হাওড়া থেকে গোয়া যাওয়ার একমাত্র ট্রেন ১৮০৪৭ অমরাবতী একপ্রেস। রাত সাড়ে ১১টায় ছাড়ার কথা, বাস্তবে ছাড়ল আরও ১৫ মিনিট পরে। আমরা সাড়ে সাত জন চলেছি গোয়ার উদ্দেশে – আমি, স্ত্রী মৌসুমি ও চার বছরের ছেলে রূপ; সঙ্গে আমাদের দুই বন্ধু-পরিবার – সৈকত মল্লিক ও তার স্ত্রী সুলতা, সুকুমার বিশ্বাস ও তার স্ত্রী পলি আর ছেলে সুপ্রিয়, সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়া। সৈকত-সুলতার তো এটা মধুচন্দ্রিমা ট্যুর বলা যায়। ওদের দাম্পত্যজীবনের বয়স এখনও এক বছর হয়নি।
দীর্ঘ আট মাসেরও বেশি সময় ধরে নানাবিধ প্রস্তুতির পর আজ যাত্রা শুরু। আনন্দের সীমা নেই। কিন্তু রেল দফতর এই আনন্দের মাঝে একটা যন্ত্রণা দিয়ে দিল। একে তো মনে হচ্ছে ভারতীয় রেলের সব থেকে বাজে বগিগুলো বাছাই করে এনে জুড়ে জুড়ে এই ট্রেনটা বানানো হয়েছে। জং ধরা, রং চটা, প্রায় ভাঙাচোরা বগি। তার উপর ট্রেনের সমস্ত ওয়েটিং-লিস্ট প্যাসেঞ্জার উঠেছেন। টিটির কাছ থেকে জেনেছিলাম ৬৫০ জন ওয়েটিং-লিস্ট প্যাসেঞ্জার এই ট্রেনে যাচ্ছেন এবং এঁরা সবাই বৈধ যাত্রী।
ট্রেন ছাড়ার পরেই রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। খড়গপুর আসার আগেই বার্থ ফেলে সবই চিৎপাত। বাথরুমের সামনে, মেঝেতে, চলাচলের রাস্তা, যেখানে যা জায়গা ছিল, সব জায়গা চলে গেল ওয়েটিং-লিস্ট প্যাসেঞ্জারদের দখলে। কিন্তু এঁরা সব ক্ষেত্রেই ওয়েটিং, টিকিটেও, ঘুমোনোতেও। রেল এঁদের থেকে কিছু কম টাকা নেয়নি। কিন্তু এঁদের দুর্ভোগ আমাদের চেয়েও বেশি।
সকালে উঠে সবাই যে যার সিটে। ওয়েটিং-লিস্ট প্যাসেঞ্জাররাও মেঝেতে বসে। এ ভাবেই চলল সারা দিন। একটু বেলায় ভারতের সব থেকে বড়ো নোনা জলের হ্রদ চিল্কাকে বাই বাই করলাম। ডান দিক, বাঁ দিকে পূর্বঘাট পর্বতমালার প্রতিনিধিরা আমাদের টা টা করছে দেখতে পাচ্ছি।
সকালের প্রাতরাশ হল বাড়ি থেকে আনা কলা আর জেলি সহযোগে পাউরুটি দিয়ে। দুপুরের খাওয়া সারলাম বিশাখাপত্তনমে। এ বার এক টিপ ঘুম। আর কোন ফাঁকে পালিয়ে গেল গোদাবরী। কী করা যাবে! আমার কাছে বোধহয় মুখ দেখাতে চায় না। সকালে চিল্কা দেখার ঘণ্টা দেড়েক পরেই ওড়িশা পেরিয়ে অন্ধ্রপ্রদেশে ঢুকেছিলাম। এখন সেই অন্ধ্রপ্রদেশের উপর দিয়ে চলেছি। কাল ভোর পর্যন্ত চলবে অন্ধ্র। তার পর প্রবেশ কর্নাটকে।
মাঠ-ঘাট, বাড়ি-গাছপালা, দেখতে দেখতে চলেছি। তালগাছের আধিক্য। বাড়ির উপরতলায় ওঠার সিঁড়িগুলো বাইরের দিকে। মন্দিরের চূড়ার ধরন তো কখন পালটে গেছে।
