সুব্রত গোস্বামী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ভোর চারটে। আমরা সবাই প্রস্তুত। বাইরে এখনও গাঢ় অন্ধকার। নীচে এসে দেখি আমাদের যাত্রার মঙ্গলকামনায় হোমযজ্ঞ চলছে। হোমযজ্ঞ করছেন স্বয়ং কৌশিকজি, সঙ্গে রয়েছেন আরও বেশ কিছু কৈলাসী-ভাই। গুজরাতি সমাজ সদনের প্রধান ফটকের বাঁ দিকের গাছতলায় হোমযজ্ঞের আয়োজন করা হয়েছে। গেটের ডান দিকে বসেছেন এক সানাইশিল্পী, ধরেছেন ভোরের রাগিণী। এক অভূতপূর্ব পরিবেশ। আমি বিস্মিত। আমরা চলেছি কৈলাস-মানস পরিক্রমায়, আর আমাদের মঙ্গল কামনা করতে এত ভোরে হাজির হয়েছেন এই কৈলাসী-ভাইরা। এ আমার পরম প্রাপ্তি। যাত্রার আগে আমাদের এক প্রস্ত সংবর্ধনা দেওয়া হল। উত্তরীয় পরানো হল, মুখে দেওয়া হল মিষ্টি।
সকাল ৬টা। এসি ভলভো বাসে যাত্রা শুরু হল। আজকের দিনটা শ্রাবণ শিবরাত্রি। হরিদ্বার থেকে গঙ্গার জল নিয়ে হাজার হাজার শিবভক্ত আসছেন দিল্লিতে। তাঁদের ‘হর হর মহাদেব’ ধ্বনিতে রাজপথ মুখরিত। প্রবল যানজট। আমরা ঘুরপথে গাজিয়াবাদ এলাম। এখানে আমাদের পথরোধ – এখানকার কৈলাসী-ভাইরা আমাদের জন্য সংবর্ধনার আয়োজন করেছেন। সেই সংবর্ধনা নিয়ে তবে আমরা যেতে পারব। এখানকার ওয়েস্ট ভিউ হোটেলে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল। রাজকীয় সংবর্ধনা দেওয়া হল। তার পরেই চলল প্রাতরাশ পর্ব। কাল রাতে খাইনি। তাই পেট পুরে খেয়ে রওনা দিলাম কাঠগোদামের পথে।
দুপুর ২টো নাগাদ পৌঁছে গেলাম কাঠগোদামে। কেএমভিএন অতিথি নিবাসে আমাদের স্বল্পকালীন বিরতি। দু’টি ফুটফুটে মেয়ে শিবের ভজন গাইছে। ওয়েলকাম ড্রিংক দিয়ে আমাদের স্বাগত জানানো হল। এর পর মধ্যাহ্নভোজনের পালা। দুপুরের খাওয়া সাঙ্গ করে ফের রওনা। গাড়ি বদল হল। পাহাড়ি পথে বড়ো গাড়ি উঠতে অসুবিধা। তাই দু’টি গাড়িতে আমরা রওনা দিলাম আলমোড়ার উদ্দেশে।
গাড়ি সমতল ছেড়ে পাহাড়ি রাস্তা ধরল। কেন জানি না, পাহাড় আমাকে সব সময় টানে। এক দুর্নিবার আকর্ষণ। পাহাড়ের ডাকে ছুটে যাই বারবার। গত বছর এই সময়ে ছিলাম লে-লাদাখ অঞ্চলে। আসলে পাহাড়ে বৈচিত্র্যের শেষ নেই। তার অপার রহস্য। পাহাড়ি পথের প্রতিটি বাঁকে যেন নতুন কিছু লুকিয়ে থাকে। পাহাড়ের এই আঁকাবাঁকা পথ জীবনের পথ চলতে শেখায়। পড়ন্ত বিকেলের রোদ পড়েছে পাহাড়ের গায়ে, চার দিক কেমন যেন মায়াময় হয়ে উঠেছে। অস্তগামী সূর্যের আলোর ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে দূরের পর্বতশৃঙ্গগুলো দেবলোকের কনক দেউলের মতো নীল শূন্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
সন্ধে ৭টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম আলমোড়ার কেএমভিএন অতিথিনিবাসে। আবার ওয়েলকাম ড্রিংক। এক কাপ চা পেলে খুব ভালো হত। ঘরে ঢুকে ধড়াচুড়ো ছেড়ে স্নান সেরে নরম সাদা বিছানায় শরীরটা ছুড়ে দিলাম। বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে। বেড়াতে বেরিয়ে কোনো জায়গায় হোটেলে চেক ইন করার পরেই জোটে এক কাপ চা, আমার স্ত্রীর সৌজন্যে। ইলেকট্রিক কেটলি আমাদের সব সময়ের সফরসঙ্গী। এখানে সেটাই মিস করছি। জহরভাইকে চায়ের খোঁজে পাঠালাম। কপাল খারাপ, মিলল না। অগত্যা শুধু স্যুপ খেয়েই শুয়ে পড়লাম। কাল ভোর ৫টায় ফের রওনা।
অতিথিনিবাসের কর্মীদের ডাকে রাত ৩টেয় ঘুম ভেঙে গেল। একটু পরেই হাজির বেড টি। সবাই প্রস্তুত হতে হতে ৫টা বেজে গেল। সোয়া ৫টা নাগাদ আমাদের গাড়ি ধারচুলার উদ্দেশে রওনা হল। একটু পরেই সূর্যোদয় হল। সূর্যের আলো পেয়ে আশেপাশের পাহাড়গুলোর যেন ঘুম ভাঙল। আলমোড়া ছাড়িয়ে কিছুটা আসতেই চিতই। এখানকার গলু দেবতার মন্দিরটি বিখ্যাত। গলু দেবতা কুমায়ুন অঞ্চলের আরাধ্য দেবতা, ভগবান শিবের একটি রূপ। আমাদের রাস্তা মন্দিরের প্রধান ফটকের গা ঘেঁসে। ফটক থেকে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে মন্দিরে। বাস থেকেই দেখলাম।
আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে চলেছি। পাহাড়ি রাজ্যের এমনই মজা, এখন যে পাহাড় সূর্যের আলোয় আলোকিত হচ্ছে, সূর্য পশ্চিমে হেলে গেলে সে আর আলো পাবে না। আর এখন যে পাহাড় আলো পাচ্ছে না, সময় যত দুপুরের দিকে গড়াবে, সে তত আলো পাবে। সাড়ে ৮টা নাগাদ প্রাতরাশের জন্য যাত্রার সাময়িক বিরতি হল। রায়তা ও আচার সহযোগে আলু-পরোটা। একে একে পেরিয়ে এলাম ধৌলছিনা, বেরিনাগ, উদিয়ারি বেন্ড।
উদিয়ারি বেন্ডে এসে ডান দিকে ঘুরলাম। সোজা রাস্তাটা চলে গিয়েছে বিখ্যাত পর্যটনস্থল চৌকরি হয়ে বাগেশ্বর। আমাদের এই ডান হাতি রাস্তা ক্রমশ নীচে নেমে চলেছে। নামার জন্য অন্ত নেই। পাহাড়ি রাস্তায় নামা মানেই কোথাও আবার ওঠা অপেক্ষা করে রয়েছে। নামতে নামতে পৌঁছে গেলাম রামগঙ্গা নদীর তীরে থল-এ। নদীর ধার বরাবর রাস্তা। একেবারে সমতল। বেশ বড়ো বাজার এই থল। বেশ বুঝতে পারছি ১৮১১ মিটার উঁচু আলমোড়া থেকে আমরা নেমে এসেছি অনেকটাই। বাজার-এলাকা শেষ হল, থলও বিদায় জানাল। একটু পরে ডান দিকের রাস্তা ধরে আবার পাহাড় ভাঙা শুরু হল। সোজা রাস্তা চলে গেল নদীর ধার বরাবর মুনশিয়ারির দিকে।
