যে কোনো সময়েই যাওয়া যায় মহারাষ্ট্রে অষ্টবিনায়ক যাত্রায়, দেখে নিন কী ভাবে ঘুরবেন

ভ্রমণঅনলাইন ডেস্ক: আর কয়েক দিন পরেই গণেশ চতুর্থী উৎসব পালিত হবে সারা দেশ জুড়ে। তবে মহারাষ্ট্রে যে রকম ধুমধাম করে গণেশের আরাধনা হয়, তা দেশের অন্যত্র হয় না বললেই চলে। 

বেশ কিছু প্রাচীন ঐতিহ্যশালী গণেশ মন্দির রয়েছে এই রাজ্যে। তার মধ্যে রাজ্যের আটটি মন্দিরের গণেশকে ‘বিনায়ক’ বলা হয়। প্রতিটি বিনায়ক-বিগ্রহের এক এক রকম বৈশিষ্ট্য। এক যাত্রায় এই বিগ্রহগুলি দর্শন করা খুবই পুণ্যের কাজ বলে মনে করা হয়। আর এই অষ্টবিনায়ক যাত্রা খুবই ইন্টারেস্টিংও।

বছরের যে কোনো সময়েই এই যাত্রা করা যায়। তবে এই যাত্রা শুরু করতে হয় শ্রীময়ুরেশ্বর মন্দির থেকে এবং যাত্রা শেষও হয় এই মন্দিরে এসে। এই মন্দির পুনে থেকে ৬৬ কিমি দূরে মোরগাঁওয়ে। তাই এই অষ্টবিনায়ক যাত্রা পুনে থেকে শুরু করাই ভালো। প্রতিটি মন্দিরেই ভক্তনিবাস রয়েছে। ইচ্ছা করলে সেখানে রাত কাটানো যায়। তা ছাড়া সব জায়গাতেই হোটেল-লজ রয়েছে। সেখানেও রাত কাটাতে পারেন।   

কী ভাবে করবেন এই যাত্রা? ভ্রমণ অনলাইন সাজিয়ে দিল সেই যাত্রার ছক।

প্রথম দিন – পুনে পৌঁছে প্রথমে চলুন মোরগাঁওয়ে শ্রীময়ুরেশ্বর মন্দিরে, দূরত্ব ৬৩ কিমি। কারহা নদীর ধারে এই মন্দির। এখানে গণেশ বিগ্রহের তিন চোখ। শুঁড়টি বাঁ দিকে ঘোরানো।

সিদ্ধিবিনায়ক মন্দির, সিদ্ধাটেক।

শ্রীময়ুরেশ্বর দর্শন করে চলুন সিদ্ধাটেকে সিদ্ধিবিনায়ক মন্দিরে, দূরত্ব ৫৯ কিমি। ভিমা নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত এই মন্দির ইন্দৌরের মহারানি অহল্যাবাঈ হোলকারের তৈরি। একটি টিলার উপর অবস্থিত এই মন্দিরে গণেশ বিগ্রহের শুঁড়টি ডান দিকে ঘোরানো। অষ্টবিনায়কের মধ্যে একমাত্র এই বিগ্রহেরই শুঁড় ডান দিকে। শুঁড় ডান দিকে থাকলেই তাঁকে সিদ্ধিবিনায়ক বলা হয়।

সিদ্ধিবিনায়ক দর্শন করে চলুন থেউরের শ্রীচিন্তামণি মন্দিরে, দূরত্ব ৮২ কিমি। অষ্টবিনায়কের সব চেয়ে জনপ্রিয় মন্দির এটি। মন্দির-চত্বরে গণেশ ছাড়াও শিব, বিষ্ণু-লক্ষ্মী এবং হনুমানের মন্দির রয়েছে।

২৫ কিমি দূরের পুনে এসে রাত কাটান।  

দ্বিতীয় দিন – পুনে থেকে চলুন রায়গড় জেলার পালি গ্রামে বল্লালেশ্বর মন্দিরে, দূরত্ব ১২১ কিমি। সরসগড় ফোর্ট আর অম্বা নদীর মাঝে এই মন্দির।  ১৬৪০ সালে নির্মিত এই মন্দিরে পাথরের সিংহাসনে বিনায়ক বসে। বাঁ দিকে শুঁড়টি ঘোরানো। পিছনে ঋদ্ধি আর সিদ্ধি চামর দোলাচ্ছে।

গিরিজাত্মজ মন্দিরে ওঠার সিঁড়ি।

বল্লালেশ্বর মন্দির থেকে চলুন মাহাড়ে বরদবিনায়ক দর্শনে, দূরত্ব ৩৫ কিমি। এখানকার বিগ্রহ মন্দির-সংলগ্ন একটি জলাশয় থেকে পাওয়া গিয়েছিল। কথিত আছে, এখানে যে দীপটি জ্বলছে সেটি ১৮৯২ সাল থেকে জ্বলন্ত অবস্থায় রয়েছে। এই দীপের নাম নন্দদীপ।

এ বার চলুন এক গুহামন্দিরে অধিষ্ঠিত বিনায়ককে দর্শন করতে। বিগ্রহের নাম গিরিজাত্মজ। লেনাদ্রির গিরিজাত্মজ মন্দির বরদবিনায়ক মন্দির থেকে ১৪২ কিমি দূরে। এখানে পাহাড় কেটে প্রথম থেকে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের মধ্যে ৩০টি বৌদ্ধ গুহা তৈরি হয়। তারই ৭ নং গুহায় রয়েছে গণেশ বিগ্রহ। পাহাড়ের গায়ে ৩০০-এরও সিঁড়ি ভেঙে এই মন্দিরে উঠতে হয়। গিরিজা তথা পার্বতীর পুত্র গণেশ। তাই এখানে গণেশ গিরিজাত্মজ।

১৫ কিমি দূরেই ওজার শহরে রয়েছে বিঘ্নেশ্বর তথা শ্রীবিঘ্নহর মন্দির। পুনে-নাসিক সড়কে কুকাদি নদীর ধারে এই মন্দির। এখানে বিগ্রহ পুবমুখী, শুঁড় বাঁ দিকে ঘোরানো। গণেশের দু’ পাশে রয়েছেন ঋদ্ধি আর সিদ্ধি।

এখানকার ভক্তনিবাসে রাত কাটান। নদীর ধারে এই ভক্তনিবাসে রাত কাটাতে বেশ ভালো লাগবে। 

শ্রীবিঘ্নহর মন্দির, ওজার।

তৃতীয় দিন – বিঘ্নহর মন্দির থেকে চলে আসুন রাঞ্জনগাঁওয়ের মহাগণপতি মন্দিরে, দূরত্ব ৬৪ কিমি। এখানে গণপতির ১০টি শুঁড় আর ২০টি হাত রয়েছে। মন্দিরটি নবম থেকে খ্রিস্টীয় দশম শতকের মধ্যে তৈরি।

রঞ্জনগাঁওয়ের মহাগণপতি মন্দির থেকে ৬৯ কিমি দূরের শ্রীময়ুরেশ্বর মন্দিরে গিয়ে অষ্টবিনায়ক যাত্রা শেষ করুন।

শ্রীময়ুরেশ্বরকে আবার দর্শন করে ফিরে চলুন পুনে। পুনেতে আপনার ইচ্ছামতো দু’-একটা দিন কাটিয়ে ফিরে চলুন ঘরপানে।  

মহাগণপতি মন্দির, রাঞ্জনগাঁও।

কী ভাবে পুনে যাবেন

(১) হাওড়া-পুনে স্পেশ্যাল রোজ রাত্রি ৯-৫০ মিনিটে ছেড়ে পুনে পৌঁছোয় তৃতীয় দিন সকাল ৭.০৫-এ । (২) হাওড়া-পুনে এসি স্পেশ্যাল বৃহস্পতি ও শুক্রবার ভোর ৫-৪৫ মিনিটে ছেড়ে পুনে পৌঁছোয় পরের দিন সকাল ৯-৪০ মিনিটে।

বিমানেও সরাসরি পুনে যেতে পারেন সরাসরি। কিংবা মুম্বই গিয়ে সড়কপথে বাসে বা গাড়িতে পুনে যাওয়া যায়, দূরত্ব ১৪৮ কিমি।

কী ভাবে পুনে থেকে ফিরবেন

(১) পুনে-হাওড়া স্পেশ্যাল রোজ সন্ধে ৬-৩৫ মিনিটে ছেড়ে হাওড়া পৌঁছোয় তৃতীয় দিন ভোর ৩-৫৫ মিনিটে। (২) পুনে-হাওড়া এসি স্পেশ্যাল সোম ও শনিবার বিকেল ৩-১৫ মিনিটে ছেড়ে হাওড়া পৌঁছোয় পরের দিন রাত ৮-১০ মিনিটে।

বিমানেও ফিরতে পারেন।

কী ভাবে ঘুরবেন

পুনে থেকে গাড়ি ভাড়া করে নিন। গাড়ির জন্য পুনের কার রেন্টাল কোম্পানিগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। কিছু কোম্পানির ফোন নম্বর দেওয়া হল – (১) গুডলাক ট্রাভেলস (৯০৬৭৯৯৮৯৭৭, ৮৯৯৯৩০৬৪২২), (২) বিঘ্নহর্তা ট্রাভেলস (৯৮৮১৩৬০৭১৯, ৯৪০৩২৭৮৭১৯), (৩) যশ ট্রাভেলস (৯৭৬৪১১৪১১৪), (৪) রেন্ট আ কার পুনে কার রেন্টালস (৯৮২২১৯৯৮৯৯)।

কোথায় থাকবেন

প্রথম রাত কাটান পুনে শহরে। প্রচুর হোটেল-লজ আছে। আপনার গাড়ির সারথিকে বললে সে ঠিক জায়গায় নিয়ে যাবে।

