কলকাতা দর্শন: দেখে আসুন সেন্ট পল্‌স ক্যাথিড্রাল

St. Paul's Cathedral

ভ্রমণঅনলাইন ডেস্ক: কলকাতা মহানগর এক সাংস্কৃতিক মিলনক্ষেত্র। নানা ধর্ম,  নানা জাতির মিলনকেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছে এই শহর। প্রায় সব ধর্মের উপাসনাস্থল রয়েছে তিলোত্তমা কলকাতায়। আর সেই সব উপাসনাস্থল বহন করে চলেছে এক ঐতিহ্য যা জুড়ে গিয়েছে কলকাতার ইতিহাসের সঙ্গে। পর্যটক ও ইতিহাসপ্রেমী মানুষের কাছে মহানগরীর এই সব দ্রষ্টব্য বিরাট আকর্ষণের। এমনই একটি উপাসনাস্থল হল সেন্ট পল্‌স ক্যাথিড্রাল।           

ইতিহাস

এই গির্জার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ঔপনিবেশিক ইতিহাস। শুধু ধর্মীয় দিক থেকেই নয়, স্থাপত্যের দিক থেকেও এর গুরুত্ব অপিরিসীম।

ইন্দো-গথিক স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এই গির্জা। এটি কলকাতার বৃহত্তম ক্যাথিড্রাল। ভারতের অন্যতম প্রধান ক্যাথলিক গির্জা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ যতগুলি দেশ ছিল তার মধ্যে ভারতের এই কলকাতা শহরেই প্রথম তৈরি হয় এই ক্যাথিড্রাল।

১৮১৯ সালে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মার্কুইস অফ হেস্টিংস-এর অনুরোধে সামরিক ইঞ্জিনিয়ার উইলিয়াম নেয়ারন ফোর্বস এই গির্জার নকশা তৈরি করেন। সেই নকশা অনুযায়ী ক্যাথিড্রাল নির্মাণ অত্যন্ত খরচসাপেক্ষ বলে এ ব্যাপারে আরও এগোনো হয়নি। ১৮৩২ সালে বিশপ ড্যানিয়েল উইলসনের উদ্যোগে ক্যাথিড্রাল নির্মাণের প্রকল্প পুনরায় গৃহীত হয়। বিশপের অনুরোধে উইলিয়াম নেয়ারন ফোর্বস আবার নকশা প্রস্তুত করেন। নরউইচ ক্যাথিড্রালের আদলে সেন্ট পল্‌স গির্জার টাওয়ার ও মোচাকৃতি চূড়াটির রূপদানে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন স্থপতি সি কে রবিনসন। ১৮৩৯ সালের ৮ অক্টোবর ক্যাথিড্রালের শিলান্যাস হয় এবং ঠিক ৮ বছর পরে ওই গির্জা সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এই ক্যাথিড্রাল প্রাচ্যের প্রথম এপিসকোপাল চার্চের মর্যাদা পায়।        

সেন্ট পল্‌স ক্যাথিড্রালের উপাসনাগৃহ।

এই গির্জা তৈরি করতে খরচ হয়েছিল ৪ লক্ষ ৩৫ হাজার ৬৬৯ টাকা। ভারতের আবহাওয়ার উপযোগী করে ইন্দো-গথিক শৈলীতে নির্মিত এই গির্জা দৈর্ঘ্যে ২৪৭ ফুট, প্রস্থে ৮১ ফুট, উচ্চতায় ২০১ ফুট। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে গির্জার চূড়াটি ভেঙে পড়ে, পরে এর পুনর্নিমাণ করা হয়। ১৯৩৪-এর ভূমিকম্পে ফের মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই গির্জা। ক্যানটারবেরি ক্যাথিড্রালের সেন্ট্রাল বেল হ্যারি টাওয়ারের অনুকরণে ১৯৩৮-এ গড়ে ওঠে চুড়ো।

কী দেখবেন

সেন্ট পল্‌স ক্যাথিড্রাল তৈরি হয়ে যাওয়ার পর একে ইংল্যান্ডের নরউইচ ক্যাথিড্রালের সঙ্গে তুলনা করা হত।

