
অরণ্যসুন্দরী ঝাড়খণ্ডের কোনায় কোনায় অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা। প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য্যের পাশাপাশি দেবতাদেরও প্রিয় স্থান এই আদিবাসী অধ্যুষিত রাজ্যটি। দিকে দিকে নানা মন্দির ও তাকে ঘিরে থাকা নানান লোককাহিনি এবং তার সঙ্গে জুড়ে আছে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। তাই তো পর্যটন শিল্পের বিকাশে দুয়োরানি হলেও কত শত প্রকৃতি-পুজারির চিত্তহরণ করে চলেছে এই রাজ্যটি।
এ বার আমার গন্তব্য ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাজধানী রাঁচি থেকে মাত্র ৬৮ কিলোমিটার দুরে অন্যতম সিদ্ধপীঠ রাজরাপ্পা। এখানে দেবী মহামায়া ছিন্নমস্তা রূপে বিরাজিতা। ভারতবর্ষে মাত্র যে কয়েকটি ছিন্নমস্তা দেবীর মন্দির আছে তার মধ্যে রাজরাপ্পা প্রধান সিদ্ধপীঠ হিসেবে খ্যাত।
ছিন্নমস্তা মন্দির
দশমহাবিদ্যার অন্যতম রূপ ছিন্নমস্তা বা ছিন্নমস্তিকা। একদা দক্ষের যজ্ঞ উপলক্ষ্যে সতীর পিতৃগৃহে যাওয়ায় বাধা দিলে শিবের ওপর প্রচণ্ড রেগে দেবী দশটি রুদ্ররূপ ধারণ করে মহাদেবকে ভয় দেখান। মায়ের সেই দশটি রূপের অর্থাৎ দশ মহাবিদ্যার তৃতীয় রূপ হলেন মা ছিন্নমস্তা।
আরও পড়ুন জৌলুসের অন্তরালে বিশ্বাসঘাতকতা : দেশের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের সাক্ষী গ্বালিয়র
দেখতে ভয়ংকরী হলেও মায়ের সব চেয়ে দয়াময়ী রূপ ছিন্নমস্তা। একদা ডাকিনী ও যোগিনী-সহ এক সরোবরে স্নানরত ছিলেন দেবী। সেই সময় ডাকিনী ও যোগিনীর বড্ড খিদে পায়। খিদের যন্ত্রণায় তারা কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। এই অবস্থায় কোথাও খাবার না পেয়ে মাতৃহৃদয় বড়োই ব্যথিত হয়। তখন উপায় না দেখে মা নিজেরই নখ দিয়ে গলা চিরে নিজের মুণ্ডু বাম হস্তে ধারণ করেন। গলা দিয়ে তিনটি রক্তধারার একটি ডাকিনী, একটি যোগিনী এবং আর একটি মায়ের নিজ মুখমণ্ডলে প্রবেশ করে। মায়ের গলায় নরমুণ্ড শোভিত। কাম ও রতির ওপর দণ্ডায়মানা এই রূপে ভয়ের পরিবর্তে সন্তানবৎসল মাতৃরূপটিই প্রকাশিত হয়। মা এখানে দয়াময়ী। কামলালসাকে সংযম করেন দেবী।
হিন্দুধর্ম ছাড়াও তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মে দেবী ছিন্নমস্তা পূজিতা। মূলত উত্তর ভারত ও নেপালে ছিন্নমস্তার কয়েকটি মন্দির থাকলেও মায়ের মূল সিদ্ধপীঠ রাঁচি জেলার রাজরাপ্পায় অবস্থিত।
পলাশ বনতল
রাজরাপ্পা নামটির সঙ্গেও এটি সুন্দর কাহিনি জুড়ে রয়েছে। প্রাচীনকালে এখানকার এক জনপ্রিয় রাজা ছিলেন ‘রাজা’, তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল ‘রুম্পা’। পরবর্তীকালে রাজা ও রুম্পার নামে জায়গার নাম হয় রাজরাপ্পা। রাঁচি, রামগড় ও হাজারিবাগের পুরো পথটাই বসন্তে পলাশ ফুলে সেজে ওঠে। তখন প্রকৃতি আরও মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। জলবায়ুও সাস্থ্যকর।
এক দিকে দামোদর, আর এক দিকে বইছে ভৈরবী নদী, স্থানীয়রা বলেন ভেরা। দুইয়ের সঙ্গমস্থলে এক অনুচ্চ টিলার টঙে মায়ের মন্দির। মায়ের পূজার প্রধান অর্ঘ্য নারকেল, প্যাঁড়া, চিঁড়ে, নকুলদানা জবার মালা ইত্যাদি। যে কোনো শাক্তপীঠ বা সিদ্ধপীঠের মতো এখানেও বলিপ্রথা প্রচলিত। মানসপূরণে ভক্তরা ছাগবলি দিয়ে থাকেন।
রাজরাপ্পা ফলস্
এই অঞ্চলটি ভৌগোলিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এখানে একটি অনুচ্চ পাহাড় থেকে পুরো ভৈরবী নদী দামোদর নদের বুকে আছড়ে পড়ছে। ভৈরবী নদীকে নারী আর দামোদর নদকে পুরুষ মনে করলে নদ ও নদী অথবা নারী-পুরুষের সেই চির সঙ্গম হচ্ছে এই স্থানটিতে। টিলায় ঘেরা দামোদরকে কী অপরূপ লাগে। সেই রূপ একবার যে দেখেছে সে জন্ম জন্মান্তরেও তা ভুলবে না। পুরো পরিবেশটাই নয়নাভিরাম। মূল মন্দির ছাড়াও মহাদেবের মন্দির, দক্ষিণাকালী মন্দির ও কিছু দূরে অষ্টমাতৃকা মন্দির। মায়ের ভৈরবরূপী শিবলিঙ্গটি বেশ উঁচু।
দামোদরে নৌকাবিহার
পূজা দেওয়ার জন্য মন্দিরচত্বরের সামনে পেছনে রয়েছে পূজাসামগ্রীর অসংখ্য দোকান। পছন্দমতো পূজার অর্ঘ্য নিয়ে মায়ের চরণে পূজা নিবেদন করে চলে আসুন দামোদরের কাছে। অনেক নৌকা এখানে অপেক্ষা করে আছে আপনাকে নিয়ে ভেসে পড়ার জন্য। তার মধ্যে যে কোনো একটিতে কুড়ি-তিরিশ টাকার বিনিময়ে ভেসেই পড়ুন দামোদরের বুকে। মার্বেল রকের মতো দু’পাশে পাথরের পাহাড়, তার মাঝখান দিয়ে ভাসতে ভাসতে পৌঁছে যান জলপ্রপাতের কাছে। কয়েক মিনিট ঠান্ডা আবহে আর ঝরনার গর্জন শুনতে শুনতে হারিয়ে যান মন-কেমনের রাজ্যে। চাইলে নৌকো করে আরও কিছুটা ঘুরেফিরে আসুন। ফেরার পথে নিস্তব্ধ জঙ্গলে প্রকৃতিকে সঙ্গী করে দর্শন করে নিন অষ্টমাতৃকা মন্দির। এখানে অরণ্যের শীতল ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রামও করে নিতে পারেন। আহারের জন্য অনেক দোকান আছে মন্দির চত্বরের বাইরে। সেখান থেকে আহারপর্ব সেরে ফেলুন। চাইলে রাজরাপ্পায় রাতও কাটাতে পারেন।
পুরোনো শিবমন্দির, রামগড়
ফেরার পথেও রামগড়ে পুরোনো শিবমন্দিরের সামনে নেমে পড়ুন। ইটের মন্দিরটির অবস্থা আজ জীর্ণ। বহু ইতিহাসের পথ পেরোনো মন্দিরটি বেশ বড়ো এবং দেখলেই বোঝা যায় এক সময় মন্দিরটির গায়ে অনেক কারুকার্য ছিল। এখন সে সব ক্ষয়প্রাপ্ত। বেশ ক’টা বড়ো বড়ো সিঁড়ি ভেঙে মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে হয়। পুরাতত্ত্বের জীবন্ত দলিল দর্শন সেরে একটা অটো ধরে চলে আসুন রামগড় বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে বরকাকানা, রাঁচি বা হাজারিবাগ হয়ে ঘরে ফিরুন। স্মারক হিসেবে রাজরাপ্পা থেকে বড়ো বড়ো প্যাঁড়াসন্দেশ নিয়েও আসতে পারেন।
কী ভাবে যাবেন
যে কোনো জায়গা থেকে ট্রেনে বরকাকানা বা রাঁচি আসুন। ট্রেনের সময়ের জন্য দেখে নিন erail.in। বরকাকানা জংশন স্টেশন থেকে ম্যাজিক ভ্যান বা অটোয় চেপে চলে আসুন মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরের রামগড় শহরে। রামগড় থেকে ৩২ কিলোমিটার রাজরাপ্পা, দিনভর বাস, ট্রেকার চলে। রাঁচি থেকে রামগড় ৩৭ কিলোমিটার, হাজারিবাগ থেকে রামগড় ৪৮ কিলোমিটার। দু’ জায়গা থেকেই বাস পাওয়া যায়। তা না হলে রাঁচি বা হাজারিবাগ থেকে গাড়ি ভাড়া করে চলে আসতে পারেন। কলকাতার এসপ্ল্যানেড থেকে রাতের বাস ধরে ভোরে নেমে পড়তে পারেন রাঁচিতে।
কোথায় থাকবেন
সাধারণত রাঁচি বা হাজারিবাগ বেড়াতে এসে ঘুরে যাওয়া যায় রাজরাপ্পা। তবু রাজরাপ্পায় থাকার ইচ্ছে হলে থাকতে পারেন ঝাড়খণ্ড ট্যুরিজমের ‘দেবলোক’-এ। ফোন ৮২৪০৩০৯৩২৮, অনলাইন বুকিং http://jharkhandtourism.gov.in।
ছবি: লেখক