
এক একজন দশ থেকে পনেরো বারও গেছে এই পথে। কেউ কেউ তো কোথায় ক’টা বাঁক, তা-ও গুনে বলে দিতে পারে। চড়াই ভেঙে উঠতে উঠতে যখন ক্লান্তিতে গতিরোধ হয়, পাশ দিয়ে হুশ করে চলে যায় ঝরঝরে ল্যান্ডরোভার। গাড়ির থেকে বাদামি সানগ্লাস আর নিখুঁত লিপস্টিক-শোভিত ঝকঝকে মুখ অবহেলাভরে তাকায়। স্টিক আঁকড়ে কোমর বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উশকোখুশকো চুলের ট্রেকারকে যেন তার বেমানান ঠেকে। গাড়িটা পথের বাঁকে অদৃশ্য হতেই ট্রেকারও মুষড়ে পড়ে। সুন্দরী অন্তর্হিতা হলেন বলে আদৌ নয়। যে রাস্তা ওই ল্যান্ডরোভার তিনটি ঘণ্টায় চলে যাবে, সেই পথ যেতে তার তিন তিনটি দিন লাগবে, এই ভেবে।

গাড়ির শব্দ ততক্ষণে মিলিয়ে গিয়ে আবার সব নিস্তব্ধ। কিছুক্ষণ নুব্জ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর তার সম্বিত ফেরে। ভেসে আসছে পাখির শিস, বইছে মিষ্টি বাতাস। ঝাউ গাছের ফাঁক দিয়ে রোদ্দুর ঝিলিক দিচ্ছে। ট্রেকার স্পষ্ট অনুভব করে, ক্লান্তি দূর হচ্ছে। প্রকৃতি তার সঙ্গে কথা বলছে। যে কথা গাড়ি কোনো দিন শোনেনি। পায়ের ছন্দ আবার জেগে ওঠে। স্টিকে খুট খুট শব্দ তুলে সে আবার সামনের মেঘের ভিতর হারিয়ে যায়।
এত পরিচিত, এত ব্যবহৃত হয়েও ঠিক এই কারণেই সান্দাকফুর পথ কখনও পুরোনো হয় না। তাই মানেভঞ্জন থেকে সকাল সকাল চলা শুরু করে এ ভাবেই প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলতে বলতে উঠে এসেছি চিত্রে-তে। তিন কিলোমিটার টানা চড়াই ভেঙে এখানে পৌঁছেছি। চিত্রে মনেস্টারির কিছু ওপরে গাড়ির রাস্তাটা দু’টো বড়ো পাক খেয়ে দূরে হারিয়ে গেছে। জমজমাট মানেভঞ্জনের পরে খান কয়েক ঘরের এই চিত্রে-কে বড় নিঃসঙ্গ বলে মনে হয়। তাই তাকে ছেড়ে যেতেও মায়া হয়। তার এক কাপ চায়ের নেমন্তন্ন রক্ষা করে উঠে পড়ি।

বাঁধানো রাস্তা ছেড়ে এ বার পাহাড়ি ঢালের পথ। মূলত রডোডেনড্রনের বন, তবে এই মরসুমে ফুল নেই। কেউ যেন পাখার বাতাস করতে করতে সেই বনপথে মেঘ উড়িয়ে নিয়ে চলেছে। আগে পিছে সব মেঘে ঢেকে গিয়ে হঠাৎ পথ হারানোর ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে। ফেলে আসা ধোঁয়াটে রাস্তায় শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। কিছুক্ষণ পর সঙ্গীর অবয়ব ফুটে উঠলে ধড়ে প্রাণ ফিরে পাই। কোনো কোনো জায়গায় পথ বড়োই এবড়োখেবড়ো। উঠতে নামতে বেশ কষ্ট। চলতে চলতে এক সময় আবছা কয়েকটা বাড়ি চোখে পড়ে। আরও দু’ কিলোমিটার পথ চলে এসেছি। লামেধুরা যেন শীতঘুমে জবুথবু। তাকে বিরক্ত না করে আমরা চুপিসারে মেঠো পথ ছেড়ে আবার গাড়ির রাস্তা ধরি।
আরও পড়ুন এক টুকরো ইতিহাস – বাণগড়
কংক্রিটের পথে চলার গতি বাড়ে। কখনও হালকা পাকদণ্ডি, আবার কখনও সোজা এগিয়ে চলা। পথের পাশে মাঝেমধ্যেই শঙ্কুবৎ বেঁটে খাম্বা মনে করিয়ে দেয়, আমরা ভারত-নেপাল সীমান্তরেখা ধরে ট্রেকিং-পোল ঠুকছি। পেশিগুলো ততক্ষণে অল্পবিস্তর বিদ্রোহ শুরু করেছে। এমনি করে আরও দু’ কিলোমিটার পার হয়ে আমরা তখন পরবর্তী স্টপের অপেক্ষায়। সামনে ঘন ধূসর মেঘের পথ-অবরোধ। মেঘের মধ্যে ঢুকে পড়তেই একটা গুম্ফা চোখে পড়ল। বুঝলাম মেঘমা পৌঁছে গেছি।
আরও পড়ুন দোলের সপ্তাহান্তে চলুন বিচিত্রপুর
কী সার্থক নাম এই জায়গাটার! গুম্ফাটা নেপালে, রাস্তার বাঁ দিকে। ডান দিকে ভারতের হোটেলে আমাদের জিরিয়ে নেওয়ার পালা। আমাদের গাইড এই পথের নিত্যযাত্রী। সে-ও জানাল, মেঘমাকে শেষ কবে মেঘমুক্ত দেখেছে, তারও মনে পড়ে না। মেঘমায় লাঞ্চ সেরে এ বার দিনের শেষ স্পেল শুরু। এখান থেকে রাস্তা দু’ভাগ হয়েছে। ডাইনের ভারতীয় কংক্রিট পথ দু’ কিলোমিটার ওপরে উঠে পৌঁছে গেছে টংলু। তার পর আবার দু’ কিলোমিটার নেমে এসে টুমলিং-এ ঢুকছে। বাঁয়ের কাঁচা পথ নেপালের গুরাসে গ্রাম হয়ে হালকা চড়াইয়ের ঢেউ তুলে সেই টুমলিং-এই এসে মিশছে। এ ভাবেই কাঁচা মেঠো গন্ধ আর কংক্রিটের ‘আধুনিকতা’ যেন বারবার নিজেদের বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েও পারেনি।

গুরাসের পথে মেঘাচ্ছন্ন টুমলিং-এ যখন পৌঁছোলাম, জাঁকিয়ে বসা শীত আর তার সঙ্গে প্রবল হাওয়া সবাইকে বার্তা দিল – ‘ঘরে চলো’। অগত্যা ট্রেকার্স হাটের রসুইঘরে গোল করে বসে আগুন পোহানো আর দেদার আড্ডা। সময় কাটানো যেন জলভাত। রাতের খাওয়া শেষে এক বার সাহস করে বাইরে গিয়ে দেখি মেঘেরা সব হারিয়ে গেছে। আকাশে একটা ধোঁয়াটে সাদা পথ কোন এক অজানা গন্তব্যের দিক নির্দেশ করছে। সেই পথে তখন লাখ লাখ তারার দলবদ্ধ ট্রেকিং। (চলবে)
ছবি: লেখক