কাশ্মীর ভ্রমণে অবশ্যই দেখে নিন মার্তণ্ড সূর্য মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ

ভ্রমণ অনলাইনডেস্ক: কাশ্মীর উপত্যকায় এমন কিছু অনন্য স্থাপত্য রয়েছে, যা এখনও পর্যটকদের কাছে সে ভাবে পরিচিতি পায়নি। এমনই এক স্থান হল অনন্তনাগের মাত্তন শহরে অবস্থিত মার্তণ্ড সূর্য মন্দির।

ভারতের তিন প্রান্তে তিন প্রাচীন সূর্য মন্দির রয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম ওড়িশার কোনারক এবং গুজরাতের মোধেরার সূর্য মন্দির। কিন্তু সবার প্রথমে তৈরি হয় এই মার্তণ্ড সূর্য মন্দির। প্রসঙ্গত, বেদে উল্লিখিত আট জন সৌরদেবতা তথা আদিত্যের অষ্টমজন হলেন মার্তণ্ড, যার নামে এই মার্তণ্ড সূর্য মন্দির। 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মাত্তন শহরের বাজার এলাকায় আর-একটি সূর্যমন্দির আছে। সেই মন্দিরচত্বরে দুর্গা, শিব-পার্বতী ও রাম-সীতা-লক্ষ্মণেরও মন্দির আছে। মন্দির কর্তৃপক্ষ অবশ্য দাবি করেন, এই সূর্যমন্দিরও বহু পুরোনো। দেখে অবশ্য মনে হয় না। এবং সেই দাবির সমর্থনে কোনো প্রামাণ্য তথ্যও নেই।

তবে এই মন্দিরের জাঁকজমক বেশ বেশি। গাড়ির সারথিদের মাত্তনে মন্দিরের কথা বললেই মার্তণ্ড মন্দিরে নয়, এই মন্দির নিয়ে আসেন তাঁরা। আসলে সাধারণ পর্যটকের কাছে মার্তণ্ড সূর্যমন্দিরের খুব একটা পরিচিতি নেই। তাই ভিড়ও বেশ কম।

চোদ্দোশো বছর আগে তৈরি এই মন্দির

অষ্টম শতকে, আনুমানিক ৭২৫ থেকে ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই বিশাল মন্দিরটি গড়ে ওঠে। তবে মন্দিরটির কাজ শুরু হয়েছিল তারও দুশো বছর আগে।

৩৭৫ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই মন্দিরটির ভিত তৈরি করেন রাণাদিত্য নামক এক রাজা। তবে মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন কাশ্মীরের বিশাল প্রতাপশালী কারকোট বংশের রাজা ললিতাদিত্য মুক্তপিড়া ভিন্নমতে মুক্তপদ। সময়টা ছিল অষ্টম শতক।

মন্দিরকে ঘিরে যে ১৮৪টি দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে, সেগুলি নির্মিত হয়েছিল মহারাজা রাম দেওয়াইয়ের আমলে। এই ভাবে তিন রাজার রাজত্বে মার্তণ্ড সূর্য মন্দিরের নির্মাণ হয় বলে জানা যায়।

তবে এই মন্দিরের নির্মাণ নিয়ে আরও একটি মতও রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০৭-এ এই মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন রামদেব নামক এক রাজা। যদিও সেই মন্দির তখন ছিল অনেকটাই ছোটো। পরবর্তী রাজারা সেই মন্দিরের অনেক সংস্কার করেন। এবং শেষ পর্যন্ত অষ্টম শতকে ললিতাদিত্য এই মন্দিরকে বিশাল রূপ দেন।

অনন্য স্থাপত্যশৈলী

মন্দিরচত্বরের আয়তন ৩২ হাজার বর্গফুট। বহুজাতিক স্থাপত্যরীতির সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা এই মন্দির গোটা বিশ্বেই এক বিরল স্থাপত্য।   অদ্ভুত এক শৈল্পিক মেলবন্ধনে তৈরি হয়েছিল এই মন্দিরটি। এখানে স্থানীয় শিল্পের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল গান্ধার, গুপ্ত, চৈনিক, রোমান, সিরিয়া এবং বাইজেনটাইন ধারা।

চত্বরের কেন্দ্রস্থলে মূল মন্দির এবং তার চারপাশে ৮৪টি ছোটো মন্দির তৈরি হয়। এর মধ্যে ৮১টি মন্দিরে সূর্যদেব এবং তিনটে মন্দিরে শিবলিঙ্গ রাখা হয়। এই ছোটো মন্দিরগুলিই মূল মার্তণ্ড সূর্য মন্দিরের শোভা বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া মানুষের মূর্তি, জোড়া হাঁস, নৃত্যরতা নারীমূর্তি, বিষ্ণু, গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী প্রভৃতি দেবদেবীর মূর্তি-সহ মোট ১৮৪টা মূর্তি তৈরি হয় মন্দিরপ্রাঙ্গণে যা অধিকাংশই এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত।

মূল মন্দিরে অবস্থিত ছিল সূর্যদেবের মূর্তি। বিশাল আকৃতির মার্তণ্ড সূর্যমন্দিরের পরিকল্পনা এমন ভাবে করা হয়েছিল যে, সকালে সূর্যোদয় এবং বিকেলে সূর্যাস্তের মুহূর্তে সূর্যদেবতার মূর্তিটি আলোকিত হয়।

কী ভাবে ধ্বংস হল এই মন্দির

মন্দিরটির ধ্বংস হওয়ার কারণ কী? এ ব্যাপারে ঐতিহাসিকরা দু’ভাগে ভাগে বিভক্ত। তাঁদের একাংশ মনে করেন পঞ্চদশ শতকের শুরুর দিকে মন্দির ধ্বংস করেন সিকান্দার বুশিকান। বুশিকান শব্দটি এসেছে ‘বুতশিকন’ থেকে, যার অর্থ বিগ্রহ-ধ্বংসকারী।

সিকান্দরের দ্বারা এই মন্দির ধ্বংসের বিষয়টি উল্লেখিত রয়েছে কবি-ঐতিহাসিক জনরাজার ‘দ্বিতীয়’ তথা দ্বিতীয় রাজতরঙ্গিণীতে। সেখান তিনি লিখে গিয়েছেন, “হেন কোনো নগরী, শহর, গ্রাম, জঙ্গল ছিল না, যেখানে হিন্দু মন্দিরের মূর্তি ভাঙা হয়নি।” তবে মার্তণ্ড মন্দির সিকান্দারই ধ্বংস করেছিলেন কি না, সেটা নিশ্চিত করে কিছু বলেননি জনরাজা।

ঐতিহাসিকদের অনেকের মতে, মুসলিম শাসনকালে মন্দিরের রূপ পালটে দেওয়া হত, মূর্তি ভেঙে ফেলা হত ঠিকই, কিন্তু তার মানে এই নয় যে মন্দিরও ভেঙে ফেলা হত। এ দিকে, জনরাজার পরে রাজতরঙ্গিণীর আরও দুটো অংশ লেখা হয়। এর মধ্যে চতুর্থ তথা শেষ অংশটি লেখেন সুকা। সেখানে জানা যায় যে ১৫৫৪ সালে এক বিশাল ভূমিকম্প আঘাত হানে কাশ্মীর উপত্যকায়। কিন্তু মার্তণ্ড-সহ আরও দুই মন্দিরে বসবাসকারী মানুষজন ভূমিকম্প থেকে কোনো ভয় পায়নি। তাঁদের বিশ্বাস ছিল মন্দিরের পবিত্রতা তাদের সব দুর্যোগ থেকে রক্ষা করবে।

ঐতিহাসিকরা এই প্রসঙ্গটা উদ্ধৃত করে দাবি করেন যে নিশ্চয়ই ষোড়শ শতকেও এই মন্দির অক্ষত ছিল। সেই কারণেই মন্দিরে হিন্দু মানুষজন থাকতেন। 

মনে করা হয় মন্দির ধ্বংস হওয়ার পেছনে দুটি প্রাকৃতিক কারণ রয়েছে – তুষারপাত এবং ভূমিকম্প। এই দুটিই কাশ্মীর উপত্যকায় হানা দেয় অনবরত। অস্বীকার করার উপায় নেই যে তুষারপাতের কারণে মন্দিরের কারুকার্য ক্রমশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর ভূমিকম্প তো লেগেই থাকে।

কী ভাবে যাবেন

শ্রীনগর থেকে মার্তণ্ড সূর্যমন্দির ৬৭ কিমি, পহেলগাম শহর থেকে ৩৭ কিমি। দু’ জায়গা থেকেই গাড়ি ভাড়া করে আসতে পারেন। অথবা শ্রীনগর থেকে ট্রেনে চলে আসুন অনন্তনাগ। অনন্তনাগ স্টেশন থেকে ১৩ কিমি দূরে মার্তণ্ড সূর্যমন্দির। জম্মু থেকে গাড়ি করে যদি পহেলগাম তা হলে সারথি বলে পথে মার্তণ্ড সূর্যমন্দির দেখে নিতে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *