবত খাইয়েছিলেন সে দিন, আর আজ দিলেন দিশা, নতুন করে, বেড়ানোর।
আরও পড়ুন চেনা পথের অচিনপুর: প্রথম পর্ব/ মেঘাচ্ছন্ন টুমলিং-এ
পল্টুকে মনে আছে তো আপনাদের? সেই যে ঘরের আর পরের খেয়ে যে বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়? সে আমার অন্ত্যজ, দু’জনে মিলে নানা প্যাঁচপঁয়জার ভাজি আর মাঝেসাঝেই হই ভোকাট্টা। তা তাকে জিজ্ঞেস করলাম, একান্ন সতীপীঠের পাশাপাশি, পশ্চিমবঙ্গের তেইশটা জেলার তেইশটা জেলা সদর চক্কর দিলে কেমন হয়? উত্তর পেলাম, ভালোই হয়। শ্বশুরের মেজো আপদ, যে দুর্ঘটনাচক্রে আমার সঙ্গেই থাকে আগাগোড়া বিরোধী দলনেত্রীর ভূমিকায়, তাকে জিগালাম, হ্যাঁ গো, পরীক্ষা দিতে জলপাইগুড়ি তো যাবে, তা ওই সাথে কোচবিহারটা দেখে এলে কেমন হয়? ম্যাজিক হয়ে গেল বুঝলেন, সে-ও বলল, ভালোই হয়, কিন্তু কী আছে ওখানে? বললাম, কী আছে সেটা দেখতেই তো সেখানে যাওয়া। সুতরাং জলপাইগুড়ির পাশাপাশি কোচবিহার, পল্টু ব্যাটা খুশিতে ডগমগ।
জলপাইগুড়ি থেকে অহরহ বাস কোচবিহারের পথে। উত্তরবঙ্গ পরিবহণের নীল রঙের একটা বড়ো বাসে চেপে বসলুম। প্রথম পরীক্ষা ভালো হওয়ায় গিন্নির মেজাজ সপ্তম থেকে নেমে দ্বিতীয়ার ঘরে ঘোরাঘুরি করছে। বাপের মতো বাইরে বেরোলেই আমার বেটির দিল হয়ে যায় খুশ, সে বকর বকর করে গোটা বাসময় ছড়াচ্ছে ভালোলাগা। বাস ছাড়ল, জলপাইগুড়ি শহর ছেড়ে তিস্তা সেতু পার হয়ে কোচবিহারের উদ্দেশে। পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র খেয়াল করলে বুঝবেন, মানচিত্রের মগডালে কোচবিহার যার নীচের অংশটা আবার পশ্চিমবঙ্গই নয়, সেটা পড়শি দেশ, বাংলাদেশ। মানচিত্র অনুযায়ী মুর্শিদাবাদ থেকে ক্রমশ অবরোহণের কথা ভেবেই আমার চিত্ত চঞ্চল। অচেনা কোনো জায়গা দেখার সুবিধে হল, আপনি যা-ই দেখবেন, সবই লাগবে নতুন নতুন। ময়নাগুড়ি, ফালাকাটা, ধুপগুড়ি – সব একে একে পেরিয়ে যায় আর আমি গোগ্রাসে দু’চোখ দিয়ে গিলে চলি। জায়গাগুলো যে একেবারেই আমার কাছে অজানা তা কিন্তু নয়, ট্রেনে আলিপুরদুয়ার যাওয়ার সময় এগুলো চিনেছি, কিন্তু বাস-রাস্তায় এই প্রথম। ট্রেন সাধারণত লোকালয়ের বাইরে দিয়ে দৌড়োয়, তাই মাঠঘাট, খালবিলই বেশির ভাগ চোখে পড়ে। কিন্তু বাসের রকমসকম আলাদা, গ্রাম শহর এবং মহল্লার মধ্য দিয়ে তার চালচলনে পুরো রাস্তাতেই আপনার নানান অভিজ্ঞতা হতে থাকে, পথে যেতে যেতে।
আরও পড়ুন চেনা পথের অচিনপুর: দ্বিতীয় পর্ব/রোদ পোহাচ্ছে কালিপোখরি
ঘোকসাডাঙা ছাড়াল, আমার এক ক্লাসমেটের শ্বশুরবাড়ি হেথায়, সে ব্যাটা এত দূরের বেলতলা কেন পছন্দ করেছিল কে জানে! রাস্তার ধারে দু’একটা মন্দির-মসজিদও চোখে পড়ছে হঠাৎ হঠাৎ। শরৎচন্দ্রের লালু বন্ধুদের জিগাইছিল, মরার কি জাত আছে? আমি আবার বিশ্বাস করি পর্যটকেরও জাত থাকতে নেই, সে হবে ‘না ঘরকা, না ঘাটকা’ টাইপ, মানে যস্মিন দেশে যদাচার। ভগবানের সকল রূপ দর্শনই হবে তার মোক্ষ। মন্দির, মসজিদ, গির্জায় তার টান থাকবে সমান, না ধর্মীয় কারণে থাকতেই হবে তা নয়, তবে জানার ইচ্ছেটা থাকা আবশ্যক। অনেক ছোটোতেই পড়েছিলাম ধর্মের অর্থ ধারণ করা আর নিজ অভিজ্ঞতায় বুঝেছি যে কোনো প্রার্থনার মধ্যেই মনোসংযোগ, ইংরেজরা যাকে বলে ‘কনসেন্ট্রেশন’, মূল কথা। তাই দ্বিধাহীন ভাবে যত্রতত্র চলে যেতে পারি অবলীলায়, মাথায় রুমাল বেঁধে স্বর্ণমন্দিরের ডাল চাপাটি, মায়াপুর, বেলুড় মঠের প্রসাদ অথবা জগদ্ধাত্রী পূজোর নরনারায়ণ সেবার খিচুড়ি বা মসজিদের সিন্নি, পায়েস সবই চাখা আছে আমার, অবশ্য মারটা এখনও পড়েনি, মার খেলে কী হবে তা এখনই বলতে পারিনে।
জেলা পরিষদ অতিথি নিবাস
বাসস্ট্যান্ড থেকে জেলা পরিষদের অতিথিনিবাসে রিকশা করে যাওয়ার পথেই কোচবিহার প্যালেস নজরে পড়ল, এটাই শহরের মূল মনচোরা। প্রাথমিক দৃষ্টিতে তার সৌন্দর্য ও বিশালতা দেখে বুঝলুম পুরো বিকেলটাও না কম পড়ে। ফোনালাপ করাই ছিল, তাই ঘর পেতে অসুবিধা হল না। অতিথিনিবাসের বাহ্যিক রূপে খুব খুশি, কিন্তু বিছানায় কারও মধুচন্দ্রিমার ‘লাগা চাদর মে দাগ’ দেখে খানিকটা কেমন জানি ‘ফিল’ হল, সেটা হর্ষের না বিষাদের সেটা নিজেরই বোধগম্য হল না কিয়ৎক্ষণ, তবে এ সব নিয়ে কোনো কালেই আমার পেটখারাপ ছিল না, তাই সহজেই হজমের হজমোলা। একেবারে চৌমাথা মোড়ের কাছে অতিথিনিবাসের অবস্থান এবং দর্শনীয় স্থানগুলি পায়ে হাঁটা দূরত্বে, এটাই বিরাট পাওয়া, কেননা সঙ্গে আমার একজোড়া অশান্তি রয়েছে, আল্লাহতালা যাদের হাঁটতে বারণ করেছেন, কেন বারণ করেছেন তা অবশ্য এখনও অনাবিষ্কৃত।
হোটেলের নাম ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। এমনিতে সর্বভুক হলেও খাওয়া নিয়ে আমার একটু ঝকমারি রয়েছে, ভাত গরম না হলে আমার কান্না পায়, ঠান্ডা ভাতে হাত দিলে মরে যাওয়ার ইচ্ছে জাগে। তা দেখলুম, মাছের সাথে ভাতটাও গরম এবং বাঙালি মালিক রান্নাটাও করেছেন জমিয়ে। কথায় কথায় জানা গেল, বাঙালি এবং তার বাঙালিনি মিলেই এই হোটেলটি চালান আর জনগণকে কাঙালি ভোজন করান নাগালযোগ্য রেস্তোর বিনিময়ে, তবে বেলা ১টার আগে যে হোটেলের দরজা চিচিংফাঁক হয় না সেটা পই পই করে জানিয়ে রাখলেন। মৌরি চিবোতে চিবোতে আমরা রওনা হলাম কোচবিহার প্যালেসের পানে। এমনিতে কোচবিহার উত্তরবঙ্গের একমাত্র পরিকল্পিত শহর যার আবার রয়েছে হেরিটেজ তকমা। আমার চোখে শহর জলপাইগুড়ির তুলনায় অপরিচ্ছন্ন ঠেকছে, তবে সদ্য বন্যার কবল থেকে মুক্ত হওয়ার কারণেও নোংরাটা হয়ে থাকতে পারে। আর একটা জিনিস খুব জ্বালাচ্ছে, মাইকিং – দুর্গাপূজোর প্রাক্কালে শহরে এসেছি, জামাপ্যান্ট কোম্পানির ক্যাম্পেনে কান ঝালাপালা।