দ্বিতীয় রাত কাটান ওজারে বিঘ্নহর মন্দিরের ভক্তনিবাসে। বুকিং অনলাইনে – https://shrivighnaharganpatiozar.org/

ফিরে এসে কয়েকটা রাত পুনেতে কাটিয়ে ঘুরে নিতে পারেন।

পার্বতী মন্দির, পুনে।

ঘুরে নিন পুনে

পুনে শহরে এবং পুনেকে কেন্দ্র করে অনেক জায়গা আছে, যা ঘোরা যায়। সুতরাং সে ভাবে প্ল্যান করে পুনেতে ক’টা দিন থাকবেন তা হিসেব করে নিতে পারেন। পুনেতে দেখে নিন –   

(১) মারাঠা শৈলীতে নানাসাহেবের তৈরি পার্বতী মন্দির, পুনে স্টেশন থেকে ৪ কিমি।

(২) পার্বতী মন্দিরের পাদদেশে ৩০ একর  জমি জুড়ে পেশোয়া উদ্যান।

(৩) শুক্রবারপেটে রাজা দিনকর কেলকর মিউজিয়াম।

(৪) শহর থেকে ৫ কিমি দূরে তালেগাঁও রোডে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নীরব সাক্ষী আগা খাঁ প্রাসাদ। ১৯৪২-এর আন্দোলনে এখানেই বন্দিবাস করেন মহাত্মা গান্ধী, কস্তুরবা গান্ধী, মহাত্মার সেক্রেটারি মহাদেবভাই দেশাই, সরোজিনী নাইডু প্রমুখ। এখানেই বন্দিবাসে প্রয়াত হন কস্তুরবা, মহাদেবভাই। পাশেই গান্ধী জাতীয় মিউজিয়াম।

(৫) শনিবারপেটে পেশোয়া বাজিরাও ১-এর দারুনির্মিত ৭ তলা দুর্গাকার প্রাসাদ বা শনিবার ওয়াড়া। এর অন্দরেই ঘটেছিল বাজিরাও ও রূপসী নর্তকী মস্তানির প্রেম।

(৬) কাছেই রাস্তার ও-পারে শিবাজির লাল মহল, ছবিতে শিবাজির জীবনচরিত বিধৃত।

(৭) পাতালেশ্বর মন্দির – শহরের পশ্চিমে শিবাজিনগরে রাষ্ট্রকূটদের কালে ৮ শতকের গুহামন্দির। ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠতে হয়।

(৮) সরসবাগ গণপতি মন্দির।

(৯) শ্রী মহালক্ষ্মী মন্দির।

(১০) দাগদুশেঠ হালোয়াই গণপতি মন্দির।

(১১) এক দিন ভোরেই বেরিয়ে পড়ুন। প্রথমে চলুন সিংহগড়, শহর থেকে ২৪ কিমি দূরে ভুলেশ্বর পর্বতমালায় ৪৩২০ ফুট উচ্চতায় শিবাজির দুর্গ। পথেই খড়াকভাসলা লেক, পাথাল লেক ইত্যাদি। সিংহগড় দেখে ফিরুন পুনে। এ বার চলুন শৈবতীর্থ ভীমাশংকর, দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম। সহ্যাদ্রি পাহাড়ে ৩৩৯২ ফুট উচ্চতায় মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে ভীমাশংকর। পুনে থেকে ৯৫ কিমি। আজকের প্রাতরাশ ও মধ্যাহ্নভোজ পথেই সারুন।

সিংহগড়।

মনে রাখবেন

(১) সব মন্দিরই প্রায় সারা দিন খোলা। শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালনাধীন গিরিজাত্মজ মন্দির সন্ধে সাড়ে ৬টায় বন্ধ হয়ে যায়।

(২) ৩০০-এরও সিঁড়ি ভেঙে গিরিজাত্মজ মন্দিরে উঠতে হয়। তাই উঠতে ও নামতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লাগবে।

(৩) গিরিজাত্মজ মন্দির দেখে ওজারে আসতে রাত হয়ে গেলে অসুবিধা নেই। পরের দিন আপনার হাতে অঢেল সময়। মন্দির দর্শন করুন পরের দিন সকালে।

(৪) রাত কাটিয়ে পরের দিন জার্নি শুরু করবেন খুব সকাল সকাল। প্রাতরাশ, দুপুরের খাওয়ার অনেক জায়গা পাবেন পথে। কোনো চিন্তা নেই।    

(৫) কোভিড টিকার দু’টি ডোজের সার্টিফিকেট থাকতে হবে। না থাকলে আরটি-পিসিআর নেগেটিভ রিপোর্ট থাকতে হবে। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। কোভিডবিধি মেনে চলতে হবে।

আরও পড়তে পারেন

চলুন বেরিয়ে পড়ি: উপকূল কর্নাটক ও গোয়া

স্বল্পচেনা উত্তরবঙ্গ: কার্শিয়াং ইকো ভিলেজ

স্বল্পচেনা উত্তরবঙ্গ: একাকী গুলমা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *