শ্রয়ণ সেন
শুরুতেই বিপত্তি
আশঙ্কাটা গোড়া থেকেই ছিল। কারণ যাত্রাপথ দক্ষিণপূর্ব রেল ধরে। আর গত কয়েক মাস ধরে ট্রেন চলাচলে বেলাগাম অনিয়মে রীতিমতো ‘সুনাম’ কুড়িয়েছে ভারতীয় রেলের এই জোন। তাই সব সময়েই চিন্তা, ঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছোতে পারব তো!
আমাদের প্রথম গন্তব্য শিরডী, সাইবাবার শিরডী। নাসিক রোড স্টেশনে নেমে ৯৫ কিমি সড়কপথে। হাওড়া থেকে সরাসরিও শিরডী আসা যায়, তবে সেই ট্রেন সপ্তাহে একদিনই চলে। আর মাঝেমাঝে বাতিলও হয়। তাই নাসিক রোড স্টেশনে নেমে শিরডী যাওয়ার পরিকল্পনা। আর যে ট্রেনে টিকিট কেটেছি, সেই হাওড়া-মুম্বই মেল (ভায়া নাগপুর) মোটামুটি নির্বিঘ্নেই চলে। ট্রেন ছাড়ে হাওড়া থেকে সন্ধে সাড়ে সাতটায়। নাসিক রোড স্টেশনে পৌঁছোয় পরের দিন রাত ১২টায়। রাত কাটানোর জন্য নাসিক রোড স্টেশনে এসি রিটায়ারিং রুম বুক করে রেখেছি আমাদের তিনজনের জন্য। আমরা রওনা হব ৩ তারিখে। তার কয়েক দিন আগে থেকেই ট্রেনের স্টেটাস দেখছিলাম। মোটামুটি সময় মেনেই চলছে ট্রেন। তাই আশঙ্কা থাকলেও কিছুটা নিশ্চিন্ততাও ছিল।

ঠিক সময়েই পৌঁছে গেলাম হাওড়া স্টেশনের নতুন অংশে। তবে নামেই নতুন। এই নতুনও পুরোনো হয়ে গেছে দীর্ঘদিন। এখান থেকেই দক্ষিণপূর্ব রেলের দূরপাল্লার ট্রেনগুলো ছাড়ে। মুম্বই মেল সাধারণত ছাড়ে ২১ নং প্ল্যাটফর্ম থেকে। স্টেশনে পৌঁছেই ধাক্কা। ট্রেনের ডিসপ্লে বোর্ডে দেখাচ্ছে, মুম্বই মেল রিশিডিউলড্ করা হয়েছে। সন্ধে সাড়ে ৭টার পরিবর্তে রাত সাড়ে ন’টায় ছাড়বে। এইরে! গোড়াতেই বিপত্তি। যাকগে, কী আর করার! নজরে পড়ে গেল, এসি এগজিকিউটিভ লাউঞ্জটা। হাওড়া স্টেশনে এরকম একটা লাউঞ্জ আছে, জানা ছিল না। ২২ নং প্ল্যাটফর্মের পিছনেই সেই লাউঞ্জ। মাথাপিছু প্রতিঘণ্টা ৫০ টাকা। দু’ ঘণ্টার জন্য বুক করে তিনজনে ঢুকে পড়লাম সেখানে। এসি লাউঞ্জেও ট্রেনের ডিসপ্লে বোর্ড আছে। আমাদের নজর সেই দিকে। ন’টা বাজতে চলল। কোন প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দেবে, তার কোনো নির্দেশিকা নেই। আমাদের বুকিং ন’টা পর্যন্ত। অগত্যা এসি লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে আন্দাজেই ২১ নং প্ল্যাটফর্মের ধারে একটা জায়গা বসে ট্রেনের ঘোষণার অপেক্ষায় থাকলাম।
আমি জানতাম, সাড়ে ৯টায় রিশিডিউলড্ করেছে মানেই যে ওই সময়ে ছাড়বে, তার কথা নেই। বাবা-মাকে সে কথাই বারবার বলছিলাম। যে ট্রেন সাড়ে ৯টায় ছাড়বে, সেই ট্রেন তো অন্তত আধ ঘণ্টা আগে প্ল্যাটফর্মে দেবে। সাড়ে ৯টা তো বাজতে চলল। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দেওয়া তো দূরের কথা, কোনো ঘোষণাই নেই। অবশেষে ঘোষণা হল, সাঁতরাগাছিতে রেক রেডি না হওয়ায় ট্রেন ছাড়তে কিছু দেরি হচ্ছে। এ কথা বলতে লজ্জাও হল না রেলের। রেল কর্তৃপক্ষের কত বড়ো গাফিলতি আর তার খেসারত দিচ্ছে সাধারণ যাত্রীরা। তখনও বুঝিনি, এ তো সবে কলির সন্ধে।
শেষ পর্যন্ত পৌনে ১১টা নাগাদ খালি রেক এল ২১-এই। আর সেই সময়েই নামল তেড়ে বৃষ্টি। ২১ নম্বর প্ল্যাটফর্মের যেখানে আমরা অপেক্ষা করছিলাম, সেখানে কোনো শেড ছিল না। ভাগ্যিস, বৃষ্টিটা আগে নামেনি! নইলে ভিজে একশা হতাম। তিনটে ছাতাই তো সুটকেসে। ট্রেনের ঘোষণা শুনে প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁটা দিতেই বৃষ্টি নামল। মাথা বাঁচল বটে, কিন্তু দুরন্ত বৃষ্টির প্রবল ছাটে অনেকটাই ভিজে গেলাম।
যা-ই হোক, রাত সাড়ে ১১টায় ট্রেন ছাড়ল। সাড়ে চার ঘণ্টা লেটে। রাতে ঘুমটা ভালোই হয়েছিল। তাই বুঝতে পারিনি, ট্রেন কেমন ছুটছে। সকাল হতেই মালুম হল। সবে চক্রধরপুর পেরোচ্ছে। আর চক্রধরপুর ও বিলাসপুরের মাঝখানে ট্রেন এমন ঢিকিঢিকি করে গেল যে একটা অতি ধীর গতির প্যাসেঞ্জার ট্রেনও তা দেখে উল্লাসে ফেটে পড়বে। অবশেষে মুম্বই মেল হাওড়া থেকে ৭০০ কিমি দূরের বিলাসপুরে পৌঁছোল দুপুর আড়াইটা নাগাদ, ৭ ঘণ্টা লেট করল। আরও প্রায় ১১০০ কিমি দূরের নাসিক যেতে ওই ট্রেন সময় নিল নির্ধারিত সময়ের থেকে দু’ ঘণ্টা বেশি। অর্থাৎ মোট লেট ৯ ঘণ্টা। যে সময়ে আমরা মহারাষ্ট্র ভ্রমণে চলেছি, ঠিক সেই সময়েই ভারতের সবচেয়ে বেশি বিক্রীত বাংলা সংবাদপত্রে দক্ষিণপূর্ব রেলে ট্রেন চলাচলে বিলম্ব নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে ওই জোনের আধিকারিকদের বক্তব্য ছিল, অন্য জোনের জন্য তাদের ট্রেন চলাচলে বিলম্ব হচ্ছে। আমাদের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, তাঁদের এই যুক্তি ভিত্তিহীন। নিজেদের জোনে ৭ ঘণ্টা লেট, আর অন্য জোনে ২ ঘণ্টা। দোষটা কার? নাসিকের ১০ কিমি আগে একটা স্টেশনে আমাদের ট্রেন দাঁড় করিয়ে চারটি ট্রেন পাশ করাল। তার মধ্যে একটা ছিল হাওড়া-মুম্বই মেল ভায়া এলাহাবাদ। পূর্ব রেলের ট্রেন। সেই ট্রেন রাইট টাইমে ছিল, রাইট টাইমেই আমাদের ট্রেনকে পেরিয়ে গেল। কই, অন্য জোন তো পূর্ব রেলের ট্রেনকে লেট করাল না। যত রাগ তাদের দক্ষিণ পূর্ব রেলের ওপর নাকি!

আমাদের নাসিকে পৌঁছোনোর কথা ছিল রাত ১২টায়। অবশেষে পৌঁছোলাম পরের দিন সকাল ৯টায়। আগেই বলেছি। আমাদের রাত কাটানোর জন্য নাসিক রোড স্টেশনে এসি ওয়েটিং রুম বুক করা ছিল। সকালে ফোন করে ওরা জানাল, টাকা রিফান্ড করা যাবে না। কী অদ্ভুত ব্যবস্থা! তারা জানল, কেন আমরা আসতে পারছি না। রেলেরই গাফিলতিতে আমরা স্টেশনের ওয়েটিং রুমে যেতে পারলাম না। আর তারা বেমালুম টাকা মেরে দিল। ইচ্ছা করলেই তারা চেক করতে পারত, আমরা মিথ্যে কথা বলছি কি না। কারণ আমাদের নামেই ট্রেনের টিকিট আর আমাদের নামেই বুকিং। দোষ রেল কর্তৃপক্ষের, আর গুনাগার দিলাম আমরা।

এই নিয়ে বারতিনেক আসা হল নাসিকে। তাই জায়গাটা খুব একটা অপরিচিত নয়। স্টেশন থেকে বেরিয়ে হোটেল রামকৃষ্ণ এবং ভগত আহার ভবন। বছরখানেক আগে এই ভগত আহার ভবনে প্রাতরাশ সারতে গিয়ে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আর মা সারদার ছবি দেখেছিলাম। আর পাশেই রামকৃষ্ণের নামে হোটেল। এ বার সেই হোটেল রামকৃষ্ণে প্রাতরাশ সারলাম মরাঠি পদ বড়া পাও দিয়ে। আর এই দুটি হোটেলেই কর্মীরা সবাই বাঙালি। তাই আরও ভালো লাগে এখানেই খাওয়াদাওয়া সারতে। গাড়ি আগে থেকে ঠিক করা আছে। সারথি বললেন, অম্বেডকরের স্ট্যাচুর কাছে চলে আসতে। আমরা ওইখানে পৌঁছে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চলে এল গাড়ি। সারথি আমার চেয়ে মনে হয় বয়সে ছোটোই হবে। আলাপ হল। নাম, বাদল সুমরাও। শিরডীল পথে যেতে যেতেই আলাপ আরও জমে উঠল। বুঝলাম, যে ট্রাভেল কোম্পানির সঙ্গে আমি যোগাযোগ করেছি, তারই অন্যতম মালিক বাদল। কথাবার্তা, আচার-আচরণে বেশ ভদ্র, নম্র। পৌনে ১২টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম শিরডীতে। আপাতত শিরডীতে আমাদের দু’ দিনের ঠিকানা — শিরডী রিসর্ট, এমটিডিসি।