দুর্বার গতিতে ট্রেন চলেছে। ভয় হচ্ছে এই আধভাঙা কামরার ছাদ উড়ে গিয়ে কামরাটা হুডখোলা না হয়ে যায়। ট্রেনে তো জল রাখার জায়গা, খাবার রাখার ট্রে, পত্রিকা রাখার নেট, নাইট ল্যাম্প কিছুই নেই। দাঁত বারকরা কামরায় মোবাইল চার্জের প্লাগটা কী করে থাকল সেটা নিয়ে গবেষণা চলতে পারে।
সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে আনা চালভাজা, ছোলা, বাদাম, চানাচুর, পিঁয়াজ, লঙ্কা দিয়ে মেখে শশা কামড়ে আয়েশ করে খাওয়া হল। সাতটায় একজন ভেন্ডার এসে রাতের খাবারের অর্ডার নিয়ে গেল। রাত আটটায় খাবার দেবে। কিন্তু অপেক্ষাই সার। খাবার এল না। কিছু কলা, পাউরুটি-জেলি ছিল, ছিল কিছুটা চালভাজাও, তা-ই দিয়ে ম্যানেজ হল রাতের খাবার। আর ধিক্কার জানালাম তাদের, যারা খাবারের অর্ডার নিয়ে গিয়েও অবিবেচকের কাজ করল।
রাতে শোয়ার সময় এক বিপত্তি। একদল ছাত্র কলেজ ট্যুরে বেরিয়ে ট্রেনে বসেই মদ খাচ্ছে। আর তালজ্ঞান হারিয়ে চিৎকার করে কোরাসে গান ধরেছে। তাদের গান থামানোর অনুরোধ করতে সমবেত সংগীত বন্ধ করল। কিছু ক্ষণ পরে তাদেরই একজন মদের ঘোরে হঠাৎ রফি হয়ে উঠল। মহাজ্বালা! অনুরোধ করতে অবশ্য কথা রাখল। আর বিরক্ত করেনি।
ঝরঝরে সকাল। জানলার বাইরে তাকিয়ে আমার চক্ষু স্থির। অন্ধ্র শেষ, চলেছি কর্নাটকের বুক চিরে। সুন্দরী কর্নাটক! সামনে বাবলাঝাড়। তার পরেই ভুট্টা বা অন্য কোনো শস্যের খেত। সেই খেতকে পাঁচিলের মতো বেষ্টন করে আছে পশ্চিমঘাট পর্বতের সদস্যরা। কোনো পাহাড় রুক্ষ লাল, তো কোনোটা আবার গাছপালায় সবুজ। কোনো কোনো পাহাড় আবার পান্না-সবুজ ঘাসে মোড়া, যেন গালিচা দিয়ে মুড়ে রেখেছে কেউ পাহাড়টাকে। কোথাও কোথাও খেতের মধ্যে হরিণের ঘোরাফেরাও চোখে পড়ল।
হুবলি এলাম। এখানে আরও একটা ইঞ্জিন লাগানো হবে ট্রেনের সঙ্গে। ট্রেনের পথ এ বার পাহাড়ি, তাই এই ব্যবস্থা। নেমে পড়লাম ট্রেন থেকে। সুকুমারদাকে নিয়ে এগোলাম। পরিচ্ছন্ন, সুন্দর প্ল্যাটফর্ম। স্টিলের ঝকঝকে ডাস্টবিন। এতই পরিষ্কার যে তাতে আবর্জনা ফেলতে মায়া হয়। গুটখার দাগ? না চোখে পড়েনি। এখানকার মানুষেরা কি পান-গুটখা খায় না?
সিগন্যাল সবুজ হতেই ট্রেন ছাড়ল। দেখলাম সুলতা আমার জায়গা দখল করে নিয়েছে। জায়গা নিয়ে ওর সঙ্গে একটু খুনসুটি হল। ওকে স্থানচ্যুত করলাম। কিছুক্ষণ পরেই যে দুধসাগর জলপ্রপাত আসবে। এই সময় এই জায়গা ছাড়া যাবে না।
আন্ডা-বিরিয়ানি উঠেছিল। তা দিয়ে ব্রেকফাস্ট ও লাঞ্চ সেরে ফেললাম এক সঙ্গে। সে যা জিনিস! ভাতের মধ্যে একটু তেল আর হলুদ রং মিশিয়ে দিয়ে বিরিয়ানি!