১৮৪৭ সালের ৮ অক্টোবর যথাবিহিত উপাসনার জন্য ক্যাথিড্রালকে উৎসর্গ করা হয়। এই উৎসর্গ অনুষ্ঠান স্মরণীয় করে রাখার জন্য রানি ভিক্টোরিয়া রুপোর গিলটি দশটি পাত পাঠিয়েছিলেন। ক্যাথিড্রালের ভল্টেড ছাদ, ধনুকাকৃতি অপ্রশস্ত তীক্ষ্ণাগ্র জানলা, পুব দেওয়ালের রঙবেরঙের কারুকার্য, পশ্চিম দিকের জানলাটিতে ১৮৮০ সালে লর্ড মেয়োর সম্মানে স্যার এডওয়ার্ড বার্ন জোন্‌স-এর নকশা করা রঞ্জন (স্টেনড) কাচে সূর্যাস্তে সূর্যালোকের প্রতিফলন মনোহর। আর ফ্লরেন্টাইন রেনেসাঁ স্টাইলের ফ্রেস্কো দু’টি অনবদ্য। টাওয়ারে রয়েছে পাঁচটি ঘড়ি। সেন্ট পলের জীবনের বিভিন্ন মুহূর্ত, যেমন ‘দ্য অ্যানানশিয়েশন’, ‘দ্য অ্যাডোরেশন অফ দ্য ম্যাজাই’, ‘দ্য ফ্লাইট ইনটু ইজিপ্ট’ ইত্যাদি খোদিত আছে ক্যাথিড্রালের দেওয়ালে। এ সবই স্যার আর্থার ব্লুমফিল্ডের কাজ। ক্যাথিড্রালের পুব দিকের দেওয়ালে সেন্ট পলের জীবনচিত্র আঁকা আছে। এ-ও ব্লুমফিল্ডের আঁকা। লন্ডনের হেনরি উইল্‌স অ্যান্ড সন্‌স-এর তৈরি অর্গানটিও দেখার। এটি এখনও ব্যবহার করা হয়।

কলকাতার দ্বিতীয় বিশপ হিবারের অনবদ্য একটি মূর্তি এই ক্যাথিড্রালে রয়েছে। দ্বিতীয় বিশপের ‘হাঁটু মুড়ে বসে থাকা’ সেই ভাস্কর্য তৈরি করেন ভাস্কর ফ্রান্সিস লেগ্যাট চ্যান্ট্রে।

গথিক শৈলীর জানলা।

ক্যাথিড্রাল চত্বরে পশ্চিম দেহলির পাশেই রয়েছে একটি লাইব্রেরি। বিশপ উইলসনের উদ্যোগে এই লাইব্রেরি তৈরি করা হয়। এখানে বিশপ উইলসনের একটি ভাস্কর্যও রয়েছে। প্লাস্টিক শিল্পকলা এবং স্মারকদ্রব্যের একটি প্রদর্শশালাও রয়েছে।  

ক্যাথিড্রালের পাশেই রয়েছে বিশপ্‌স হাউস, অনবদ্য স্থাপত্যশৈলীর আরও এক নিদর্শন। ক্যাথিড্রালের বাগানটিও দেখার মতো। এই উদ্যানে ৬৪ প্রজাতির গাছ আছে।

বিশপ ড্যানিয়েল উইলসন, অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি স্যার জন প্যাক্সটন নরম্যান, ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার আর্থার উইলিয়াম গার্নেট প্রমুখকে এই সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালে সমাধিস্থ করা হয়। গির্জা সংলগ্ন সমাধিস্থলে এঁদের সমাধি রয়েছে।

কোথায় এই গির্জা, কী ভাবে যাবেন  

এটি কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পূর্বে ময়দানের দক্ষিণ প্রান্তে ক্যাথিড্রাল রোডে অবস্থিত। ক্যাথিড্রালের এক পাশে রয়েছে বিড়লা প্ল্যানেটেরিয়াম ও অন্য পাশে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস।

ময়দান মেট্রো স্টেশন থেকে হেঁটে চলুন। হাওড়া ও শিয়ালদহ স্টেশন-সহ কলকাতার প্রায় সব জায়গা থেকেই বাস আসে। বিড়লা প্ল্যানেটেরিয়াম স্টপে নেমে একটু হেঁটেই ক্যাথিড্রাল। হাওড়া, শিয়ালদহ, কলকাতা স্টেশন বা কলকাতা বিমানবন্দর থেকে বাস, ট্যাক্সি বা গাড়ি ভাড়া করেও আসতে পারেন।  

উপাসনাবেদী।

দর্শনের সময়

জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রবেশাধিকার রয়েছে এই সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালে। সাধারণত সকাল ৯টা থেকে ১২টা এবং বিকেল ৩টে থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত খোলা এই গির্জা। রবিবার সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত খোলা। তবে করোনা অতিমারি পরিস্থিতির জন্য এখন কিছু বিধি মেনে চলা হচ্ছে। ক্যাথিড্রালের সামনেই লেখা রয়েছে অতিমারি সংক্রান্ত বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ। উত্তরের স্যার উইলিয়াম প্রেন্টিস মেমোরিয়াল গেট দিয়ে ক্যাথিড্রালে প্রবেশ করতে হয়।

আরও পড়ুন: কলকাতা দর্শন: দেখে আসুন ট্রাম মিউজিয়াম ‘স্মরণিকা’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *