ঘরে বসে মানসভ্রমণ: মমতাজের বুরহানপুর

Shahi Qila

ভ্রমণ অনলাইন ডেস্ক: লকডাউনে ঘরবন্দি। আর ঘরবন্দি দশার একঘেয়েমি কাটাতে ভ্রমণ অনলাইন আপনাদের নিয়ে যাচ্ছে মানসভ্রমণে। এমন সব জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে যেগুলো পর্যটন-মানচিত্রে কিছুটা ব্রাত্য। দিচ্ছে সেই জায়গা সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য যা ভবিষ্যতে আপনার প্রকৃত ভ্রমণের রসদ হিসাবে কাজ করবে।

আজ চলুন মধ্যপ্রদেশের বুরহানপুর, যাকে বলা হয় ভারতীয় স্থাপত্যের লুকিয়ে থাকা মুক্তো। এখানে অন্তত ১২৬টি স্থাপত্য-নিদর্শন রয়েছে।            

Ahukhana
অহুখানা, যেখানে ছ’ মাস শায়িত ছিলেন মমতাজ।

১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দে তাপ্তি নদীর পাড়ে ফারুকি বংশের মালিক নাসির খান খান্দেশ রাজ্যের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করে মধ্য যুগের সুফি সাধক বুরহান-উদ-দীনের নামে নামকরণ করেন বুরহানপুর। ফারুকিদের হাত থেকে মোঘলদের হাতে বুরহানপুর যায় সম্রাট আকবরের আমলে। সম্রাট শাহজাহানের খুব প্রিয় জায়গা ছিল এই বুরহানপুর। ভারত সম্রাজ্ঞী মমতাজমহলের শেষ জীবন কেটেছে এখানে। ১৬১৭ খ্রিস্টাব্দে বুরহানপুরেই তাঁর প্রথম সন্তান রওশনআরার জন্ম হয়, শাহজাহান তখন তিনি যুবরাজ খুররম! শাহজাহান সম্রাট হওয়ার মাত্র তিন বছরের মধ্যে ১৬৩১ খ্রিস্টাব্দে বুরহানপুরের শাহি কেল্লাতেই চতুর্দশ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু হয় বেগম মমতাজমহলের। এই বুরহানপুরেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর শাহজাহান এখানেই তাজমহল গড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখানে শ্বেতপাথর না মেলায় পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয়। শেষ পর্যন্ত আগরায় গড়া হয় তাজমহল এবং ছ’ মাস বুরহানপুরে শায়িত থাকার পর মমতাজের মরদেহ আগরায় নিয়ে যাওয়া হয়।

কী দেখবেন

শহরে প্রবেশ তিন তলা বিশিষ্ট শনিওয়ারা গেট দিয়ে – এখানে রয়েছে হিন্দু আর মুসলিম মোটিফ। শনিওয়াড়া গেটের মতোই আরও দু’টি গেট রয়েছে বারের নামে যাদের নাম – ইতওয়ারা গেটবুধওয়ারা গেট। এ ছাড়াও রয়েছে লোহার মান্ডি গেটশিকারপুরা গেট।      

Royal Bath
রয়্যাল বাথ,

(১) শাহি কেল্লা – তাপ্তি নদীর পাড়ে ফারুকি বংশের দ্বিতীয় মিরন আদিল শাহের (১৪৫৭-১৫০৩ খ্রিস্টাব্দ) তৈরি সাততলা শাহি কেল্লা। সাততলা কেল্লার তিনটি তল মাটির তলায়। আর দৃশ্যমান চতুর্থ তলের ছাদে রয়েছে বাগান। এ ধরনের দুর্গ ভারতে আর আছে কি না সন্দেহ। এই কেল্লার অনেকটাই আজ ধ্বংস হয়ে গেলেও যতটুকু অটুট আছে তাই-বা কম কী! এই কেল্লার সিলিং-এ রঙিন চিত্রকলার যতটুকু আজও অটুট আছে, তা-ই বিস্মিত করে। এর অন্যতম আকর্ষণ হামাম বা রয়্যাল বাথ, মমতাজের জন্য তৈরি। ইরানি স্থাপত্যে কাচ ও কারুকার্যময় রংবেরঙের টালি দিয়ে তৈরি হামাম। শাহি কেল্লায় এ ছাড়াও রয়েছে দেওয়ান-ই-খাস, দেওয়ান-ই-আম ইত্যাদি।

(২) অহুখানা – তাপ্তির তীরে প্রাচীরে ঘেরা হান্টিং লজ। মমতাজমহলের খুব প্রিয় ছিল। মমতাজ ২৮ একর বিশিষ্ট মৃগদাবকে (ডিয়ার পার্ক) গোলাপ বাগানে পরিণত করেছিলেন। মৃত্যুর পর ছ’ মাস এখানেই শায়িত ছিলেন মমতাজ।   

jama masjid
জামা মসজিদ।

(৩) জামা মসজিদ – বুরহানপুরের অন্যতম দর্শনীয় স্থাপত্য। এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ফারুকিদের আমলে ষোড়শ শতাব্দীতে। কিন্তু শেষ করেন সম্রাট আকবর। মসজিদের মিনারগুলি ১৩০ ফুট উঁচু। সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের নজির রয়েছে এখানে। এই মসজিদের গায়ে রয়েছে আরবি ও সংস্কৃত লিপি। গান্ধী চকে এর অবস্থান।   

(৪) দরগা-ই–হাকিমি – দাউদি বোহরা ধর্মগুরু সৈয়দী আবদুল হাকিমউদ্দীনের সমাধি।

(৫) শাহ নওয়াজ খানের সমাধি – শহর থেকে ২ কিমি দূরে, উতাওলি নদীর ধারে। কালো পাথরে তৈরি এই স্থাপত্যটিকে বলা হয় ‘কালা তাজমহল’।

Darga
দরগা-ই–হাকিমি।

(৬) বেগম শাহ সুজার সমাধি – শাহজাহানের চতুর্থ পুত্রের পত্নীর সমাধি। এর দেওয়ালে ফ্রেস্কোর কাজ এখনও অটুট। ‘কালা তাজমহল’-এর কাছেই।

(৭) মর্দানা টার্কিশ হাম্মাম – চক মহল্লায়। জাহাঙ্গিরের তৈরি করা স্নানাগার, যেখানে এক সঙ্গে ১২৫ জন স্নান করতে পারতেন। মাটির তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল। খননকার্য চালিয়ে ২৮ বছর আগে একে বার করা হয়েছে।       

(৮) কুন্ডি ভান্ডারা বা খুনি ভান্ডারা – এখানে রয়েছে অসংখ্য টানেল, জল সরবরাহের এক অতি প্রাচীন পদ্ধতি। দেখে অবাক হতে হয়। শহর থেকে ৭ কিমি দূরে।  

Asirgarh Fort
আসিরগড় ফোর্ট।

(৯) আসিরগড় ফোর্ট – বুরহানপুর-খান্ডোয়া সড়কে বুরহানপুর থেকে ২১ কিমি দূরে আহির বংশের আসা আহিরের তৈরি করা দুর্গ। পাহাড়চুড়োয় অবস্থিত এই দুর্গ জয় করা মুশকিল ছিল, বিশেষ করে এর বাইরের দিকের প্রাচীরের জন্য, যা এখনও বেশ শক্তপোক্ত। একে বলা হত ‘দক্‌খন কা দরওয়াজা’ অর্থাৎ একে জয় না করে দক্ষিণ ভারতে ঢোকার উপায় ছিল না। এখানে রয়েছে ১০ শতকের শিবমন্দির

এ ছাড়াও বুরহানপুরে তাপ্তির তীরে রয়েছে অসংখ্য ঘাট।   

কী ভাবে যাবেন

দেশের প্রায় সব প্রধান শহরের সঙ্গে বুরহানপুর ট্রেনপথে যুক্ত। হাওড়া, মুম্বই, দিল্লি এবং বেঙ্গালুরু থেকে সরাসরি ট্রেন আসে বুরহানপুর। কলকাতা থেকে সরাসরি ট্রেন: হাওড়া-মুম্বই মেল (ভায়া ইলাহাবাদ) – রাত ৯.৫৫ মিনিটে হাওড়া ছেড়ে বুরহানপুর পৌঁছোয় পরের দিন রাত ১,৫৮-য়। স্টেশনে ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়ুন।

 Tomb of Shah Nawaz Khan
শাহ নওয়াজ খানের সমাধি।

হাওড়া থেকে সরাসরি ট্রেন কম থাকায় হাওড়া-নাগপুর রেলপথের ভুসওয়াল দিয়েও যাওয়া যায় বুরহানপুর। হাওড়া থেকে ভুসওয়াল যাওয়ার সুবিধাজনক ট্রেন – (১) গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস – হাওড়া ছাড়ে দুপুর ১.৪০-এ, ভুসওয়াল পৌঁছোয় পরের দিন দুপুর ১.১৫ মিনিটে। (২) মুম্বই দুরন্ত (সোম, মঙ্গল, বুধ ও শুক্র) – হাওড়া ছাড়ে সকাল ৮.২০-এ, ভুসওয়াল পৌঁছোয় রাত ৩.৪২ মিনিটে। (৩) পুনে দুরন্ত (বৃহস্পতি ও শনি) – মুম্বই দুরন্তের সময়ে চলে।     

ভুসওয়াল থেকে বুরহানপুর যাওয়ার জন্য ভোর থেকে রাত পর্যন্ত প্রচুর ট্রেন আছে। ট্রেন বিশেষে ৪০ মিনিট থেকে সোয়া ঘণ্টা সময় লাগে। ভুসওয়াল থেকে বুরহানপুর ৬৬ কিমি, সরাসরি করে গাড়ি ভাড়া করে চলে আসা যায়।

Tapti Retreat
তাপ্তি রিট্রিট।

কোথায় থাকবেন

থাকার জন্য মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের ‘তাপ্তি রিট্রিট’ হল সেরা ঠিকানা। যোগাযোগ: ২৩০এ এজেসি বোস রোড, রুম ৭, ষষ্ঠ তল, চিত্রকূট বিল্ডিং, কলকাতা ৭০০০২০, ফোন ০৩৩-২২৮৭৫৮৫৫। অনলাইন বুকিং http://www.mpstdc.com এবং http://www.mptourism.com/ । এ ছাড়াও বেসরকারি হোটেল, লজ আছে। নেটে সার্চ করলে পেয়ে যাবেন।

জেনে রাখুন

ট্রেনের বিশদ তথ্যের জন্য দেখুন erail.in

বুরহানপুর ভ্রমণে গাইডের ভূমিকা ভীষণই প্রয়োজন। যোগাযোগ করতে পারেন ঘনশ্যাম মালব্যের (ফোন: ৮৮২৭২৮২৯৬৯) সঙ্গে।

আরও পড়ুন: ঘরে বসে মানসভ্রমণ: চিল্কা-পাড়ে রম্ভা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *