মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ৩: ঘৃষ্ণেশ্বর হয়ে কৈলাশে  

শ্রয়ণ সেন

১৬ বছর পরে আবার এলাম কৈলাশে। কিন্তু বিস্ময়ের ঘোর কাটল না। ঢোকার মুখে এক গাইডবুক বিক্রেতা বললেন, “সাতিয়াজিত রে, কাইলাসে কেলেনকারি। বহুত ফেমাস হ্যায়।”

একটু অবাক হলাম। আমাদের দেখে কী ভাবে মনে হল ওঁর, আমরা বাঙালি! না হলে আমাদেরই বা বলবেন কেন ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’র কথা। বিস্ময়ের আর- একটি ব্যাপার হল, গাইডবুক বিক্রেতা টুরিস্টদের কাছে ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’ মনে করিয়ে দিচ্ছেন কেন? এটা আমরা সবাই জানি এবং ২০০৪ সালে গিয়ে দেখেওছি, সত্যজিৎ রায় ‘সোনার কেল্লা’ লিখে রাজস্থানের জৈসলমেরকে জগদ্বিখ্যাত করে দিয়েছিলেন। ২০০৪ কেন, এই ২০২৪-এও দেখেছি, জৈসলমেরের গাইডদের মুখে খালি ‘সোনার কেল্লা’র কথা। দুর্গে মুকুলদের বাড়িটাও একটা দ্রষ্টব্য। তা হলে সে ভাবেই কি ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’র পর ইলোরা গুহায় পর্যটক যাতায়াত বেড়েছে?

জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি, অন্তত আমরা ইলোরা ভ্রমণে এসেছিলাম ২০০৯-এ। তার ঠিক দু’ বছর আগে ২০০৭-এ সন্দীপ রায়ের ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’ রিলিজ করেছিল। আমি তখন সবে মাধ্যমিক পাশ করে এগারো ক্লাসে পড়ি। একটু একটু করে সত্যজিৎ রায়ের গল্পের প্রেমে পড়ছি। ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’ দেখার আগে গল্পটা পড়ে ফেলেছিলাম। ২০০৯-এ আমাদের ইলোরায় আসার নেপথ্যে সত্যজিৎ রায়ের একটা বড়ো ভূমিকা ছিল। শুধু ১৬ নম্বর গুহা বা শুধু কৈলাশ মন্দিরই নয়, সে বার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে পুরো প্রাঙ্গণ ঘুরে ৩৪টি গুহা দেখেছিলাম। ২০০৯-এ এসে ইলোরায় পর্যটকদের যে ভিড় দেখেছিলাম, এই ২০২৫-এ এসে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ভিড় দেখলাম। তা-ও এটা পর্যটক সমাগমের মরশুম নয়। 

