![](https://www.bhramononline.com/wp-content/uploads/2018/08/shrayan-sen-1.jpg)
ঈশ্বরের কী দান! পালমপুর ঢোকার আগে থেকে ঠিক এটাই ভেবে যাচ্ছিলাম। প্রকৃতির রূপ যে তুলনাহীন।
গোটা অঞ্চলের উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে চার-সাড়ে চার হাজার ফুট হবে। কিন্তু সম্পূর্ণ সমতল। সামনেই বরফমাখা ধৌলাধার। অঞ্চলের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়েছে ব্রিটিশ আমলের চা বাগান।
এই হল সংক্ষিপ্ত রূপে পালমপুর।
আরও পড়ুন শীতের হিমাচলে ১ / যাত্রা শুরু বিলাসপুরে
সকালে বিলাসপুর থেকে যখন রওনা হলাম, গাঢ় কুয়াশায় ঢেকে রয়েছে চার দিক। এই কুয়াশা ভেদ করে বেশ কিছুটা যাওয়ার পরেই হঠাৎ করে সে গায়েব হয়ে গেল। চারিদিক রোদে ঝকমক করছে। বিলাসপুর থেকে পালমপুরের সোজা রাস্তা আমরা ধরিনি। মদনলালজির কথামতো জ্বালামুখী ঘুরে পালমপুর যাব। হিমাচলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান এবং ভারতের অন্যতম সতীপীঠ, জ্বালামুখীর জ্বালাজি মন্দির।
বিলাসপুর থেকে জ্বালামুখীর দূরত্ব একশো কিলোমিটার। যখন পৌঁছোলাম তখন প্রায় সাড়ে বারোটা। পার্কিং-এ গাড়ি রেখে বেশ কিছুটা খাড়াই ভেঙে তার পর মন্দির পৌঁছোতে হয়। সেই খাড়াই ভাঙা আপনি নিজের পায়ের ভরসাতেও করতে পারেন, আবার অটোতেও। আমরা অটোর ওপরেই ভরসা রাখলাম। সে আমাদের মন্দিরের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিল।
![](https://www.bhramononline.com/wp-content/uploads/2020/12/himachal-in-winter-2-jwalaji-26.12-1-1.jpg)
জ্বালামুখী মন্দিরের সব থেকে অত্যাশ্চর্য ব্যাপারটির কথা বলে রাখি। যেটা দেখার জন্য এত দূর ছুটে এসেছি। এই মন্দিরে ৭টি আগুনের শিখা দেখা যায় যেগুলি আজ পর্যন্ত কখনও নিভে যায়নি। কখনও কখনও শিখাগুলির সংখ্যা বেড়ে হয় ৯টি। ভক্তদের বিশ্বাস, শিখাগুলি মা ভগবতীর সাত বোনের বহিঃপ্রকাশ। কেউ আবার বলেন, শিখাগুলি আসলে মা দুর্গার ন’টি অবতারের প্রতীক। ভক্তদের ব্যাখ্যা যা-ই হোক, ঘটনা হল, এই শিখাগুলি জ্বলছে স্মরণাতীত কাল থেকে। এমনকি, কিংবদন্তি অনুসারে, সম্রাট আকবর নাকি একবার এই অগ্নিশিখাগুলি নেভানোর অনেক চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তিনিও ব্যর্থ হন।
এই আগুনের উৎস সন্ধান করতে জওহরলাল নেহরুর নির্দেশে একদল বিজ্ঞানী আশেপাশে পাহাড়গুলোর ওপরে পরীক্ষানিরীক্ষা চালালেও, তাঁরাও ব্যর্থ। জ্বালামুখীতে আসার অন্যতম কারণ ছিল এই আগুন দেখা। কিন্তু বিধি বাম। ২৫ ডিসেম্বর হওয়াতে মন্দিরে অসম্ভব ভিড়। এই ভিড় ঠেলে মন্দির ঢুকলে পালমপুর পৌঁছোতে আমাদের রাত হয়ে যাবে। তাই চাতাল থেকে মন্দির দর্শন করে, দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে পালমপুরের পথ ধরলাম।
