শ্রয়ণ সেন
“আমাদের সবার বাড়িতেই নিজস্ব একটা বেডরুম থাকে, যেখানে আমি নিজের মতো করে থাকতে পছন্দ করি। সেখানে যদি বাইরের কোনো লোক ঢুকে পড়ে, সেটা তো একেবারেই অনভিপ্রেত! তেমনটা কখনোই চাইব না আমি। ঠিক সে ভাবেই জীবজন্তুদেরও নিজস্ব জগৎ আছে। সব সময় কি সে সেজেগুজে আমাদের সামনে ঘুরবে? সেটা কখনোই হতে পারে না।”
ছাত্রছাত্রীদের চিড়িয়াখানা সম্পর্কে বোঝাতে গিয়ে কথাগুলো বলছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ চিড়িয়াখানা প্রাধিকরণ (West Bengal Zoo Authority)-এর সদস্য-সচিব সৌরভ চৌধুরী। চিড়িয়াখানা নিয়ে যে ধারণা জনমানসে রয়েছে, সেটা থেকে এখন প্রায় পুরোপুরিই সরে আসা হয়েছে বলে জানালেন তিনি।
![](https://www.bhramononline.com/wp-content/uploads/2022/11/zoo1.jpg)
বদলে গিয়েছে চিড়িয়াখানার ধারণা
দেড়শো বছরের বেশি পুরোনো আলিপুর চিড়িয়াখানা কলকাতার অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান। সেই চিড়িয়াখানা কিন্তু এখন অনেক বদলে গিয়েছে। চিড়িয়াখানা সম্পর্কে আমাদের যে ধারণাটা প্রথমেই আসে, তা হল এটা জীবজন্তুদের কাছে কারাগারের মতো। খাঁচাবন্দি পশুপাখি, তাদের দেখার জন্য মানুষের ভিড়। তবে এখন ঢুকলে মনে হয় যে জীবজন্তুরা কারাগারে নেই, বরং তাদের কাছে জগৎটা অনেকটাই খোলামেলা। বরং দর্শনার্থীরা কিছুটা কারাগারে বন্দি যেন। কারণ একটা নির্দিষ্ট ছোট্ট সীমানার বাইরে তাঁরা বেরোতে পারবেন না।
সৌরভবাবুর বক্তব্যে ঠিক এটাই উঠে এল। তাঁর কথায়, “চিড়িয়াখানা এখন আরও সবুজ হয়েছে। প্রত্যেক জীবজন্তুকে আমরা যতটা দেখতে পাই, তার বেশির ভাগ অংশই কিন্তু আমরা দেখতে পাই না। ‘ডিসপ্লে’ এবং ‘অফ-ডিসপ্লে’ দু’টো আলাদা অংশ।” নতুন সব চিড়িয়াখানার ক্ষেত্রে তো হচ্ছেই, তবে আলিপুরে জায়গা কিছুটা অল্প হওয়া সত্ত্বেও এই ব্যাপারটা পুরোদমে পালন করার চেষ্টা হচ্ছে।
![](https://www.bhramononline.com/wp-content/uploads/2022/11/zoo4.jpg)
এই ধারণা বদলের অঙ্গ হিসেবে এখন দেখা যাচ্ছে যে চিড়িয়াখানার কিছু জায়গায় কাচ লাগানো হয়েছে। সাধারণ পর্যটক কাচের মধ্যে দিয়ে জীবজন্তু দর্শন করবেন। কাচের উপকারিতা কী? এই ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে আলিপুর চিড়িয়াখানার অধিকর্তা আশিস সামন্ত বলেন, “পর্যটকরা জীবজন্তু দেখলেই তো শোরগোল করেন। এতে জীবজন্তুদের কষ্ট হয়। যাতে পর্যটকদের চিৎকার চেঁচামেচি প্রাণীদের কান পর্যন্ত না পৌঁছোয়, পাশাপাশি পর্যটকরা যাতে পরিষ্কার ভাবে প্রাণীদের দেখতে পান, তাই এমনটা করা হয়েছে।”
তবে কাজ আরও চলছে। বাঘ, চিতাবাঘ, জাগুয়ার এবং ক্যাঙ্গারুর জন্য এমন কাচে ঘেরা জায়গা হয়েছে। এখন শেয়াল এবং নেকড়ের জন্যও ওই কাজ চলছে বলে জানান সামন্তবাবু।
