ভ্রমণঅনলাইনডেস্ক: কী ভাবছেন? মধুচন্দ্রিমায় কোথায় যাবেন? এমন জায়গায় যেতে চান যেখানে আপনি নির্জনতা পাবেন, আবার নির্জনতার একঘেয়েমিও কাটাতে পারবেন? তা হলে চলুন মান্ডু। মেষপালিকা রূপসী রূপমতী ও সংগীতজ্ঞ রাজা বায়াজিদ খান তথা বাজ বাহাদুরের প্রেমকাহিনি আজও যার বাতাসে ঘুরে বেড়ায় সেই মান্ডু তথা মান্ডবগড় তথা শাদিয়াবাদ আদতে এক দুর্গনগরী। মালব মালভূমিতে ২০৮০ ফুট উচ্চতায় ৪৫ কিমি দীর্ঘ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। হাত বদল হয়েছে বার বার। শেষ পর্যন্ত মান্ডু রূপ নিয়েছে এক ভূতুড়ে শহরে। যুদ্ধ-প্রেম-সংঘাত-সংস্কৃতির এক অনন্য ইতিহাস বহন করে চলেছে মান্ডু।
মান্ডুতে শহুরে ভিড় নেই, কার্যত দূষণমুক্ত। রাতের আকাশ জুড়ে অসংখ্য তারা, যা অনেক জায়গাতেই বিরল। মান্ডুর দ্রষ্টব্যগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার জন্য এবং এখানকার প্রকৃতি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার জন্য এখানে দিন তিনেক কাটাতেই পারেন।
প্রধান প্রধান দ্রষ্টব্য

রানি রূপমতী প্যাভিলিয়ন এবং রেওয়া কুণ্ড
মান্ডুর বাস স্ট্যান্ড থেকে ৫ কিমি দক্ষিণে আফগান স্থাপত্যে বাজ বাহাদুরের গড়া রূপমতী প্যাভিলিয়ন অর্থাৎ প্রমোদ নিকেতন। মহলটি লম্বা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। লাগোয়া পাহাড় ঢালে রেওয়া কুণ্ড। বাজ বাহাদুর বিশেষ ভাবে তাঁর রানির জন্য এই কুণ্ড খনন করিয়েছিলেন যাতে রানির কখনো জলের অভাব না হয়। রূপমতী প্যাভিলিয়নের সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। রানি রূপমতী এই মহলে বসে বাজ বাহাদুর প্যালেস এবং নর্মদা নদী দুইই দেখতে পেতেন। প্রেমের সাক্ষী এই প্রাসাদে আপনার জীবনসঙ্গিনীকে নিয়ে অবশ্যই যাবেন। এখান থেকে সূর্যাস্ত উপভোগ করুন। কিংবা একেবারে ভোরে চলে আসুন। এক অদ্ভুত ভালো লাগায় মন ভরে যাবে।
বাজ বাহাদুর প্যালেস
রানি রূপমতী প্যাভিলিয়নের খুব কাছে এই প্রাসাদ, মান্ডু শহরের একটি অন্যতম আকর্ষণীয় অঞ্চল। সংগীতজ্ঞ রাজা বায়াজিদ খান তথা বাজ বাহাদুর ছিলেন মালওয়া বংশের শেষ রাজা। ১৫৫৫ থেকে ১৫৬২ সাল পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেছিলেন। পাহাড়ের পাদদেশে কয়েক শতকের প্রাচীন এই প্রাসাদটির স্থাপত্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই। প্রাসাদের সংগীতমহলটির অভিনবত্ব আছে। রূপমতীর ও বাজ বাহাদুরের গান ও তানের মজলিশ বসত এই মহলে।
আরও পড়ুন স্বল্পচেনা উত্তরবঙ্গ: একাকী গুলমা

নীলকন্ঠ প্যালেস
শহর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে এই প্রাসাদ। আকবরের আমলে ছিল রাজশাসকের প্রমোদপ্রাসাদ। পরে মরাঠাদের আমলে এই প্রাসাদে শিবের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাই ইসলামিক শৈলিতে গড়া এই মন্দির দেখলে অবাক হতে হয়। রাস্তার শেষে ৬১ ধাপ সিঁড়ি নেমে নীলকণ্ঠ প্রাসাদ। এই মন্দিরের পেছনে একটি জলপ্রপাত আছে যা এই মন্দিরের সৌন্দর্যকে দ্বিগুণ বৃদ্ধি করেছে।
জাহাজ মহল
এই মহলটি আদতে হারেম, গিয়াসুদ্দিনের আমলে তাঁর ১৫০০০ দাসীর জন্য বানানো হয়েছিল। মুঞ্জ তালাও ও কপূর তালাও-এর মাঝে জাহাজ মহল বা শিপ প্যালেস। এর গঠনশৈলী পর্যটকদের অভিভূত করে। চাঁদের আলোয় লেকের জলে এর প্রতিবিম্ব, সত্যিই যেন জাহাজ ভাসে। এই মহলের ভিতর রয়েছে বড়ো বড়ো হল, স্মৃতিস্তম্ভ আর টার্কিশ বাথ।
আরও দেখুন মান্ডুতে
ভিলেজ গ্রুপে