কৈলাশ মন্দিরে কারুকাজ।

শিরডীতে আমাদের বাস দু’ দিনের। কাছেপিঠে এমন অনেক জায়গা রয়েছে, ইচ্ছা করলেই ঘুরে আসা যায়। শিরডীর কাছেই তো রয়েছে নাসিক, সড়কপথে ঘণ্টাদেড়েকের যাত্রা। রামায়ণের পঞ্চবটীখ্যাত নাসিক আমাদের ঘোরা। তাই তো নাসিকে নেমেই চলে এলাম সাইবাবার কাছে। এই শিরডী থেকে যাওয়া যায় শনি শিংনাপুর, দূরত্ব ৭২ কিলোমিটার। শিরডীর রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করলেই অটো-গাড়ির চালকরা ডাকাডাকি করেন ‘শনি শিংনাপুর’, ‘শনি শিংনাপুর’ বলে। শনিমন্দিরের জন্য বিখ্যাত এই শনি শিংনাপুর। এখানকার শনি স্বয়ম্ভু। মেয়েদের ক্ষেত্রে এখানে প্রবেশের ব্যাপারে নানারকম বিধিনিষেধ ছিল। মূল গর্ভগৃহে তাদের প্রবেশাধিকার ছিল না। তাই এই মন্দির দর্শনের খুব একটা আগ্রহ ছিল না আমার। লিঙ্গবৈষম্যের প্রতিবাদ জানাতে তৃপ্তি দেশাইয়ের নেতৃত্বে ‘ভূমাতা রণরাগিনী ব্রিগেড’-এর শ’পাঁচেক মহিলা সদস্য ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি এই শনিমন্দিরে প্রবেশ করতে যান। পুলিশ তাঁদের পথ আটকায়। মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশের ব্যাপারে মহিলাদের যাতে বঞ্চিত করা না হয়, তা সুনিশ্চিত করতে ওই বছরেরই ৩০ মার্চ মহারাষ্ট্র সরকারকে নির্দেশ দেয় বোম্বে হাইকোর্ট। সেই মোতাবেক শনি শিংনাপুর ট্রাস্ট ৮ এপ্রিল থেকে মহিলাদের প্রবেশের ক্ষেত্রে সব রকম বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে নেয়। এই শনি শিংনাপুরের আর-একটি বৈশিষ্ট্য হল, এখানকার বাড়ি-ঘরদোরে কোনো দরজা নেই। এখানে চুরি-ছিনতাই-ডাকাতি-রাহাজানি বলে কিছু নেই। জায়গাটা এতই নিরাপদ যে দরজা বন্ধ রাখার কোনো প্রয়োজন হয় না। স্বয়ং শনিই নাকি সব পাহারা দেন। তবে ইদানীং এই সুনামে কিছুটা ভাটা পড়ার খবর আসছে।

তবে আমাদের আজকের ভ্রমণ কর্মসূচিতে অবশ্য শনি শিংনাপুর নেই। রয়েছে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম ঘৃষ্ণেশ্বর দর্শন। তার সঙ্গে ইলোরার কৈলাশ মন্দিরকে আর-এক বার ছোঁয়া।                    

শিরডী থেকে রওনা হলাম ১০টা নাগাদ। শিরডী থেকে কয়েক কিলোমিটার এসেই পড়লাম ‘হিন্দু হ্রুদয়সম্রাট (হৃদয়সম্রাট) বালসাহেব ঠাকরে মহারাষ্ট্র সম্রুদ্ধি (সমৃদ্ধি) মহামার্গ’-এ। নামে কি আসে যায়! এটা আদতে মুম্বই-নাগপুর হাইওয়ে। দুরন্ত গতিতে ছুটে চলল গাড়ি। বেশ খানিকটা গিয়ে বাঁ দিকের ‘একজিট’ দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ধরলাম ইলোরাগামী রাস্তা। ১১টা ২০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম প্রায় ১০০ কিমি দূরের ঘৃষ্ণেশ্বরে।        

সারা দেশে রয়েছে ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গ। তার মধ্যে পাঁচটি রয়েছে মহারাষ্ট্রে – ভিমাশঙ্কর, ত্র্যম্বকেশ্বর, ঘৃষ্ণেশ্বর, পার্লি বৈজনাথ এবং ঔনঢা নাগনাথ। তবে পার্লি বৈজনাথ এবং ঔনঢা নাগনাথ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই বলেন, পার্লি বৈজনাথ নয়, ঝাড়খণ্ডের বৈদ্যনাথ এবং ঔনঢা নাগনাথ নয়, দ্বারকার নাগনাথই জ্যোতির্লিঙ্গ। যাই হোক, ভিমাশঙ্কর আর ত্র্যম্বকেশ্বর‌ আগেই দর্শন হয়েছিল। আজ এসেছি ঘৃষ্ণেশ্বরে। ১৬ বছর আগে ইলোরায় এসে ঘৃষ্ণেশ্বর দর্শন হয়নি। একটা আপশোশ ছিল। এ বার সেই আপশোশ মিটেও মিটল না।

বাইরে থেকে তোলা ঘৃষ্ণেশ্বর মন্দিরের চুড়োর ছবি।

মন্দিরে বেশ ভিড়। এবং কিছুটা যেন অগোছালো। ত্র্যম্বকেশ্বর বা শিরডীতে দেখেছি, ভিড় যতই হোক, একটা শৃঙ্খলা থাকে। এখানে সব কিছুই যেন বিশৃঙ্খল। কতক্ষণ লাইনে দাঁড়াতে হবে, জানি না। মাকে ভিতরে নিয়ে গেলাম না। একটা আখের রসের দোকানে মাকে বসিয়ে আমি আর বাবা ভিতরে গেলাম। ভিতরে ঠাসা লাইন। একটু একটু করে এগোতে লাগলাম। দুই-তৃতীয়াংশ পথ অতিক্রম করেছিলাম। দর্শন বন্ধ হয়ে গেল। এখন আরতির সময়, তাই দুপুর ১টা পর্যন্ত দর্শন বন্ধ। আসলে দর্শন বন্ধ হয় না, কেউ পুজো দিতে চাইলে সেটা দেওয়া যায় না। কিন্তু যেহেতু দর্শন আর পুজোর লাইন এক, সেহেতু দর্শনও করা যায় না। কিন্তু মা তো বাইরে বসে। অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছি। শেষ পর্যন্ত মায়ের কথা চিন্তা করেই বেরিয়ে এলাম। শুধু আমরাই নয়, অনেকেই বেরিয়ে এলেন। মোবাইল নিয়ে মন্দিরে ঢোকা যায় না। তাই বাইরে থেকেই মন্দিরের ছবি তুললাম। পাশেই সিদ্ধেশ্বর শিবের মন্দির। দর্শন করলাম।

পায়ে হাঁটা দুরত্বে ইলোরা গুহা। টিকিট কেটে সোজা চলে এলাম ১৬ নম্বর গুহা, কৈলাশ মন্দিরে। এ এক অপার বিস্ময়! ১৭০০ বছর আগে দাক্ষিণাত্যের এক দল কারিগর কী ভাবে এই কাজ করতে পারে, সেটা ভাবতে গেলেই মাথাটা ঘুরে যায়! না, ওরা সাধারণ কারিগর নয়। ওরা জাদুকর। কোনো জাদুকরি না থাকলে কি একটামাত্র পাথর কেটে এই বিস্ময়কর মন্দিরটি তৈরি করা সম্ভব?

ইলোরার কৈলাশ মন্দিরের কথা তো ইতিহাস বইয়ে ছোটোবেলাতেই পড়েছি। কিন্তু এই গুহামন্দিরের বিস্ময়কর ব্যাপারটার সঙ্গে সঠিক ভাবে পরিচিত হয়েছিলাম ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’ পড়ে। ১৬ বছর আগে এখানে এসেই বুঝেছিলাম প্রফেসর শুভঙ্কর বোস (‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’র ইতিহাসবিদ) যে কথা বলেছিলেন, তা একশো ভাগ সত্যি। এই বিস্ময় একবার চোখে না দেখলে অনেক কিছু মিস হয়ে যায় জীবনে! আর একবারে সন্তুষ্টি হয় না, বারবার আসতে হয়। আজ আরও একবার এসে বুঝলাম, যত বারই একে দেখি না কেন, বিস্ময়ের ঘোর কাটবেই না!

কৈলাশ মন্দির।

ইলোরায় বেশির ভাগ পর্যটকই রাত কাটান না। কিন্তু ২০০৯ সালে প্রথম বার যখন এখানে এসেছিলাম, রাত কাটিয়েছিলাম সেই কৈলাশ হোটেলে, যে হোটেলে উঠেছিলেন ফেলুদা, জটায়ু, তোপসে এবং মি. চট্টরাজ ও জয়ন্ত মল্লিক। আজ যদিও শিরডী থেকে চলে এসেছি ইলোরা আরও একবার কৈলাশ মন্দির পুনরায় চাক্ষুষ করতে এবং আরও একবার ফেলুদার সেই কীর্তিকে ঝালিয়ে নিতে। ‘রাষ্ট্রপুট…’না না, রাষ্ট্রকূট রাজবংশের রাজা কৃষ্ণের আমলে অষ্টম শতাব্দীতে তৈরি এই কৈলাশ মন্দির যে কী অনন্য এক সৃষ্টি তা চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না।

চরণাদ্রি পাহাড়ে মোট একশোটা গুহা নিয়ে এই ইলোরার গুহাগুচ্ছের সৃষ্টি। হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মের বিভিন্ন নিদর্শন এই গুহাগুলিতে রয়েছে। তবে এর মধ্যে ৩৪টা গুহা সাধারণের জন্য খোলা। এর মধ্যে ১২টি বৌদ্ধ গুহা (১ থেকে ১২ নম্বর) ১৭টি হিন্দু গুহা (১৩ থেকে ২৯ নম্বর) এবং ৫টি জৈন গুহা (৩০ থেকে ৩৪ নম্বর)। সব থেকে আকর্ষণের বস্তু ১৬ নম্বর গুহাটি। এই ১৬ নম্বর গুহাই হল কৈলাশ মন্দির। এখান থেকেই শুরু হয় ইলোরার গুহাদর্শন। 

“জায়গাটা তিনশো ফুট লম্বা, দেড়শো ফুট চওড়া…মন্দিরের হাইট একশো ফুট…দু’ লক্ষ টন পাথর কেটে সরানো হয়েছিল…প্রথমে তিন দিকে পাথর কেটে খাদ তৈরি করে তার পর চূড়ো থেকে শুরু করে কাটতে কাটতে নেমে এসেছিল…দেবদেবী, মানুষ, জানোয়ার, রামায়ণ, মহাভারত, কিছুই বাদ নেই এখানে। ক্যালকুলেশনের কথাটা ভাব একবার।…শুধু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দিকটা দেখ…।” কৈলাশে ঢুকতেই মনে পড়ে গেল ফেলুদার কথাগুলো।

কৈলাশ মন্দির।

বিরাট একটা পাথর (আদতে পাহাড়) কত জনের হাতের গুণে একটা মন্দির হয়ে উঠেছে! কারা এই নাম-না-জানা শিল্পী? এই জাদুকরি শিল্পীদের হাতেই ফুটে উঠেছে ধ্বজস্তম্ভ, নন্দীমণ্ডপ, রামায়ণের প্যানেল। পাথরের গায়ে ফুটে উঠেছে হরপার্বতীর বিয়ের উৎসবমুহূর্ত-সহ আরও কত কী!

ইলোরা গুহারাজিতে কৈলাশ-সহ ১৭টা হিন্দুগুহা। বৌদ্ধগুহা ১২টা এবং ৫টা জৈনগুহা। বৌদ্ধগুহাগুলো বা পার্শ্বনাথের মন্দির-সহ খান পাঁচেক জৈনগুহার পরিবেশ আর সজ্জা একেবারে আলাদা। হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন ধর্ম এখানে মিলেমিশে একাকার। ইতিহাস, ধর্ম আর শিল্প এখানে পাথরের ভাঁজে ভাঁজে খোদিত।

আগের বার এখানে রাত্রিবাস করেছিলাম, তাই কয়েক ঘণ্টা ধরে সব ক’টা গুহা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। কিন্তু এ বার এখানে এসেছি কৈলাশ মন্দিরের টানে। কৈলাশ মন্দিরের দ্বিতীয় তলায় উঠে এই স্থাপত্যের দিকে তাকিয়ে থাকি, আর ভাবি কী ভাবে, কী করে এমন এক সৃষ্টি সম্ভব! ওপর থেকে পাহাড়কে কাটতে কাটতে নীচে এসেছিলেন কারিগররা, ক্রমশ ফুটে উঠছিল এই আশ্চর্য এক স্থাপত্য!

বেঁচে থাক এই অনন্য সৃষ্টি। আর এই সৃষ্টির মধ্যে দিয়েই মানুষের মনে বেঁচে থাকুক এর জাদুকরি শিল্পীরা। বেঁচে থাকুক আমার ভারতের এই ঐতিহ্যময় শিল্পকলা। গাড়ি যাত্রা শুরু করল শিরডীর‌ উদ্দেশে। তবুও ঘাড় ঘুরিয়ে বার বার দেখার চেষ্টা করি অপার বিস্ময়ের এই কৈলাশকে। (চলবে)

ছবি: লেখক

আরও পড়ুন

মরাঠাভূমে আবার: পর্ব ১

মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ২: মায়ের ইচ্ছাপূরণ

🔘 MakeMyTrip-এ এখনই হোটেল বুক করুন – ছাড় চলছে!

👉 বুক করতে এখানে ক্লিক করুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top