![](https://www.bhramononline.com/wp-content/uploads/2022/11/zoo2-1024x576.jpg)
সংরক্ষণ প্রজনন
টিকিট কেটে ঢোকা, জীবজন্তু দেখা, খাওয়াদাওয়া করে বেরিয়ে আসা — এই ধারণা থেকে চিড়িয়াখানা সরে এসেছে। এখন চিড়িয়াখানা নিছক বিনোদনের জায়গা নয়। নানা রকম কাজও হচ্ছে এখন চিড়িয়াখানায়। তার মধ্যে অন্যতম হল ‘সংরক্ষণ প্রজনন’ তথা কনজারভেশন ব্রিডিং।
সৌরভবাবু এই বিষয় বলেন যে প্রচুর জীবজন্তু এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে। তাই তাদের সংরক্ষণ করে প্রজননের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এর পর তাদের প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের বিলুপ্তপ্রায় কিছু জীবজন্তুকে প্রজনন করা হয়েছে এবং প্রকৃতিতে ছেড়েও দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে রেড পান্ডা, নোনা জলের কুমির।
সৌরভবাবুর কথায়, “এগুলো চিড়িয়াখানার অজানা তথ্য। আমাদের উদ্দেশ্য, যে প্রকৃতির জন্য আমরা বেঁচে আছি, সেই প্রকৃতিকে যেন আমরা কিছু ফিরিয়ে দিতে পারি।”
অনেকেই জানেন না যে পশ্চিমবঙ্গের রাষ্ট্রীয় পশু হল বাঘরোল বা ফিশিং ক্যাট। সেই বাঘরোল এখন বিলুপ্তির পথে। তাকে সংরক্ষণ করে প্রজননের কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ চিড়িয়াখানা প্রাধিকরণের সদস্য-সচিব । পাশাপাশি সম্বর হরিণ এবং স্পটেড ডিয়ারের জন্যও এই কাজ করা হবে বলে জানান তিনি।
আসছে সাফল্যও
ধারণা বদলে দেওয়া এবং সম্পূর্ণ নতুন ভাবে কাজ করার জন্য আসছে সাফল্যও। সারা ভারতে ১৬৩টি চিড়িয়াখানা রয়েছে। কেন্দ্রীয় চিড়িয়াখানা প্রাধিকরণের (Central Zoo Authority) বিচারে সব বিভাগ মিলিয়ে দেশের সব চিড়িয়াখানার মধ্যে আলিপুর চতুর্থ স্থান অধিকার করেছে। আর মাঝারি-ছোটো বিভাগের চিড়িয়াখানাগুলির মধ্যে আলিপুর দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে।
![](https://www.bhramononline.com/wp-content/uploads/2022/11/zoo5.jpg)
তাৎপর্যের বিষয় হল এই তালিকায় গোটা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ চিড়িয়াখানার শিরোপা অর্জন করেছে দার্জিলিংয়ের পদ্মজা নাইড়ু চিড়িয়াখানা। আর মাঝারি-ছোটো বিভাগে চতুর্থ স্থানে রয়েছে ঝাড়গ্রাম। পশ্চিমবঙ্গের কাছে এটা যে একটা বড়ো সাফল্য তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।
বদলে গিয়েছে চিড়িয়াখানা। কারাগার নয়, এখানে প্রাণীরা এখানে উন্মুক্ত। আরও সবুজ হয়েছে চিড়িয়াখানা। নতুন ভাবে সেজে ওঠা চিড়িয়াখানা ডাকছে আট থেকে আশি সকলকে। এই শীতে তাই আপনাদের গন্তব্য হোক আলিপুর চিড়িয়াখানা। সাক্ষী থাকুন নতুন এক অভিজ্ঞতার।
কি অসাধারণ লিখেছো দাদা 👌🏼👌🏼👌🏼