শ্রয়ণ সেন
“একটু সুস্থ হয়ে গেলে আমাকে শিরডী সাইবাবার দর্শনে নিয়ে যাবি?”
গত ডিসেম্বর-জানুয়ারির কথা। ৩৮ দিনের হাসপাতাল-যাপনের সময়ে বারবার এমন কথা বলত মা। মায়ের কথায়, সেই সময় ফেসবুকের নিউজ ফিডে খালি সাইবাবার ছবি দেখেছে। মায়ের বিশ্বাস, সাইবাবাই মাকে দ্রুত সুস্থ করেছেন, তাই মাকে শিরডি যেতেই হবে।
সেই দুর্ঘটনার প্রভাব মা প্রায় পুরোটা কাটিয়ে উঠলেও এখনও কিছু চিহ্ন রয়ে গিয়েছে। তাতেও মায়ের লং জার্নিতে কোনো অসুবিধা নেই বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন মাকে সুস্থ করে তোলা ডাক্তারবাবু, যিনি আমার কাছে দেবতাতুল্য।
এর পর শুরু হল পরিকল্পনা। অবশেষে মায়ের সেই ইচ্ছাপূরণের দিনটা এসে গেল। মাকে সাইবাবার দর্শন করাতে পারলাম। তবে পরিকল্পনার সময় এটা মাথাতেও ছিল না যে সাইবাবার দিন, বৃহস্পতিবারই মায়ের সাইদর্শন হবে।
সাইবাবা, এক যুগপুরুষ। যিনি ধর্ম, বর্ণের ভেদাভেদ মানতেন না। তাঁর কথা, ‘সবকা মালিক এক হ্যায়’ আজও প্রবাদপ্রতিম হয়ে রয়েছে। তাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মতো সাইবাবাও আমাদের বড্ড প্রিয় একজন মানুষ। তাঁর কাছে মাকে আনতে পেরে আমিও বড্ড তৃপ্তি পেয়েছি। নিঃসন্দেহে আমার জীবনের অন্যতম সেরা দিন আজ। সাইবাবার কাছে প্রার্থনা করি মা-বাবাকে সুস্থ রাখুন তিনি। তা হলে আমিও একদম ঠিক থাকব।
এক বছরের মধ্যেই আবার দর্শন পেলাম সাইবাবার। গত আগস্টে এসেছিলাম আমার ‘ট্রাভেলিজম’-এর গ্রুপ ট্যুরে। উদ্দেশ্য ছিল বর্ষায় মালশেজঘাট-ভান্ডারদারা দেখানো। সেই সঙ্গে কাছেই ‘রামায়ণ’খ্যাত নাসিক। আর এত দূর যখন আসব তখন শিরডীতে সাইবাবাকে দর্শন করে যাব না? এই পরিকল্পনায় এক বছর আগেই এসেছিলাম এই শিরডীতে।

সাইবাবার সমাধিমন্দিরের খুব কাছেই আমাদের আবাস এমটিডিসি-র শিরডী রিসর্ট। সামান্য হেঁটেই পৌঁছে যাওয়া যায় সমাধিমন্দিরের প্রবেশফটকে। রিসর্টের ঘরে মালপত্র রেখেই মা-বাবাকে নিয়ে চললাম সাইবাবার দর্শনে। এখানে আসার মুল উদ্দেশ্য মায়ের ইচ্ছাপূরণ। সুতরাং আগে সাইবাবাকে দর্শন, তার পরে অন্য কাজ। এখানে অবশ্য বিশেষ কিছু ঘোরাঘুরির নেই। সব কিছুই সাইবাবাকেন্দ্রিক।
