কলকাতা থেকে সড়কপথে: পুবের ব্রাইটন দিঘা

দিঘার সৈকতে।

ভ্রমণঅনলাইন ডেস্ক: দীর্ঘ চার মাস ধরে আমরা ঘরবন্দি। করোনা সংক্রমণের জেরে আমাদের পশ্চিমবঙ্গে কোথাও কোথাও আবার কড়াকড়ি লকডাউন শুরু হয়েছে। তবে নিজের বাহন থাকলে বা বাহনের ব্যবস্থা করতে পারলে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে অসুবিধা নেই। এতে দেহ ও মনের একটু নড়াচড়াও হবে।

আর শারীরিক ভাবে না বেরোতে পারলেও মানসিক ভাবে বেরিয়ে পড়তে দোষ কী? কিন্তু কোন পথ ধরবেন? আসুন তারই সন্ধান করা যাক।

কলকাতা থেকে দিঘা

দূরত্ব ১৮৩ কিমি। কলকাতা থেকে মুম্বইগামী জাতীয় সড়ক (পুরোনো নম্বর ৬) ধরে মেচেদা। সেখান থেকে বাঁ দিকে হলদিয়াগামী জাতীয় সড়ক (নতুন নম্বর ১১৬) ধরে নন্দকুমার। সেখান থেকে জাতীয় সড়ক ১১৬বি ধরে দিঘা। ৪-৫ ঘণ্টার জার্নি। সকালে বেরিয়ে দিঘায় হোটেলে চেক ইন-এর সময়ের ঠিক আগে পৌঁছে যান। মসৃণ সুপ্রশস্ত পথ ধরে গ্রাম বাংলার সবুজ প্রকৃতিকে সঙ্গী করে দামোদর, রূপনারায়ণ, কেলেঘাই, রসুলপুর, পিছাবনি নদীর জলভরা রূপ প্রত্যক্ষ করে পৌঁছে যান দিঘা।

যদি মনে করেন আপনার গন্তব্যে পৌঁছোবেন ধীরে ধীরে, পথের দ্রষ্টব্যগুলো দেখতে দেখতে, তা হলে সে ভাবে চলুন। না হয়, বেশ কিছুটা সময় লাগবে দিঘা পৌঁছতে। দু’টো দিন তো দিঘায় থাকবেন। অসুবিধা কী? পথে দেখে নিতে পারেন –

(১) গড়চুমুক – মুম্বইগামী জাতীয় সড়ক ধরে চলুন উলুবেড়িয়া। সেখান থেকে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে গড়চুমুক, কলকাতা থেকে ৫৮ কিমি। দেখে নিন গঙ্গা আর দামোদর নদীর সংযোগকারী অনামী খালের (সে-ও এক নদী) উপর ৫৮টি স্লুইস গেট (নাম যার ৫৮ গেট), ইউক্যালিপটাস-ঝাউ-চন্দন-জারুল-শিশু-বাবলা-কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়ায় ছাওয়া মৃগদাব।

গড়চুমুকে মৃগদাব।

(২) গাদিয়াড়া – গড়চুমুক দেখে চলুন গাদিয়াড়া, ১৯ কিমি। এখানে তিন নদীর সঙ্গম- গঙ্গা, রূপনারায়ণ আর দামোদর।

(৩) সামতাবেড় – গাদিয়াড়া থেকে চলে আসুন মুম্বইগামী জাতীয় সড়কে দেউলটিতে। সেখান থেকে চলুন সামতাবেড়ে কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের বাসভবনে। রয়েছে শরৎচন্দ্রের ব্যবহৃত জিনিসপত্রের প্রদর্শনী। কাছেই রূপনারায়ণ নদ। গাদিয়ারা থেকে দূরত্ব ৩৯ কিমি।

