সুব্রত গোস্বামী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
২৬ জুলাই। সকাল সাড়ে ১০টা। নিউ দিল্লি স্টেশনে পৌঁছোলাম। স্টেশন থেকে অটো নিয়ে সোজা গুজরাতি সমাজ সদন। এখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা। পশ্চিমবাংলা থেকে এসেছেন সুরজভাই। ওঁর সঙ্গে আলাপ হল। কথা বলে বেশ ভালো লাগল। দুপুরে আলু-পরোটা। খানিক বিশ্রাম। সন্ধ্যায় আমাদের লিয়াজঁ অফিসারদের সঙ্গে আলাপ হল। আমাদের এই যাত্রায় দু’ জন করে লিয়াজঁ অফিসার থাকেন। ওঁরাই গোটা যাত্রা পরিচালনা করেন। লিয়াজঁ অফিসার হিসাবে আমাদের সঙ্গে রয়েছেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার ক্যাপ্টেন সুরিন্দর গ্রোভার এবং বিদেশ মন্ত্রকের অফিসার ডাঃ রাই।
দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে যাত্রীরা এসেছেন। তাঁদের সঙ্গে একে একে পরিচিত হলাম। অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে এসেছেন এক নগ্নপদ সাধুবাবা। তিনি সারা ভারত খালি পায়ে ভ্রমণ করেছেন। কৈলাস-মানসও খালি পায়ে যেতে চান। কিন্তু এ পথ তো সাংঘাতিক। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর হাতছানি। তাই লিয়াজঁ অফিসারের নির্দেশে জুতো কিনতেই হল সাধুবাবাকে। তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া সেরে শুয়ে পড়লাম। কাল তো সেই দিন – শারীরিক সক্ষমতা পরীক্ষার দিন।
আরও পড়ুন: পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ১/ ডাক এল
সক্কালেই চলে এল কেএমভিএন তথা কুমায়ুন মণ্ডল বিকাশ নিগমের বাস। বাসে উঠেই রাজস্থান থেকে আসা পোটারামজি শিবের ভজন শুরু করলেন, আমরাও গলা মেলালাম। ভজন গাইতে গাইতে দিল্লি হার্ট অ্যান্ড লাং ইনস্টিটিউটে। এখানেই আমাদের শারীরিক পরীক্ষা হবে। প্রথমে মহিলাদের পরীক্ষানিরীক্ষা, তার পরে সিনিয়র সিটিজেনদের, সব শেষে আমাদের পালা। একে একে চেস্ট এক্সরে, ইসিজি, পিএফটি ও ট্রেডমিল টেস্ট (টিএমটি)। পিএফটি পরীক্ষায় অনেকেরই অসুবিধা হচ্ছে। ঠিকমতো ফুঁ দিতে পারছিলেন না। আমি এত জোরে ফুঁ দিলাম যে টেকনিশিয়ান বন্ধু হেসে বলে উঠলেন – আপনি তো দেখছি, আমাদের যন্ত্রটাই খারাপ করে দেবেন। বুঝে গেলাম, আর কোনো পরীক্ষায় কী হবে জানি না, তবে এই পরীক্ষায় আমি উতরে গিয়েছি।
এর পর সকালের টিফিনের জন্য কিছুক্ষণের বিরতি। হাসপাতালের ক্যাফেটেরিয়ায় আলু–পরোটা, দই আর আচার দিয়ে প্রাতরাশ সম্পন্ন হল। জহরভাইকে খুঁজতে খুঁজতে নীচে পেয়ে গেলাম। ওর টিএমটি–তে কিছু সমস্যা ধরা পড়ায় ওর অন্য একটা টেস্ট করানো হচ্ছে। সমস্ত পরীক্ষানিরীক্ষা শেষ করে দুপুর দেড়টায় আমরা হাসপাতালের অডিটোরিয়ামে মিলিত হলাম। এখানে এক অভিজ্ঞ ডাক্তারবাবু আমাদের হাই অলটিচ্যুড সিকনেস সম্পর্কে কিছু পরামর্শ দিলেন।

ফিরে এলাম গুজরাতি সমাজ সদনে। রাতে সুন্দর ভোজন হল, তবে নিরামিষ। কাল সকালে যেতে হবে আইটিবিপি–র হাসপাতালে। আমাদের শারীরিক পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে এখানকারই ডাক্তারবাবুরা আমাদের ফিট সার্টিফিকেট দেবেন। যাঁরা এই সার্টিফিকেট পাবেন তাঁরাই শামিল হবেন কৈলাস–মানসযাত্রায়।
২৮ জুলাই। আজ মেডিক্যাল পরীক্ষার রিপোর্ট জানা যাবে। এক রাশ চিন্তা নিয়ে ঘুম ভাঙল। নিজেকে নিয়ে যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি জহরভাইকে নিয়ে। ওর টিএমটি রিপোর্টটা ভালো আসেনি। ও না আবার আনফিট হয়ে যায়!
প্রাতরাশ সেরে যথারীতি কেএমভিএন–এর বাসে রওনা। আজও শিবের ভজন চলছে। ভজন গাইতে গাইতে চলে এলাম আইটিবিপি–র হাসপাতালে। শুরু হল ডাক্তার দেখানোর পালা। ডাক্তারের ঘর থেকে কেউ হাসিমুখে বেরোচ্ছে, কেউ বা হতাশ হয়ে। জহরভাই হাসিমুখেই বেরোল, বুঝলাম ফিট সার্টিফিকেট পেয়ে গিয়েছে। যাক একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হলাম। আমার পালা এল। আমি নিজেকে নিয়ে তত ভাবছি না। ঈশ্বর যখন আমাকে এত দূর এনেছেন, তখন হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। ঈশ্বরের চরণে প্রণাম জানিয়ে ঢুকে পড়লাম ডাক্তারের ঘরে। রিপোর্ট ভালোই। শুধু এলডিএল একটু বেশি। যা–ই হোক, ফিট সার্টিফিকেট পেয়ে গেলাম। বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) ২৫–এর মধ্যে থাকতে হয়, আমার ২৪.৯। গত চার মাসের কঠোর পরিশ্রমের ফল, আট কেজি ঝরিয়েছি। আমাদের দলের ৬০ জনের মধ্যে ৬ জনকে আনফিট ঘোষণা করা হল। ওঁদের চোখে তখন জলের ধারা।
এর পর আমাদের নিয়ে চলল ব্রিফিং–পর্ব। লিয়াজঁ অফিসারদের কথায়, শুধু অর্থ আর স্বাস্থ্য থাকলেই এই যাত্রা করা যায়, এই ধারণা ভুল। ঈশ্বর না চাইলে, এই যাত্রা সম্পূর্ণ করা যায় না। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে যাত্রার বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমাদের দেওয়া হল। দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থাও করল এ রকম একটি সংস্থা। নিরামিষ ভোজের এলাহি আয়োজন। বিদেশি মুদ্রার লেনদেন করে ফিরে এলাম গুজরাতি সমাজ সদনে।
২৯ জুলাই। আজ আমাদের গন্তব্য ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রক। সেখানকার আধিকারিকরা আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন। যথারীতি শিব–ভজন গাইতে গাইতে সোয়া ৮টা নাগাদ রওনা হলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম মন্ত্রকে। সিকিউরিটি চেকের পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হল মিডিয়া ব্রিফিং রুমে। এই সেই জায়গা যেখানে দেশের বিদেশমন্ত্রী সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলিত হন। প্রথমেই হল ফোটোসেশন। এর পর আইটিবিপি এবং বিদেশ মন্ত্রকের আধিকারিকরা আমাদের যাত্রার খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা করলেন। আমরা যাচ্ছি তীর্থযাত্রী হয়ে। চিনে গিয়ে আমরা যেন এমন কিছু না করি যাতে দেশের সুনাম নষ্ট হয়।
সমস্ত পর্ব মিটিয়ে মন্ত্রকের বাইরে এসে দেখি কেএমভিএন–এর প্রাক্তন এমডি উদয় কৌশিক ফলের রস নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। এই মানুষটির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল প্রায় মাসদুয়েক আগে। কৈলাস–মানস সরোবর তীর্থযাত্রী মিলন সমিতির পশ্চিমবঙ্গ শাখার উদ্যোগে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে। যাঁরা কৈলাস–মানস যান, তাঁদের গাইড করার উদ্দেশ্যে ২০১১ সালে এই সমিতি গঠিত হয়। মাননীয় সুমিত সাহা ও তাঁর বন্ধুরা কৈলাসগামী তীর্থযাত্রীদের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। প্রতি বছর জুন মাসের প্রথম রবিবার উত্তর কলকাতার ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির পাশে একটি হলে কৈলাসযাত্রীদের নিয়ে একটি সভার আয়োজন করেন। আমাদের রওনা হওয়ার আগে ২০১৯–এর ২ জুন যে সভা হয়েছিল তাতে হাজির ছিলেন উদয় কৌশিকজি এবং দীপা মাতধারে। আমাদের জন্য কৌশিকজি, দীপাদি, সুমিতদাদের ভালোবাসা দেখলে মনটা ভালো হয়ে যায়।

বিদেশ মন্ত্রক থেকে দু’টো নাগাদ ফিরে এলাম। আমাদের লাঞ্চ রেডি – ভাত, রুটি, রাজমা ডাল, মিক্সড্ ভেজিটেবল, রায়তা ও গোলাপজাম। দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিতে না নিতেই বিকেলের চা–স্ন্যাক্সের ঘোষণা হয়ে গেল। এদের এই সব মুখরোচক খাবার খেতে খেতে যেন ওজন না বেড়ে যায়! তবে আমার এখন খাবারে মন নেই। আমার মন পড়ে আছে আমার আরাধ্য দেবতা ও তাঁর বাসভূমি কৈলাস পর্বতে।
বিকেলে দিল্লি সরকারের পক্ষ থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে আমাদের সংবর্ধনা জানানো হয়। আমাদের জানানো হল, দিল্লি সরকারের তরফ থেকে প্রত্যেক তীর্থযাত্রীকে চার হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হবে। তবে সেই টাকা পাওয়া যাবে যাত্রা সমাপ্ত হওয়ার পর। আমাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সেই টাকা জমা পড়ে যাবে।
আজকের ডিনারও আয়োজন করেছে দিল্লি সরকার। রাতের খাবার খেলাম না। কাল খুব ভোরেই যে উঠতে হবে। ৫টাতেই রওনা হতে হবে আলমোড়ার পথে। (চলবে)
ছবি: লেখক