মিনিটদুয়েক হেঁটে চলে এলাম সমাধিমন্দিরের চত্বরে। প্রবেশের অনেক ফটক। সর্বসাধারণের জন্য নিখরচায় যেমন দর্শনের ব্যবস্থা আছে, তেমনই ভিআইপি দর্শনের ব্যবস্থাও। সিনিয়র সিটিজেনদের জন্যও রয়েছে আলাদা প্রবেশফটক। আর নিয়ম হল, একজন সিনিয়র সিটিজেনের সঙ্গী হিসাবে যেতে পারেন তুলনায় কমবয়সি একজন। সুতরাং মা-বাবাকে নিয়ে ওই সিনিয়র সিটিজেনদের প্রবেশফটক দিয়ে আমার কোনো অসুবিধা হল না। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। এটা নাকি সাইবাবার দিন। তাই মন্দিরে বেশ ভিড় ছিল। তবে সেই ভিড় সুশৃঙ্খল। ভিতরে দীর্ঘ লাইন। কিন্তু হাওয়া চলাচলের উত্তম ব্যবস্থা থাকায় কোনো অসুবিধাই হল না। খুব ভালো ভাবে দর্শন হল সাইবাবার।
সাইবাবার প্রতি আমার বিশেষ প্রীতি রয়েছে, মূলত তাঁর দর্শনের জন্য। তিনি ছিলেন একাধারে যোগী ও ফকির। হিন্দু ও মুসলিম, দুটি সম্প্রদায়ের ভক্তরা তাঁকে সন্ত আখ্যায় ভূষিত করেন। ‘সাই’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ভাষা থেকে। এর অর্থ ‘সাক্ষাৎ ঈশ্বর’। তাঁর বিখ্যাত উক্তি ‘সবকা মালিক এক হ্যায়’ অর্থাৎ একই ঈশ্বর সকলকে শাসন করেন। তিনি সবসময় বলতেন ‘আল্লাহ মালিক’ অর্থাৎ ‘ঈশ্বরই রাজা’।
আমাদের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সাইবাবা সমসাময়িক। শ্রীরামকৃষ্ণের জন্ম এই বাংলায়, ১৮৩৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আর সাইবাবার জন্ম সুদূর মহারাষ্ট্রে। তাঁর জন্মের দিনক্ষণ নির্দিষ্ট ভাবে জানা না গেলেও, ১৮৩৫ সালের সেপ্টেম্বরই তাঁর জন্মসাল ও মাস বলে ধরে নেওয়া হয়। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে কালীভক্ত হলেও, তার কাছে সব ধর্মই ছিল সমান। তাঁর তত্ত্বই ছিল, ‘যত মত তত পথ, কিন্তু লক্ষ্য এক’। তিনি বলতেন, তোমার লক্ষ্য ছাদে ওঠা, সে তুমি যে ভাবেই ওঠো না-কেন! অর্থাৎ ঈশ্বরকে পাওয়াই তোমার লক্ষ্য, সে তুমি যে ভাবেই পাও না-কেন। একই ভাবে, সর্বধর্ম সমন্বয়ের বার্তা দিয়েছিলেন সাইবাবাও।

তাঁদের দর্শনেই যে শুধু মিল ছিল, তা নয়। আর–এক তথ্য জানলে অবাক হতে হয়। কথিত আছে, ১৮৮৬ সালের আগস্টে সাইবাবা সমাধিস্থ হন তিন দিনের জন্য। সেই সময়ে মৃত্যুশয্যায় শ্রীরামকৃষ্ণ। তিন দিন পরে সাইবাবা নিজের দেহে ফিরে আসেন, আর ঠাকুর চলে যান নশ্বর দেহ ছেড়ে। সাইবাবা নাকি ফিরে এসে বলেন, তিনি তো চিরদিনের জন্যই ঈশ্বরের কাছে চলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, জানতে পারেন, তাঁর বন্ধু শ্রীরামকৃষ্ণও যেতে চান ভগবানের কাছে। তাই তিনি ফিরে এলেন ধরাধামে। প্রসঙ্গত, এমনও শোনা যায় যে, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নাকি সাইবাবা সম্পর্কে বলতেন, এমনই এক ফকির এসেছেন পৃথিবীতে, যাঁকে হিন্দুরা পুজো করে ঈশ্বর হিসেবে আর মুসলমানরা করে পির হিসেবে।