(৪) তমলুক – সামতাবেড় ঘুরে দেউলটি ফিরে চলুন তমলুক, দূরত্ব ২৯ কিমি। মুম্বইগামী জাতীয় সড়ক ধরে মেচেদা এসে হলদিয়াগামী জাতীয় সড়কের বদলে ধরুন তমলুকগামী রাস্তা। সুপ্রাচীন তাম্রলিপ্ত বন্দরের সাক্ষ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তমলুক, এখানে দেখে নিন হাজার বছরের প্রাচীন বর্গভিমা মন্দির। ৫১ সতীপীঠের অন্যতম, এখানে পড়েছিল সতীর বাঁ পায়ের কড়ে আঙুল। এ ছাড়াও দেখুন রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, মাতঙ্গিনী শহিদ স্মারক

(৫) গেঁওখালি – তমলুক থেকে ২৪ কিমি, গঙ্গা ও রূপনারায়ণের সঙ্গমে, গাদিয়াড়ার উলটো দিকে।

গঙ্গা ও রূপনারায়ণের সঙ্গমে।

(৬) মহিষাদল – গেঁওখালি থেকে ৯ কিমি। এখানে দেখে নিন দু’টি রাজবাড়ি – ১৮৪০ সালে নির্মিত রঙ্গী বসন প্রাসাদ ও ১৯২৬ সালে নির্মিত ফুলবাগ প্রাসাদ, লাল কুঠি (ফুলবাগ প্রাসাদের ঠিক পেছনে), রামজিউ মন্দির, মদন গোপালজিউ মন্দির, দধি বামন জিউ মন্দির ইত্যাদি।

(৭) নাচিন্দা – মহিষাদল থেকে দিঘার পথে। মহিষাদল থেকে ১৩ কিমি দূরে নন্দকুমার। সেখান থেকে ধরুন জাতীয় সড়ক ১১৬বি। এখান থেকে ৪০ কিমি দূরে দিঘা সড়কের ধারেই মা নাচিন্দার মন্দির।

(৮) দারিয়াপুর – দিঘার পথে চলুন কাঁথি পর্যন্ত, তার পর বাঁ দিকের পথে গেলে পৌঁছে যাবেন বঙ্কিমচন্দ্রের স্মৃতিধন্য কপালকুণ্ডলা মন্দিরে। নাচিন্দা থেকে দূরত্ব ২৪ কিমি। ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে বর্ণিত ‘কপালকুণ্ডলা মন্দির’ দর্শন করুন। কাছেই দারিয়াপুর লাইটহাউস। লাইটহাউসের উপর থেকে চারিদিকে নজর ছড়িয়ে দিন। দেখুন সমুদ্র আপনার কত কাছে।

(৯) বাঁকিপুট সমুদ্র সৈকত – দারিয়াপুর লাইটহাউস থেকে ৪ কিমি, ঝাউয়ের জঙ্গলে ঢাকা সৈকত। এ রাজ্যে সৈকত পর্যটনে নবতম সংযোজন।

(১০) জুনপুট সৈকত – বাঁ দিকে সমুদ্রকে রেখে সাড়ে ৭ কিমি দূরে চলে আসুন জুনপুট সমুদ্র সৈকতে। সারা পথেই সমুদ্র আপনার সঙ্গী থাকবে, কিন্তু ঝাউয়ের জঙ্গল আপনার দৃষ্টিপথে আড়াল তুলে রাখবে।

বগুড়ান সৈকত।

(১১) বগুড়ান সৈকত – সমুদ্রকে যথারীতি বাঁ দিকে রেখে প্রায় ৭ কিমি এগিয়ে যান। পেয়ে যাবেন আরেক সৈকত – বগুড়ান।
এই পথে দ্রষ্টব্যের কোনো শেষ নেই। দিঘা পৌঁছোনোর আগে আরও সৈকত আছে – মন্দারমণি, তাজপুর, চাঁদপুর, শংকরপুর –এগুলো আপাতত রেখে দিলাম দিঘা থেকে ঘুরতে আসার জন্য।

[booking_product_helper shortname="digha"]

দিঘায় ঘোরাঘুরি

সৈকত ধরে হাঁটুন দিঘায়। সূর্যোদয় দেখুন। তার পর সৈকত ধরে চলুন ওল্ড দিঘা থেকে নিউ দিঘায় কিংবা নিউ থেকে ওল্ডে। আর দেখে নিন অমরাবতী লেক, মেরিন অ্যাকোয়ারিয়াম, দিঘা সায়েন্স সেন্টার

