কুমারী সৈকত চাঁদপুরে একটা দিন

শ্রয়ণ সেন

সে দিন চাঁদের আলো…

কী জানতে চেয়েছিল? সম্ভবত তার আলোর ছটায় সমুদ্রকে কেমন লাগছে সেটাই জানতে চেয়েছিল। বলতে দ্বিধা নেই, সমুদ্রকে এ রকম মায়াবী রূপে আগে কখনও দেখিনি। যে জায়গার নামেই রয়েছে চাঁদ, সেখানে চাঁদ যে এ রকম মায়াবী রাত তৈরি করবে সেটা আন্দাজই করা যায়।

জায়গাটার নাম চাঁদপুর। বছর তিনেক হল পশ্চিমবঙ্গের ভ্রমণ-মানচিত্রে স্থান পেয়েছে নতুন উপকূলীয় এই গন্তব্যটি। দিঘা, তাজপুর, মন্দারমণির তুলনায় এখনও সে ভাবে এর পরিচিতি বাড়েনি। এখানে থাকার জায়গাও মাত্র একটি, ‘হোটেল মুন’।

পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের সেই আপাত কুমারী সৈকতকে দেখতে সকালেই একটা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। হোটেলের ম্যানেজার আগে থেকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে সরাসরি গাড়িতে এলে তাজপুরের রাস্তা ধরতে। তাজপুর পেরিয়ে গেলে সমুদ্রের ধার দিয়ে পিচ রাস্তা ধরে কিলোমিটার তিনেক গেলেই পড়বে চাঁদপুর।

“হাত-পা ধুয়ে আগে আমাদের ছাদটা দেখে আসুন।”

হোটেলে ঢুকতেই এ কথাটি বললেন ম্যানেজার সাহেব। বলা ভালো আগে কখনও কোনো হোটেলে এ রকম শুনিনি, যে ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই পর্যটককে কেউ ছাদে পাঠায়। অবশ্য ছাদে না উঠলে বোঝা যেত না এই চাঁদপুরের আসল সৌন্দর্য। হোটেলের ঘরগুলি সি-ফেসিং নয়। ছাদই এই হোটেলের ইউএসপি। হোটেলের সামনে পিচ রাস্তা, তার ঠিক পরেই সমুদ্র।

সমুদ্রে এখন ভরা জোয়ার। বোঝা গেল এখানে সৈকত বলতে কিছুই নেই। বরং বলা ভালো, ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে সমুদ্র-ভাঙন। সেই ভাঙনকে আটকাতে তিন চারটে স্তরে শালবল্লা আর পাথর দিয়ে বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতিকে রোখে কার সাধ্যি। তিনটে স্তরের বাঁধ টপকে জল চলে আসছে একদম প্রথম স্তরে। সেখানে রয়েছে একটি ছিটেবেড়ার ছোটো দোকান। কার্যত সেই দোকানের পেছনেই ধাক্কা মারছে জল।

আরও পড়ুন তারাপীঠকে ‘বুড়ি’ করে

চাঁদপুর সৈকত। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

সমুদ্রের এই ভয়ংকর রূপ দেখতে দেখতে কিছুটা সময় কেটে গেল। মধ্যাহ্নভোজনের ডাক এল নীচে থেকে।

এখানকার খাবারের আলাদা ভাবে তারিফ করতেই হয়। কাঁসার থালা-বাসনে কোনো হোটেলে খাওয়াতে পারে এটা ভাবা যায় না। ঘি সহযোগে ভাত, ডাল, আলুভাজা, আলুপটলের তরকারি, বেগুনভাজা এবং তার সঙ্গে ইয়া বড়ো বড়ো পমফ্রেট। পেট এবং মন দু’টোই ভরে গেল। এ রকম পেট ভরে খাওয়ার পর একটা ভালো ভাতঘুম চাইছিল শরীর।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। রোদটা একটু কমতেই বেরিয়ে পড়লাম। ভাটার ফলে সমুদ্র এখন বেশ কিছুটা পিছিয়ে গিয়েছে। দেখা যাচ্ছে বালি। কিন্তু নামার কোনো উপায়ই নেই। সারি সারি শালবল্লা এবং পাথর পেরিয়ে সমুদ্রে নামতে গেলে চোট পেতে বাধ্য। কিন্তু সমুদ্রের ধারে এসে সমুদ্রে নামতে না পারা, এ কখনও হয়! উপায় বলে দিলেন স্থানীয় দোকানি। শংকরপুরে যাওয়ার কথা বললেন আমাদের। এখান থেকে সৈকত সরণি ধরে গেলে মাত্র ২ কিমি।

সমুদ্র-ভাঙন গ্রাস করেছে শংকরপুরকেও। সে এগিয়ে এসে গিলে খেয়েছে ঝাউবনের সারিকে। এখানেও তাকে আটকানোর জন্য তৎপর প্রসাশন। তৈরি করা হয়েছে ওল্ড দিঘার মতো বাঁধ। তবে ভাটা থাকায়, সেই বাঁধ পেরিয়ে সহজেই চলে গেলাম সমুদ্রের সামনে।

এ ভাবেই খেতে দেওয়া হয় হোটেল মুনে। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

উফ কী আরাম! অনেক দিন পর সমুদ্রের জলে পা ভিজিয়ে একটা অনাবিল আনন্দ গ্রাস করল। কিন্তু দিনের আলো যে কমে আসছে, তাই উঠে পড়তে হল।

লোডশেডিং যে এত ভালো লাগতে পারে সে দিন সন্ধ্যায় বুঝলাম। আসলে এখানে সন্ধ্যাটা ঘরে বসে কাটানোর জন্য নয়। যার ছাদ থেকে এত ভালো সমুদ্র দেখা যায়, সেখানে সন্ধ্যাটা ঘরে বসে কাটাব, এ হতেই পারে না। উঠে পড়লাম ছাদে। আর দু-তিন দিন পরেই পূর্ণিমা, তাই আকাশে বেশ বড়ো চাঁদ উঠেছে। একটু পরেই লোডশেডিং, ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে গেল চার দিক। জেনারেটরের সৌজন্যে হোটেলের ঘরে আলো জ্বলেছে কিন্তু ছাদ বা আশেপাশের ঘরবাড়ি তো অন্ধকার। এই অন্ধকারকে কাজে লাগিয়েই আরও মায়াবী হয়ে উঠেছে সন্ধ্যাটা।

আরও পড়ুন জলসাঘরের করুণ সুরে নিমতিতা রাজবাড়ি

ফসফরাস থাকার জন্য অন্ধকারেও সমুদ্রের ঢেউ ভালো বোঝা যায়। চাঁদের আলোয় আরও ভালো করে উপভোগ করছি তাকে। জোয়ার আসছে, তাই ক্রমশ এগিয়ে আসছে জল।

হিসেব করতে পারলাম না যে কত দিন পর এ রকম ভাবে আকাশ দেখছি। আসলে বাড়ি-অফিস, অফিস-বাড়ি করতে করতে তো খোলা আকাশটাই আর দেখা হয়ে ওঠে না। সেই সঙ্গে দেখছি তারার সম্ভার। কোনটা সপ্তর্ষি মণ্ডল, কোনটা কালপুরুষ, বোঝার চেষ্টা করছিলাম এবং ছোটোবেলার পড়াশোনা ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম।

সমুদ্র এবং মুক্ত আকাশ দেখতে দেখতে কখন যে রাত এগারোটা বেজে গিয়েছে খেয়ালই করিনি। রেস্টুরেন্ট থেকে নৈশভোজের ডাক এসেছে। তাই এই সুন্দর রাতের মায়া কাটিয়ে নেমে পড়লাম।

তাজপুর থেকে চাঁদপুর হয়ে শংকরপুরগামী এই রাস্তা। ছবি: লেখক

পরের দিন সক্কালে ঘুম ভাঙতেই বুঝলাম বাইরে অঝোরে বৃষ্টি।  ছাতা নিয়েই চলে গেলাম ছাদে। তবে ছাতা মাথায় দিতে হল না। ছাদেই, জলের ট্যাঙ্কের নীচে বেশ ভালো বসার জায়গা রয়েছে। সেখানেই বসে রইলাম। বৃষ্টি অবিরাম, কখনও কমছে কখনও বাড়ছে, কখনও পুরো সমুদ্র থেকে ধেয়ে আসছে কালো মেঘ আবার কখনও সেই কালো মেঘকে সরিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করছে এক চিলতে রোদ্দুর।

আরও পড়ুন এক টুকরো ইতিহাস – বাণগড়

তবে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলাম না। বাড়ি ফেরার তোড়জোড় শুরু করতে হবে যে। আসলে হাতে সময় অল্প। কোনো রকমে একদিনের ছুটি ম্যানেজ করে চলে এসেছি। বাড়ি ফিরেই আবার কর্মব্যস্ত জীবনে ঢুকে যেতে হবে।

সুযোগ পেলেই আবার চাঁদপুর চলে আসব, হোটেলের কর্মচারীদের এই আশ্বাস দিয়ে কলকাতার উদ্দেশে স্টার্ট দিল আমাদের গাড়ি। দিঘা তো কত বার গিয়েছি। কিন্তু চাঁদপুরের ওই মায়াবী রাত আমার স্মৃতিতে গেঁথে থাকবে অনেক দিন।

কী ভাবে যাবেন?

ট্রেনে গেলে হাওড়া থেকে তাম্রলিপ্ত বা কান্ডারি এক্সপ্রেসে চড়ে নামুন দিঘার আগে রামনগর স্টেশনে। স্টেশন থেকে গাড়ি বা টোটো পাওয়া যায়। আগে থেকে হোটেলকে বলে রাখলে পিকআপের ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। রামনগর থেকে চাঁদপুর ৮ কিমি। বাসে গেলে নামুন বালিসাই বাসস্টপে। সেখানে থেকে তাজপুরের রাস্তা দিয়ে তাজপুর হয়ে পৌঁছে যান চাঁদপুর। দূরত্ব ৬ কিমি।

কোথায় থাকবেন?

হোটেল মুন। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

চাঁদপুর থাকার জন্য হোটেল মুন বেশ ভালো। সমুদ্রের ধারে অবস্থিত হলেও হোটেলের ঘর থেকে সমুদ্র দেখা যায় না। তবে ছাদ থেকে সমুদ্র দেখায় কোনো বাধা নেই। সারা দিন কাটিয়ে দিতে পারেন হোটেলের ছাদে। যোগাযোগ ৯৮৩০৪০১৪৬০। এ ছাড়াও চাঁদপুরে থাকার জন্য রয়েছে চাঁদপুর ভিলেজ ইকো রিসর্ট যোগাযোগ ০৮৪২০২৪৩৪৩৩।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top