সাগরদিঘি ও রাতের কোচবিহার
জয়পুরের রানি গায়ত্রী দেবীর বাবার বাড়ি কোচবিহার। কুচ বা রাজবংশী এ অঞ্চলের বহু প্রাচীন জনজাতি, আর বিহার এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘বিহারা’ থেকে। যত দূর জানা গেল, অসমের কামরূপ রাজ্যপাটের অংশ নিয়ে গঠিত হয় কোচবিহার যা পরে কামতা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে কামতাপুর থেকে শাসিত হত। কোচ রাজবংশের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ রাজা ছিলেন বিশ্বসিংহ। তাঁর পুত্র নরনারায়ণের আমলে কামতা সাম্রাজ্য খ্যাতির চূঁড়োয় পৌঁছোয়। যদিও পরবর্তীতে কামতা দু’ভাগে ভাগ হয়, এক দিকে কোচ হাজো যা বর্তমানে অসমের অংশ, আর অন্যটা কোচবিহার, পশ্চিমবঙ্গের। তার আগে ১৬৬১ অব্দে মহারাজা প্রাণনারায়ণ মন দিলেন কোচবিহার রাজ্যের বিস্তারে। তবে হঠাৎই মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের অধীনস্থ বাংলার সুবেদার মীর জুমলা কোচবিহার আক্রমণ ও দখল করেন, নাম দেন আলমগীর নগর। যদিও দিন কয়েকের মধ্যেই প্রাণনারায়ণ নিজ রাজ্য পুনরূদ্ধারে সমর্থ হন। আরও জানা যায়, পূর্বে কোচ রাজ্যের রাজধানী এ শহর ছিল না। কোনো এক অজ্ঞাত সাধুর পরামর্শে, মহারাজা রূপনারায়ণ আঠারোকোঠা থেকে তোর্সা তীরবর্তী গুরিয়াহাটি যা বর্তমানে কোচবিহার টাউন, স্থানান্তরিত করেন রাজধানী। তার পর এই নতুন রাজধানী থেকেই পরিচালিত হয় রাজকার্য।
আরও পড়ুন চেনা পথের অচিনপুর: শেষ পর্ব/রেখে গেলাম পদচিহ্ন, নিয়ে গেলাম স্মৃতি
ব্রিটিশ শাসনমুক্ত ভারতবর্ষের সঙ্গে কোচবিহারের তৎকালীন শাসক মহারাজ জগদ্দীপেন্দ্রনারায়ণের চুক্তি মোতাবেক, কোচবিহার ভারত সরকারের শাসনাধীনে আসে ১৯৪৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। পরে ১৯৫০ এর ১৯ জানুয়ারি, অসম হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পশ্চিমবঙ্গের অংশ রূপে গণ্য হয় কোচবিহার যার সদর হয় শহর কোচবিহার। এ দিকে স্বাধীনতার প্রায় ৭০ বছর পূর্বে ব্রাহ্মধর্মের প্রচারক কেশবচন্দ্র সেনের কন্যার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন কোচ রাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণ। কোচবিহার রাজ্যে পৌঁছোয় নবজাগরণের ঢেউ। আধুনিক কোচবিহার শহরের রূপকার হিসেবে উঠে আসে মহারাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণের নাম। ইংল্যান্ডের বাকিংহাম প্যালেসের আদলে গড়ে ওঠে ভিক্টর জুবিলি প্যালেস বা অধুনা কোচবিহার প্যালেস, যার সামনে এই মূহূর্তে আমরা সপরিবার দাঁড়ায়ে রয়েছি, হাঁ করে। (চলবে)