আমাদের যাত্রাবিরতি ঘটল ডিডিহাটে। আবার উঠে এলাম সমুদ্রতল থেকে ১৭২৫ মিটার উচ্চতায়। ডিডিহাট ছোটো জনপদ। কৈলাস-মানসযাত্রার গাড়ি দেখে সবাই শিবের নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে। এখানকার কেএমভিএন অতিথিশালায় দ্বিপ্রাহরিক ভোজনপর্ব সেরে আমরা এগিয়ে চললাম। একটু পরেই পৌঁছে গেলাম মিরথি। এখানে আইটিবিপি’র সদর দফতরে আমাদের স্বাগত জানানো হল। দু’টি কিশোরী আমাদের হাতে ফুল তুলে দিল। আইটিবিপি’র জওয়ানরা বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সংগীত পরিবেশন করলেন। আমাদের গ্রুপ ফোটো তোলা হল। যাত্রা শেষ করে ফেরার পথে গাজিয়াবাদে আমরা হাতে পাব ওই ছবি।
মিরথি আইটিবিপি ক্যাম্পে কৈলাস-মানসযাত্রা নিয়ে একটি তথ্যচিত্র দেখানো হল। যাত্রাপথে আমরা কী করব আর কী করব না, সে সম্পর্কে আমাদের অবহিত করলেন আইটিবিপি’র অফিসারেরা। তার পর চা পান। আবার যাত্রা শুরুর পালা। জওয়ানরা সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আমাদের অভিবাদন জানালেন। আমরা রওনা হলাম।
এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে চলেছি। আসকোট পেরিয়ে কিছুটা যাওয়ার পথে ডান দিকে পড়ল কালী নদী। এই নদী ভারত ও নেপালের মধ্যে সীমান্ত রচনা করেছে। এ পারে ভারত, নদীর ও পারে নেপাল। সন্ধের মুখে চলে এলাম সীমান্তবর্তী ছোটো শহর ধারচুলায়। থাকার ব্যবস্থা কেএমভিএন অতিথিশালায়।
অতিথিশালার গা ঘেঁসেই দুদ্দাড় বেগে বয়ে চলেছে কালী। নদীর গর্জন মনের মধ্যে বেশ ভয় জাগায়। যথারীতি ওয়েলকাম ড্রিংক দিয়ে আমাদের সংবর্ধনা জানানো হল। দিল্লি থেকে আমাদের যে লাগেজ আলাদা হয়ে গিয়েছিল, তা আমরা হাতে পেলাম। তবে অল্পক্ষণের জন্য। নিত্যব্যবহার্য টুকিটাকি নিয়ে লাগেজ আবার ফেরত দিয়ে দিতে হল। দু’ দিন পর গুনজিতে আবার মালপত্র ফিরে পাব।
আরও পড়ুন: পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ২/মিলল যাত্রার ছাড়পত্র
একটু পরেই লিয়াজঁ অফিসারেরা এসে আমাদের কাছে আগামীকালের যাত্রাপথ বর্ণনা করলেন। কাল থেকেই শুরু হবে আমাদের আসল পরীক্ষা। কিছুটা দূরত্ব গাড়িতে গিয়ে শুরু হবে হাঁটা, কৈলাস-মানসের উদ্দেশে। আজ আমাদের সহযাত্রী সুরিন্দরজির জন্মদিন। সবাই মিলে কেক কাটা হল।
বাড়ির সঙ্গে ফোনে কথা হল। এর পর আবার গুনজিতে ফোন করার সুযোগ পাব। গুনজির সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে ফোন আছে। বিকেলে দু’ মিনিটের জন্য যাত্রীরা ফোন করার সুযোগ পাবেন। ধারচুলায় আমাদের জন্য মালবাহক ও ঘোড়ার (পনি, পাহাড়ি ছোটো ঘোড়া) ব্যবস্থা করা হল। কাল সকালে ওরা আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে। (চলবে)
ছবি: লেখক