আলমগীর, দিল্লি ও ভাঙ্গি দরওয়াজা পেরিয়ে পৌঁছে যান মান্ডুর বাজার এলাকায়। এখানেই ভিলেজ গ্রুপ তথা সেন্ট্রাল গ্রুপ। বাস স্ট্যান্ডের পাশেই শ্বেতপাথরের আসরফি মহল তথা খিলজিরাজ মামুদ শাহর সমাধি, অনেকটাই বিধস্ত। পাশেই রামমন্দির। আসরফি মহলের বিপরীতে জামি মসজিদ, আফগান শিল্পের নিদর্শন। জামি মসজিদ লাগোয়া পাঠান স্থাপত্যে গড়া হোসাং শাহর সমাধি। শ্বেতমর্মরে হিন্দু-মুসলিম-আফগান শৈলীতে তৈরি ভারতের প্রথম সৌধ।
রয়্যাল গ্রুপে
এই গ্রুপেই জাহাজ মহল। তার পরিচয় তো আগেই পেয়েছেন। হাতি পোল পেরিয়ে শুরু রয়্যাল গ্রুপ। প্রথমেই লোহানি কেভস। পাহাড় কেটে খাড়া সিঁড়ি। আরও এগিয়ে জাহাজ মহল। বিপরীতে রাজদরবারের তাবেলা অর্থাৎ অশ্বশালা তথা তাবেলি মহলে আজ বসেছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মিউজিয়াম। সামান্য এগোতেই হিন্দোলা মহল তথা সুইং প্যালেস, প্রজাদের সঙ্গে রাজাদের সাক্ষাৎস্থল। জাফরির কাজ অনন্য করে তুলেছে একে। মুঞ্জ তালাও-এর উত্তরে রূপমতীর মহলটি আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। এই মহলের প্রবেশ ফটকে চম্পা বাওড়ি তথা স্টেপ ওয়েল। চম্পা বাওড়ির উত্তরে রূপমতীর হামাম। এরই পাশে ইন্দো-মুসলিম শৈলীতে তৈরি মান্ডুর প্রাচীনতম দিলওয়ারা খান মসজিদ তথা মকবরা। বাঁয়ে মোঘল ও রোমান স্থাপত্যের অনুপম নিদর্শন সম্রাট জাহাঙ্গিরের তৈরি জল মহল আজ বিধ্বস্ত। এ ছাড়াও দেখুন মসজিদের পুবে বর্গাকার সৌধের নাহার ঝরোখার (এখান থেকে সুলতান দর্শন দিতেন) ভগ্নাবশেষ, গদা শাহর (সুলতান মহম্মদের দ্বিতীয় মন্ত্রী) নিবাস তথা বিপণি।

সাগর তালাও গ্রুপে
সাগর তালাওকে কেন্দ্র করে সাগর তালাও গ্রুপ। এখানে দেখে নিন মালিক মুঘিতের মসজিদ, তার বিপরীতে ক্যারাভান সরাই, আর এই দুই ভবনের মাঝখান দিয়ে যে রাস্তা রয়েছে তা আপনাদের পৌঁছে দেবে এক অদ্ভুত নামের ভবনে – দাই কি ছোটি বহেন কা মহল। আদতে এটি একটি সমাধি, কাছেই দাই কা মহল। সাগর তালাওয়ের পাড়ে ইকো পয়েন্ট। আরও যেতে রয়্যাল এনক্লেভের কাছে নিরালা নিভৃতে পাহাড়ের বুকে সানসেট পয়েন্ট।
আরও কিছু দ্রষ্টব্য
মূল সড়কে ফিরে আসুন। চলুন মান্ডু বাজারের দিকে। সাগর তালাওকে বাঁ দিকে রেখে মালিক মুঘতির মসজিদ পেরিয়ে ডান দিকে ঘুরুন। খেত আর গ্রামের মধ্য দিয়ে পৌঁছে যাবেন হাতি মহলে। ফিরে আসুন মূল সড়কে। ডান দিকে দরিয়া খানের সমাধিকে রেখে মূল সড়ক থেকে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে প্রথমে পৌঁছে যান চোর কোট (সম্ভবত জেলখানা) এবং রাস্তার শেষে নীলকণ্ঠ প্রাসাদ।
কী ভাবে যাবেন
ট্রেনে বা বিমানে ইন্দৌর। সেখান থেকে বাস বা গাড়িতে মান্ডু, দূরত্ব ৮৭ কিমি। ট্রেনের সময়ের জন্য দেখে নিন erail.in।

কোথায় থাকবেন
রয়েছে মধ্যপ্রদেশের এমপিটি মালওয়া রিসর্ট ও এমপিটি মালওয়া রিসর্ট, অনলাইন বুকিং http://www.mptourism.com/। আছে প্রচুর বেসরকারি হোটেল, সন্ধান পাবেন নেটে সার্চ করে।