যাই হোক, সাইবাবাকে দর্শন করে চলে এলাম ওই চত্বরেই দ্বারকামাই মসজিদে। ৬০ বছর ধরে এটাই ছিল সাইবাবার আবাস। যে পাথরের উপর বাবা বসে থাকতেন, সেই পাথর রয়েছে এইখানে। বাবা যে ‘ধুনি’ জ্বালিয়েছিলেন, তা আজও সমানে জ্বলছে। জীবনের যাত্রাপথ যাতে বাধাবিঘ্নহীন হয়, তার জন্য এই দ্বারকামাইয়ে বসে সাইবাবা ভক্তিদের হাতে ‘উদি’ (ভস্ম) দিতেন। ভক্ত ও দরিদ্র মানুষদের খাওয়ানোর জন্য বাবা নিজ হাতে রান্না করতেন। যে পাথর দিয়ে তিনি মশলা পেষাই করতেন, সেই পাথরও রয়েছে এই দ্বারকামাইয়ে।
দ্বারকামাইয়ের কাছেই আব্দুলবাবার থান। সাইবাবার অন্যতম ভক্ত ছিলেন আব্দুলবাবা। জীবনের শেষ কয়েকটা বছর এই কুটিরে কাটিয়েছিলেন তিনি। উল্টোদিকে সাইবাবার স্পর্শধন্য ‘চাওয়াডি’ – সাইবাবার সময়ে এটাই গ্রামের মানুষজনের জমায়েতের স্থান। গ্রামীণ সব কাজকর্ম এখানেই হত। একবার বর্ষাকালে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে দ্বারকামাইয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ল বাবার। ছাদ থেকে, চারদিকের দেওয়াল থেকে জল পড়ে সব জলময়। সাইবাবার ভক্তরা জোর করে বাবাকে নিয়ে চলে এলেন ‘চাওয়াডি’-তে। এর পর থেকেই বাবা প্রায় নিয়ম করে মাঝেমাঝেই ‘চাওয়াডি’-তে এসে থাকতেন। ‘চাওয়াডি’র কাছেই মারুতি মন্দির।

দুপুরে ও রাতের খাওয়া সারলাম এমটিডিসি-র শিরডী রিসর্টের উল্টোদিকে ‘মিনি পাঞ্জাব’ রেস্তোরাঁয়। একটা খাওয়া বা পান করার কথা না বললেই নয়। তা হল ২ টাকায় চা এবং ৩ টাকায় কফি। সাইবাবা সমাধিমন্দিরে চত্বরেই রয়েছে ‘শ্রী সাইবাবা সংস্থান ট্রাস্ট’ পরিচালিত ‘টি ক্যান্টিন’। কার্যত ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে এই ক্যান্টিন। মাত্র দেড় ঘণ্টা বন্ধ থাকে – ভোর পৌনে ৬টা থেকে সোয়া ৬টা, দুপুর পৌনে ২টো থেকে সোয়া ২টো এবং রাত পৌনে ১০টা থেকে সোয়া ১০টা। বেশ কয়েক বার চা-কফি খেলাম এই ক্যান্টিন থেকে। সারাটা দিন শিরডীতে ঘুরেফিরে, হাঁটাহাঁটি করে কেটে গেল। শিরডীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, কার্যত সারা রাত জেগে থাকে এই শহর। দোকানপাট, খাওয়ার জায়গা খোলা থাকে গভীর রাত পর্যন্ত। সারা রাতই জেগে থাকে সাইবাবার শিরডী। (চলবে)
ছবি: লেখক
আরও পড়ুন
মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ১: শুরুতেই বিপত্তি
🔘 MakeMyTrip-এ এখনই হোটেল বুক করুন – ছাড় চলছে!
👉 বুক করতে এখানে ক্লিক করুন