সুন্দরী দিঘা।

দিঘা থেকে ঘুরে আসুন

(১) উদয়পুর সৈকত – ওড়িশা সীমানায়, দিঘা থেকে ৩ কিমি।

(২) চন্দনেশ্বর শিবমন্দির – ওড়িশায়, দিঘা থেকে ৬ কিমি।

(৩) তালসারি সৈকত – চন্দনেশ্বর শিবমন্দির হয়ে, দিঘা থেকে ৮ কিমি।

(৪) দিঘা মোহনা – দিঘা থেকে সাড়ে ৪ কিমি।

(৫) শংকরপুর সৈকত – দিঘা থেকে সাড়ে ১৬ কিমি

(৬) চাঁদপুর সৈকত – শংকরপুর সৈকত থেকে দেড় কিমি।

(৭) তাজপুর সৈকত – চাঁদপুর সৈকত থেকে সাড়ে ৪ কিমি।


আরও পড়ুন : কলকাতা থেকে সড়কপথে: নীলাচল পুরী


মন্দারমণি।

(৮) মন্দারমণি সৈকত – তাজপুর সৈকত থেকে ১৭ কিমি।

দিঘা থেকে গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়ুন। সব দ্রষ্টব্য কাছেপিঠে। এক দিনেই দেখে নিতে পারেন।

কোথায় থাকবেন

দিঘায় বেসরকারি হোটেল খুলে গেছে। সন্ধান পেয়ে যাবেন নেট থেকে। পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের দিঘালি টুরিজম প্রপার্টিও (আগেকার দিঘা টুরিস্ট লজ) খুলেছে। অনলাইন বুকিং: https://www.wbtdcl.com/। থাকতে পারেন একেবারে সমুদ্রের ধারে দিঘা-শংকরপুর উন্নয়ন পর্ষদ পরিচালিত সৈকতাবাসে। যোগাযোগ: ৮৯৪২০০৭৭৮৮

সৈকতাবাসের ঘরের ব্যালকনি থেকে সমুদ্র।

[booking_product_helper shortname="digha"]

মনে রাখুন

(১) দিঘা আসার পথে যতগুলো দ্রষ্টব্যের কথা লেখা হয়েছে, তার সবই যে দেখতে হবে, তার কোনো অর্থ নেই। কোনটা দেখবেন, কোনটা দেখবেন না, সেটা আপনার ব্যাপার। তবে দারিয়াপুর-বাঁকিপুট-জুনপুট-বগুড়ান আপনি দিঘা থেকে একদিন গাড়ি ভাড়া করেও ঘুরে যেতে পারেন। এর সঙ্গে জুড়ে নিতে পারেন খেজুরি সমুদ্র সৈকত ও অতীতের বন্দরনগরী হিজলি। হিজলির অন্যতম দ্রষ্টব্য ১৫ শতকের কারুকার্যমণ্ডিত মসনদ-ই-আলা মসজিদ।

(২) এই সময়ে কী ভাবে হোটেল তার অতিথিদের দেখভাল করবে তার এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর) জারি করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। মাস্ক পরা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, থার্মাল গান দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা মাপানো ইত্যাদি সাধারণ নিয়মগুলি ছাড়া আর কী কী নিয়ম মানতে হবে তা যাত্রার আগে হোটেলের সঙ্গে ভালো করে কথা বলে জেনে নেবেন।

(৩) গাড়িকে যথাসম্ভব শীতাতপনিয়ন্ত্রিত না করে জানলা খুলে চলুন। হাওয়া যতটা চলাচল করানো যায়। তাতে যাত্রাপথে মাস্ক পরে থাকলে সুবিধা হবে। আর পুরো যাত্রাপথে মাস্ক পরে থাকা বাঞ্ছনীয়। আর হাত মাঝেমাঝেই স্যানিটাইজ করবেন।

[booking_product_helper shortname="digha"]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *