সুদীপ মাইতি
পরের দিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম হরিণের সন্ধানে। মালদা শহর থেকে ১৯ কিমি দূরে আদিনা ডিয়ার পার্ক। এখানে ৫০ বিঘা জমি জুড়ে রয়েছে খান পঞ্চাশেক হরিণ। সকালের দিকে খাবার দেওয়ার সময় সব হরিণ এক সঙ্গে দেখতে পাওয়ার আনন্দই আলাদা। স্থানীয় এক বনকর্মীর কাছে শুনলাম এখান থেকে বাড়তি হরিণ যেমন অন্য চিড়িয়াখানায় পাঠানো হয় তেমনি কখনও কখনও বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় বাঘের খাদ্য হিসাবেও এখান থেকে হরিণ নিয়ে যাওয়া হয়। হরিণের এই এলাকা ছাড়াও অরণ্যটি বিশাল। ৫৬৯ একর জুড়ে। ওই বনকর্মী জানালেন, এই গহন অরণ্যে অনেক শিয়াল ও কিছু কিছু বিষাক্ত সাপও দেখতে পাওয়া যায়। মালদা শহরে যত বিষাক্ত সাপ ধরা পড়ে বনকর্মীরা সে সব এই গহন অরণ্যে ছেড়ে দেন।
হরিণের পর চলে আসুন পাশেই আদিনায় বা পাণ্ডুয়ায়। এটিও চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে বাংলার রাজধানী ছিল। এখানেই রয়েছে আদিনা মসজিদ। এই মসজিদ এত বড়ো ছিল যে এর সঙ্গে পৃথিবীর সব চেয়ে বড়ো মসজিদ সিরিয়ার দামাস্কাসের উমাইয়া মসজিদের সঙ্গে তুলনা করা হত। কথিত আছে সুলতান সিকান্দার শাহ এটি তৈরি করেন, যদিও এর মধ্যে দেখা মিলবে টেরাকোটার কাজ। তাই অনেকেই মনে করেন, এই স্থাপত্য শুধুমাত্র সুলতান সিকান্দার শাহের উদ্যোগে তৈরি নাও হতে পারে। বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রকমারি স্থাপত্যের নিদর্শন। ভগ্নাবশেষ দেখলেও কল্পনা করতে অসুবিধা হয় না সেই যুগে এটি কী রকম আকর্ষণীয় ছিল। এখানেই পেয়ে যাবেন আরও কিছু স্থাপত্যের নিদর্শন – একলাখি মসজিদ, যা নাকি সে যুগে এক লাখ টাকা দিয়ে তৈরি হয়েছিল; রয়েছে পাণ্ডুয়া শরীফ দরগা, সোনা মসজিদ যা আপনাকে ইতিহাসের পাতায় পৌঁছে দেবে। দুপুরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে এই ভ্রমণ। তা হলে খাওয়াদাওয়া করে চলুন যাই ভুতনি দ্বীপ ও ঝাড়খণ্ডে যাওয়ার ভেসেলঘাটে।
মালদা শহর থেকে মানিকচকের মথুরাপুর প্রায় ৩৫ কিমি রাস্তা। এখানকার শঙ্করটলা ঘাট পেরিয়ে যেতে হয় ভুতনি দ্বীপ, যার চারিদিক ঘিরে রয়েছে গঙ্গা। গঙ্গার চর থেকেই তৈরি হয়েছে এই দ্বীপ। এখন এই এলাকা এতটাই বড়ো যে এর মধ্যে রয়েছে তিন তিনটি পঞ্চায়েত। রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের একাধিক শাখা। যেতে চাইলে যেতে হবে ভুটভূটি করে।
এর পর আমাদের গন্তব্য ছিল এখান থেকে তিন-চার কিমি দূরে গঙ্গার আরও একটি ঘাটে, যেখান থেকে যাওয়া যায় ঝাড়খণ্ডের রাজমহল ঘাটে। বড়ো বড়ো ভেসেলে করে চলেছে ছোটো বড়ো গাড়ি, লরিভর্তি মালপত্তর। আপনিও যেতে পারেন ও পারে। একটু ঘুরে আসতে পারেন ঝাড়খণ্ড থেকে। তবে তার জন্য একটা দিনের প্রোগ্রাম করতে হবে। এখানে বিশাল গঙ্গার তীরে বসে সূর্যাস্তের দৃশ্য আপনাকে বেশ কিছুটা সময় আটকে রাখবেই।
আর যদি সময় নিয়ে যান তবে আর একটু টুকিটাকি ঘোরার কথা বলি। এখানে রয়েছে মহানন্দা নদীর তীরে রামকৃষ্ণ মিশন ও ভারত সেবাশ্রম সংঘ। রয়েছে কালিন্দি নদীর পাড়ে পুরাতন মালদার গলিঘুঁজি। আর হ্যাঁ, মালদার সঙ্গে যে রাজনৈতিক নেতার নাম জড়িয়ে আছে সেই গনি খান চৌধুরীর বাড়ি কোতোয়ালি। মালদা শহর থেকে প্রায় ছয় কিমি দূরে। টোটো করে মালদা শহর থেকে এসব ঘুরে বেড়াতে ভালোই লাগবে।
আর জানতে পারবেন মালদা শহরের অন্যতম প্রধান মোড়ের নাম ৪২০ মোড়। এটি পরে সুকান্ত মোড় নাম হলেও ৪২০ নাম আমরা ছাড়তে পারিনি। কেন কে জানে!
আর বলতেই ভুলে গেছি। মালদার আম। না, আমবাগান। আসলে মালদায় আপনি যেখানেই যান না কেন এই নয়নাভিরাম আমবাগানের মধ্যে দিয়ে যেতেই হবে। আর যদি মে-জুন মাসের গরমে যেতে পারেন তবে কাঁচা পাকা রকমারি আমের মাঝে এক আশ্চর্য অনুভূতি হবেই হবে। বর্ষাতেও এখানকার ফজলি। তবে শীতের ভ্রমণ সব সময়ই আলাদা আনন্দ এনে দেয়।
আরও পড়ুন গন্তব্য যখন মালদা: চলুন গৌড়, রামকেলি
কী ভাবে যাবেন
হাওড়া এবং শিয়ালদহ থেকে উত্তরবঙ্গগামী যে কোনো ট্রেনে চাপলেই আপনি আট দশ ঘণ্টায় পৌঁছে যাবেন মালদায়। আর দুপুর ২-১৫ মিনিটের শতাব্দী এক্সপ্রেসে চেপে বসলে লাঞ্চ ও সান্ধ্য টিফিন সহযোগে আপনি মালদায় পৌঁছে যাবেন সন্ধ্যা ৭-১৫ মিনিট নাগাদ। কলকাতা থেকে বাস পাবেন। দেখুন www.redbus.in । সরাসরি গাড়ি নিয়ে চলে যেতে পারেন, কলকাতা থেকে দূরত্ব ৩২৬ কিমি, পথ বর্ধমান-ভাতার-খরগ্রাম-মোরগ্রাম-ফরাক্কা হয়ে।
কোথায় থাকবেন
মালদা শহরে প্রচুর হোটেল রয়েছে। আপনার পছন্দ মতো কোনো একটিতে আপনি থাকতেই পারেন। সন্ধান পাবেন www.booking.com , www.makemytrip.com , www.yatra.com , www.trivago.in , www.airbnb.co.in , www.tripsavvy.com ইত্যাদি ওয়েবসাইট থেকে। এ ছাড়াও সরকারি ব্যবস্থাপনায় আছে মালদা ট্যুরিস্ট লজ। অনলাইন বুকিং – www.wbtdcl.com ।
ছবি লেখক