জ্বালামুখী ছাড়ার কিছু পরে রাস্তা ক্রমশ পাহাড়ে উঠতে শুরু করল। সমুদ্রতল থেকে খুব বেশি হলে হাজার ফুট উচ্চতায় জ্বালামুখী। অন্য দিকে পালমপুরের উচ্চতা সাড়ে চার হাজার ফুট। পালমপুরের দিকে যত এগোচ্ছি, তত এগিয়ে আসছে তুষারাবৃত ধৌলাধারের শ্রেণি। পালমপুর যখন পৌঁছোলাম, মনে হল ধৌলাধার যেন কড়া নজরে রেখেছে এই শহরকে। বড়ো অথচ ছিমছাম একটা শহর। চা বাগিচার মধ্যে দিয়ে ছুটে চলল গাড়ি। হোটেলে যখন পৌঁছোলাম তখন বেলা পড়ন্ত।
![](https://www.bhramononline.com/wp-content/uploads/2020/12/himachal-in-winter-2-dhauladhar-1-26.12-1-1.jpg)
শীতের হিমাচলে সকালটা বড্ড দেরিতে হয়। ৭টার আগে আলো ফোটেই না। যা-ই হোক, আলো যখন ফুটল এক ছুট্টে চলে গেলাম হোটেলের লনে। বাঁদরের উপদ্রব অগ্রাহ্য করেই দেখতে থাকলাম ধৌলাধারের রঙ বদল। প্রথমে লাল, তার পর হলুদ এবং অবশেষে সাদা। অসাধারণ দৃশ্য!
সাড়ে চার হাজার ফুটের ওপরেও দিগন্ত বিস্তৃত সমতল অঞ্চল পেয়েই চা বাগান শুরু করেছিল ব্রিটিশরা। আমাদের হোটেলটা সেই চা-বাগানের মধ্যেই। সূর্যোদয়ের পরে কিছুটা হাঁটাহাঁটি করে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করলাম পালমপুরের সঙ্গে। হেঁটে চলেছি চা বাগানের মধ্যে দিয়ে, সামনে ধৌলাধার যেন ডাকছে। তার ডাক উপেক্ষা করার ইচ্ছে না থাকলেও করতে হল। কারণ এখন যে সাইটসিয়িং-এ বেরোতে হবে।
প্রথম গন্তব্য নেউগাল খাদ। পালমপুর শহরের সব থেকে নিকটতম পিকনিক স্পট নেউগাল খাদ। এটাকে গর্জ বলা চলে। বয়ে চলেছে বান্ডলা নদী, উলটো দিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুউচ্চ ধৌলাধার। রয়েছে একটি ঝুলন্ত ব্রিজ। সেই ব্রিজে দাঁড়িয়ে ক্যামেরাবন্দি করা নেওয়া ধৌলাধারকে। চারিদিকের সৌন্দর্য অতুলনীয়।
![](https://www.bhramononline.com/wp-content/uploads/2020/12/himachal-in-winter-2-neugal-26.12-1-1.jpg)
এর পর আমরা এলাম বৈজনাথে। ৮০৪ সালে গড়া দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম বৈদ্যনাথ, নামান্তরে বৈজনাথ। তবে জ্যোতির্লিঙ্গের মর্যাদার ব্যাপারে দেওঘরের বৈদ্যনাথ মন্দিরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব রয়েছে বৈজনাথের। দু’পক্ষই দাবি করে জ্যোতির্লিঙ্গ তারাই, অন্যটা নয়। তবে দ্বন্দ যা-ই থাক পারিপার্শ্বিক প্রকৃতি নিয়ে এই মন্দির সত্যিই নজর কাড়ে।
![](https://www.bhramononline.com/wp-content/uploads/2020/12/himachal-in-winter-baijnath-26.12-1-1.jpg)
মন্দির চত্বর থেকে দেখা যাচ্ছে তুষারধবল ধৌলাধার। নীচে দিয়ে বয়ে চলেছে একটি নদী, নাম বিনয়া। নাগরি শৈলীর মন্দিরে ওড়িশার আদল স্পষ্ট। তবে এই মন্দিরের যে ব্যাপারটা সব থেকে মন কাড়ল, তা হল এখানকার শান্ত পরিবেশ। বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে ফিরে চলা। এ বার আমাদের গন্তব্য চামুণ্ডা মন্দির, তবে পথে দেখে নেব পালমপুর স্টেশন।