বেলা ১২টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম ক্যাসেল রক স্টেশনে। শুনলাম এখানকার জল নাকি খুব ভালো, ঠান্ডা আর হজমি। মিনারেল ওয়াটারকে হার মানায়। সুকুমারদাকে নিয়ে বোতলে জল ভরে নিলাম। মন উত্তেজনায় ভরপুর। আর একটু বাদেই দেখতে পাব দুধসাগর ফলস। যা দেখার জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে আছি কত দিন থেকে।
ট্রেন চলেছে মন্থর গতিতে। হঠাৎ দূর থেকে একটা ঝলক…। উল্লাসে চিৎকার করে উঠলাম। আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড, আর তার পরই… । সবাইকে ক্যামেরা নিয়ে রেডি হতে বললাম। সবাই প্রস্তুত। সবাই আগ্রহ ভরে ট্রেনের বাঁ দিকের জানলায় তাকিয়ে আছে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। ধীরে ধীরে সামনে থেকে হাজির হল সুবিশাল দুধসাগর। অপূর্ব! অসাধারণ! জানি, এ সব বিশেষণও ফিকে এর রূপের কাছে। সবাই উল্লাসে চিৎকার করে উঠল। সেই সঙ্গে ক্যামেরার খচাখচ শব্দ।
ভারতের উচ্চতম জলপ্রপাত কে? এই প্রশ্ন নিয়ে গুগল জ্যাঠার সামনে হাজির হলে সে বেশ কিছু নাম দেখিয়ে দেবে। তাই সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। তবে ৩১০ মিটার (১০১৭ ফুট) উঁচু এবং প্রায় ৩০ মিটার চওড়া এই জলপ্রপাত যে উচ্চতার দিক থেকে ভারতের প্রথম পাঁচটি জলপ্রপাতের অন্যতম তাতে সন্দেহ নেই। প্রচণ্ড গতিতে উপর থেকে গ্যালন গ্যালন জল নিয়ে নীচে নেমে আসছে। ফেনায় জল সাদা দুধের মতো দেখতে লাগছে। সার্থক এই নাম। মোট চারটে ধাপ এই জলধারার।
ট্রেন থেকে মাত্র কয়েক সেকেন্ড একে সামনে পাওয়া যায়। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়েই মনে হচ্ছে যেন সম্মোহিত হয়ে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি ফোটো তোলায় মন দিলাম। ভালো করে দেখতে গেলে ফটো তোলা হয় না, আবার ফটো তুলতে গেলে প্রাণভরে দেখা হয় না।
কিছু ক্ষণের মধ্যেই দুধসাগর চোখের আড়ালে চলে গেল। দৌড়ে চলে এলাম ট্রেনের ডান দিকের দরজার কাছে। খানিক বাদে বেশ কিছুটা দূরে আবার দৃশ্যমান হল দুধসাগর। এ বার পূর্ণ অবয়বে দৃষ্টিগোচর হল। আবার শুরু হল ফোটো তোলা। বেশ কয়েক মিনিট ধরে বারে বারে সে আমাদের সামনে আসতে লাগল। প্রতি বারেই বেশ কিছুটা করে পিছিয়ে যাচ্ছে। এক সময় পশ্চিমঘাট পর্বতের কোলে ভগবান মহাবীর অভয়ারণ্যের মধ্যে আত্মগোপন করল সে।
কর্নাটক ও গোয়ার সীমানায় দুধসাগর। যদিও আদত অবস্থান গোয়া রাজ্যেই, ২৪০ বর্গ কিমি আয়তনবিশিষ্ট জঙ্গলে। নাম, ভগবান মহাবীর ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি। আগে নাম ছিল মোলেম গেম স্যাংচুয়ারি। ১৯৬৯ সালে এই জঙ্গলকে অভয়ারণ্যের মর্যাদা দিয়ে নাম দেওয়া হয় ভগবান মহাবীর ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি। ৭২২ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে এখানে। জীবজন্তুও কম নেই। ব্ল্যাক প্যান্থার, বার্কিং ডিয়ার, বাঘ, লেপার্ড, বিভিন্ন ধরনের বানর, উড়ন্ত কাঠবিড়ালি, গাউর, মালাবার জায়েন্ট স্কুইরেল, মাউস ডিয়ার, প্যাঙ্গোলিন, সম্বর, স্পটেড ডিয়ার, বুনো কুকুর, আরও কত কী! স্বাভাবিক ভাবেই পাখিরাও কম যায় না। সরীসৃপের মধ্যে সাপই প্রধান। তালিকা শুনলে বুকের রক্ত জল হয়ে যাবে। তাই আর নাই বা দিলাম! কীটপতঙ্গের কথা না হয় বাদ দিলাম।
এমন একটা দুর্ধর্ষ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি। সুলতাকে জানলার ধার অনেক ক্ষণ আগেই ছেড়ে দিয়েছি। এখন আমি দরজায় দাঁড়িয়ে জঙ্গলের রূপ দু’ চোখ দিয়ে পান করছি। ট্রেন মাঝে মাঝে টানেলের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। অন্ধকার গ্রাস করছে তখন।
এক সময় জঙ্গল, টানেল শেষ হল। সাড়ে তিনটে নাগাদ মাডগাঁও পৌঁছলাম। ট্রেন মাত্র দেড় ঘন্টা লেট! ছ’ কিমি দূরের কোলভা বিচে কোলমার বিচ রিসর্টে পৌঁছোতে কোনো অসুবিধা হল না। (চলবে)