
গাড়ির দরজা খুলতেই হাড়হিম করা ঠান্ডা গ্রাস করল। এই ট্যুরে আপাতত সব থেকে বেশি ঠান্ডার মুখোমুখি। আকাশের মুখ ভার, সেই সঙ্গে দোসর কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। অথচ এক ঘন্টা আগেই রীতিমতো ঘেমেছি।
ঘামব নাই বা কেন, পুরো কাংড়া ফোর্ট হেঁটে উঠতে যে পরিমাণ পরিশ্রম হয়, তাতে ঘামাটাই স্বাভাবিক, সে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ হোক বা মে’এর শেষ সপ্তাহ।
আরও পড়ুন: শীতের হিমাচলে ২/ ধৌলাধারের পাদদেশে পালমপুরে
আমরা এখন নাড্ডিতে। অনেকের কাছ নাড্ডি পরিচিত নয়। তাঁদের জন্য সংক্ষেপে নাড্ডির পরিচয় দিয়ে দিচ্ছি। ধরমশালার ওপরে ম্যাকলিয়ডগঞ্জ, সেই ম্যাকলিয়ডগঞ্জেরও ওপরে নাড্ডি। সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা ৭,০০০ ফুটের আশেপাশে। তাই ঠান্ডা যে বেশি হবে তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু কাংড়া ফোর্ট যেখানে সেই কাংড়া শহর তো মাত্র হাজার দুয়েক ফুট উচ্চতায়, তাই কিছুটা গরম তো লাগবেই।
সকালে পালমপুর থেকে যখন রওনা হলাম, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন দেখে মনে বেশ পুলক লেগেছিল। মদনলালজিও ইঙ্গিত দিলেন, এ রকম মেঘলা চলতে থাকলে নাড্ডির দিকে তুষারপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মেঘলা আবহাওয়া, আর ফুরফুরে একটা হাওয়াকে সঙ্গী করে ছুটে চলল আমাদের গাড়ি।
পালমপুর থেকে কাংড়ার দিকে যত এগোচ্ছি, তত যেন উধাও হয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি পথ। রাস্তা সমতল, পাহাড়ও বিশেষ দেখা যাচ্ছে না, ধৌলাধারের দিকটা ছাড়া। আমাদের উত্তরবঙ্গ ছাড়াও যে কোথাও সমতল থেকে বরফের শৃঙ্গ দেখা যেতে পারে, এ ধারণাটা ছিলই না।
কাংড়া ফোর্টের পাদদেশে এসে দাঁড়াল আমাদের গাড়ি। টিকিট কেটে হাঁটা লাগালাম দুর্গের দিকে। আর পাঁচটা দুর্গের মতো, এখানেও বেশ অনেকটা চড়াই উঠতে হবে।

কাংড়া দুর্গের ইতিহাসের সঙ্গে একটু পরিচিত হওয়া যাক। সম্ভবত ভারতের সব থেকে পুরোনো দুর্গগুলির মধ্যে একটা। কাংড়ার রাজপুত কাটোচ বংশ এই দুর্গ নির্মাণ করেন। ঠিক কবে এই দুর্গ তৈরি হয়েছিল তার কোনো সন-তারিখ না থাকলেও ইতিহাসবিদরা বলেন, এই দুর্গ দু’ হাজার বছরেরও পুরোনো। এক দিকে মুঘল, এক দিকে গোর্খা, অন্য দিকে শিখদের বারবার রুখে দিয়েছে কাটোচরা।
১৮২৮ পর্যন্ত কাটোচদের হাতে থাকার পরে মহারাজা রঞ্জিত সিংহ এই দুর্গ দখল করেন। এর আঠারো বছর পর এই দুর্গের দখল নেয় ব্রিটিশরা। ১৯০৫-এ একটি ভয়াবহ ভূমিকম্পে কাংড়া উপত্যকা সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়ে যায়, মানুষশূন্য হয়ে যায় এই দুর্গ। ভূমিকম্পের সেই চিহ্ন এখনও দুর্গে দেখতে পাওয়া যায়।
রঞ্জিত সিংহ গেট পেরিয়ে দুর্গের সিঁড়ি ভাঙা শুরু। তার পর আমিরি গেট, জাহাঙ্গির গেট, আন্ধেরি গেট, দর্শনী গেট, পেরিয়ে ক্রমে উঠে এলাম ওপরে। ১৯০৫-এর ভূমিকম্পের আগে এখানে কিছু মন্দির ছিল। যেমন সামনেই দেখছি, একটা ফলক যেখানে লেখা লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির। মন্দিরের সামনের অংশ কিছুই নেই, তবে পেছনের দেওয়ালটা অক্ষত, এবং তাতে অসাধারণ কারুকার্যও দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়াও রয়েছে একটি জৈন মন্দির। মন্দির চত্বর ছেড়ে এ বার আরও উপরে ওঠা।

চলে এলাম কাংড়া ফোর্টের একদম টঙে। ৪৫ মিনিটে নীচ থেকে ওপরে উঠে এলাম সবাই। এখান থেকে কাংড়া উপত্যকা নয়নাভিরাম। এক দিকে দেখা যাচ্ছে তুষারাবৃত ধৌলাধার, অন্য দিকে কাংড়া উপত্যকার সমতল। কানে আসছে পাঠানকোট-যোগীন্দরনগর ট্রেনের হুইসলের আওয়াজ। আশপাশটা প্রত্যক্ষ করে ফের নেমে পড়া। কাংড়া ছেড়ে গাড়ি ছুটল ধরমশালার দিকে।
হিমাচল প্রদেশ ক্রিকেট সংস্থাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। বিনামূল্যে এ রকম অসাধারণ একটা সুযোগ সাধারণ পর্যটকদের করে দেওয়ার জন্য। ভারতে, এমনকি বিশ্বে প্রাকৃতিক দিক থেকে সব থেকে সুন্দর স্টেডিয়াম ধরমশালার এই ক্রিকেট স্টেডিয়ামটি। অনেক দিন থেকেই ইচ্ছে ছিল এই স্টেডিয়াম দেখার। এ বার সেই সুযোগ এসে গেল। স্টেডিয়ামের সব থেকে ভালো গ্যালারিটাই পর্যটকদের জন্য খোলা। আন্তর্জাতিক ম্যাচ না থাকলে সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এখানে যে কেউ আসতে পারেন, দু’নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে উঠে যেতে পারবেন গ্যালারিতে। দেখবেন স্টেডিয়ামের মূল প্যাভিলিয়নের পেছনেই কী ভাবে পাহারা দিচ্ছে ধৌলাধার।

ধরমশালা শহর ছেড়ে ম্যাকলিয়ডগঞ্জের রাস্তায় ওঠা শুরু করলাম। পথ এ বার ক্রমশ উঠছে, ঠান্ডাও বাড়ছে। ম্যাকলিয়ডগঞ্জের দু’কিমি আগে বাঁ দিকে ঘুরলাম। রাস্তা এ বার আরও উঠছে। বেশ বুঝতে পারলাম, ম্যাকলিয়ডগঞ্জেরও বেশ ওপরে উঠছি।
নাড্ডি ঢোকার আগে ডান দিকে চোখে পড়ল ডাল লেক। এখানকার একটা দ্রষ্টব্য স্থান। কিন্তু ডাল লেকের নামে কলঙ্ক এই লেক। লেকের জলের প্রায় জল নেই। যেটুকু রয়েছে তা-ও নোংরা।
সাইজে ছোটো হলেও, নাড্ডির সাহিমা হোটেলে যে ঘরটা পেলাম, সেটা এক কথায় অসাধারণ। পর্দা সরাতেই অদ্ভুত অনুভূতি। চোখের সামনে ধবধবে ধৌলাধার। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। সফরে এই প্রথম বার ঠকঠক করে কাঁপছি ঠান্ডায়। ঘরে থাকলে ঠান্ডা চেপে বসতে পারে, তাই মধ্যাহ্নভোজনের পরে পায়ে হেঁটে নাড্ডি ঘোরার সিদ্ধান্ত নিলাম।
ধরমশালার সব থেকে উচ্চতম পয়েন্ট নাড্ডি। এখান থেকেই বরফমাখা ধৌলাধারকে সব থেকে কাছে মনে হয়। ছোট্টো একটা জনপদ। রয়েছে টাক্সি স্ট্যান্ড। সেই ট্যাক্সি স্ট্যান্ড লাগোয়া কিছু খাবারের রেস্তোরাঁ, চায়ের দোকান। স্ট্যান্ডে গাড়ি লাগিয়ে আপনি ধৌলাধারকে সামনে রেখে হাঁটাহাঁটি করে নিতে পারেন। দূরের কিছু জিনিস কাছে নিয়ে আসার জন্য টেলিস্কোপের ব্যবস্থাও রয়েছে। আর হ্যাঁ, পরিষ্কার দিনে নাড্ডি থেকে সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ মিস করবেন না।

যদিও সূর্য ডোবা এখান থেকে দেখা যায় না, কিন্তু সূর্যাস্তের সময়ে ধৌলাধারের রঙ বদলানো আপনার চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমরাও সে রকমই কিছু দুর্দান্ত ছবি চাক্ষুষ করলাম। মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম নিজেদেরই, ধরমশালা বা ম্যাকলিয়ডগঞ্জে না থেকে নাড্ডিতে থাকার সিদ্ধান্তের জন্য।
পরের দিন প্রাতরাশের পরেই বেরিয়ে পড়লাম সাইট সিয়িং-এ। ডাল লেক আগের দিনই দেখা হয়ে গিয়েছে গাড়ি থেকে। আমাদের প্রথম গন্তব্য ভাগসুনাগ মন্দির। নাড্ডি থেকে ম্যাকলিয়ডগঞ্জের অতি ঘিঞ্জি রাস্তা পেরিয়ে এসে পৌঁছোলাম ভাগসুনাগ মন্দির। ধরমশালা, ম্যাকলিয়ডগঞ্জ অঞ্চলের সব থেকে জাগ্রত এবং প্রাচীন এই ভাগসুনাগ মন্দির, প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো বলে দাবি। রয়েছে একটি উষ্ণ প্রস্রবণ। তবে মন্দির ছাড়াও এই ভাগসুনাগের আরও একটা আকর্ষণ ভাগসুনাগ জলপ্রপাত। মন্দিরের পেছনের রাস্তা ফিয়ে কুড়ি মিনিটের খাড়াই উঠে পৌঁছোনো যায় প্রপাতে। স্বমহিমায় থাকলে এই প্রপাতকে ভয়ংকর লাগে। কিন্তু এ বছর বর্ষার অভাব স্পষ্ট। জল পড়ছে সরু সুতোর মতো। ভাগসুনাগ থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ম্যাকলিয়ডগঞ্জের নামগিয়াল মন্যাস্ট্রি।

দলাই লামা মন্দির হিসেবে খ্যাত এই মন্যাস্ট্রি। ১৯৫৯ থেকে তিব্বত থেকে পালিয়ে ভারতে আসার পর থেকে এখানেই রয়েছেন চতুর্দশ দলাই লামা, তেনজিং গিয়াতসো। তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের রাজধানী (ক্যাপিটাল-ইন-একজাইল) এই মন্যাস্ট্রি। এই মন্যাস্ট্রির রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে চিন শাসনের বিরুদ্ধে তিব্বতের বিদ্রোহের ইতিহাস। তিব্বত বিদ্রোহে যত জন প্রাণ হারিয়েছেন, সবাইকে স্মরণ করা হয়েছে এখানে। সেই সঙ্গে রয়েছে স্বপ্ন, একদিন চিনের শাসন থেকে বেরিয়ে এসে তিব্বত স্বাধীন হবেই। মন্যাস্ট্রিটা খুব বড়ো। এখানে বিভিন্ন বয়সের মহিলা এবং পুরুষ মিলিয়ে রয়েছেন প্রায় দুশো বৌদ্ধ ভিক্ষু।

নামগিয়াল থেকে এলাম কুনাল পাথরি মন্দিরে। ধরমশালার উপকণ্ঠে অবস্থিত এই মন্দিরটি রক টেম্পল হিসেবে খ্যাত। প্রধান অধিষ্ঠাতা দেবী দুর্গা। যে পাথরটির নীচে দেবী রয়েছেন, তার ওপরে সব সময়েই কিছুটা জল থাকে। সেই জলের উৎপত্তি কোথায়, সে ব্যাপারে কারও কোনো ধারণাই নেই। স্থানীয়দের দাবি এটি ৫১ সতীপিঠের অন্যতম, যদিও সেই দাবি ঘিরে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে যথেষ্ট। এ বার নাড্ডি ফেরার পালা। তবে এখনও একটা স্পট দেখতে হবে আমাদের। ম্যাকলিয়ডগঞ্জ গির্জা।
বড়োদিনের দু’দিন পরে এসেছি তাই সুন্দর ভাবে সাজানো হয়েছে ম্যাকলিয়ডগঞ্জ গির্জা, নাম সেন্ট জন্স ইন দ্য ওয়াইল্ডারনেস। ১৮৫২ সালে তৈরি এই গির্জার চারিদিক দেবদারু গাছে ভর্তি। সুন্দর, সাজানো গোছানো বাগান। এই বাগানে বসেই সময় কাটিয়ে দেওয়া যায় কিছুক্ষণ। শেষ হল ধরমশালার ঘোরাঘুরি। এ বার হোটেল ফেরার পালা।
পড়ন্ত বেলায় নাড্ডির উদ্দেশে গাড়ি স্টার্ট দিলেন মদনলালজি। সেই সঙ্গে জানিয়ে দিলেন কাল তিনি কিছু একটা সারপ্রাইজ দেবেন আমাদের। আমরাও সেই সারপ্রাইজের অপেক্ষায় রইলাম। (চলবে)

কী ভাবে যাবেন
ধরমশালা/ম্যাকলিয়ডগঞ্জ/নাড্ডি অনেক ভাবেই যাওয়া যেতে পারে। হাওড়া বা দিল্লি থেকে পাঠানকোট পৌঁছে সেখান থেকে বাসে বা গাড়িতে পৌঁছোতে পারেন। পাঠানকোট থেকে ধরমশালার দূরত্ব ৮৫ কিমি। ধরমশালা থেকে ম্যাকলিয়ডগঞ্জ এবং নাড্ডির দূরত্ব যথাক্রমে ৮ এবং ১১ কিমি। দিল্লি থেকে ধরমশালা পর্যন্ত নিয়মিত বাস রয়েছে হিমাচল প্রদেশ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগমের।
কোথায় থাকবেন
ম্যাকলিয়ডগঞ্জ অঞ্চল খুব ঘিঞ্জি এবং এখান থেকে ধৌলাধার বিশেষ দেখা যায় না। ধৌলাধার দেখতে হলে ধরমশালা বা নাড্ডিই ভালো। ধরমশালায় হিমাচল পর্যটনের তিনটে হোটেল রয়েছে, ধৌলাধার, কুনাল এবং কাশ্মীর হাউস। অনলাইনে বুক করতে পারেন www.hptdc.in। তা ছাড়া ধরমশালা শহরে অনেক বেসরকারি হোটেল রয়েছে। নাড্ডিতেও থাকার জন্য রয়েছে অনেক বেসরকারি হোটেল। হোটেল বুকিং-এর বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে সন্ধান পেয়ে যাবেন। হিমাচল পর্যটনের দু’টি হোটেল, ক্লাব হাউস এবং ভাগসু রয়েছে ম্যাকলিয়ডগঞ্জে।