পালমপুরের খ্যাতি রয়েছে তার রেল স্টেশনের জন্য। পাঠানকোট-যোগীন্দরনগর রেল লাইনের গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন পালমপুর। ব্রিটিশ আমলের এই রেল স্টেশন দেখার আগ্রহ ছিল অনেক দিনের। সে আশা পূর্ণ হল।
আমাদের ঘুম হোক বা শিমলা, উটি হোক বা পালমপুর, পাহাড়ি রেল স্টেশন মানেই ব্রিটিশ আমলের ছাপ স্পষ্ট। স্টেশনের বাড়িগুলোকে দেখলেই বোঝা যায়। স্টেশনের টিকিট কাউন্টার থেকে বেশ কয়েক ধাপ নীচে নেমে প্ল্যাটফর্ম। আপাতত এখন কোনো ট্রেন নেই, তাই স্টেশনটা যেন ঘুমোচ্ছে। প্ল্যাটফর্মে অনেক মানুষই রয়েছে কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো ব্যস্ততা নেই। কাংড়া উপত্যকার বাকি জায়গাগুলোর মতোই এখানকার ইউএসপিও সেই ধৌলাধার। রেললাইনের ওপরেই উঁকি মারছে সে। খুব ইচ্ছে ছিল কাংড়ার এই রেলে একটু সফর করার, কিন্তু এত ব্যস্ত ভ্রমণের মধ্যে সেই সময় বার করা সম্ভব নয়। অগত্যা গাড়িতে উঠে পড়া।
![](https://www.bhramononline.com/wp-content/uploads/2020/12/himachal-in-winter-2-palampur-26.12-1-1.jpg)
মনোরম পাহাড়ি পরিবেশে বানগঙ্গা নদীর ধারে অবস্থিত ৯০০ বছরের প্রাচীন চামুণ্ডা মন্দির। পালমপুর থেকে ধরমশালার রাস্তায় কিলোমিটার দশেক দূরেই অবস্থিত এই মন্দিরটি। চামুণ্ডাদেবী দর্শনপর্ব যখন সারা হল, ঘড়িতে তখন সাড়ে চারটে। দূরের ধৌলাধার ক্রমশ রাঙা হচ্ছে। পড়ন্ত সূর্যের প্রভাবে লাল আভা তার গায়ে। এই দৃশ্য উপভোগ করতে করতেই ফিরে চললাম পালমপুরের পথে।
কাল এগোব ধরমশালার দিকে, পথে দেখব কাংড়া ফোর্ট। (চলবে)
![](https://www.bhramononline.com/wp-content/uploads/2020/12/himachal-in-winter-2-chamunda-26.12-1-1.jpg)
কী ভাবে যাবেন
কাংড়া উপত্যকা ভ্রমণে এলে একটা দিন পালমপুরে থাকুন, ভালো লাগবে। ধৌলাধারের পাদদেশের এই শহরে আসার জন্য সব থেকে নিকটবর্তী রেলস্টেশন পাঠানকোট। হাওড়া থেকে হিমগিরি এক্সপ্রেস এবং কলকাতা স্টেশন থেকে জম্মু তাওয়াই এক্সপ্রেসে পাঠানকোট পৌঁছোনো যায়। এ ছাড়া দিল্লি থেকে পাঠানকোট পৌঁছোতে পারেন। রয়েছে জম্মুগামী রাজধানী এক্সপ্রেস ছাড়াও আরও একাধিক ট্রেন। পাঠানকোট থেকে পালমপুর ১১২ কিমি। বাস চলছে নিয়মিত। এ ছাড়া গাড়িতেই চলে আসা যেতে পারে।
কোথায় থাকবেন
হিমাচল পর্যটনের দু’টি হোটেল রয়েছে পালমপুরে। টি বাড এবং নেউগাল। নেউগালে ঘরের সংখ্যা মাত্র চারটে কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনেক বেশি। দু’টি হোটেল অনলাইনে বুক করার জন্য লগইন করুন www.hptdc.in। এ ছাড়াও শহর জুড়ে হরেক দামের হরেক মানের বেসরকারি হোটেল রয়েছে। দেখে নিতে পারেন বেসরকারি হোটেল বুকিং-এর ওয়েবসাইটগুলো।
ছবি: লেখক