নিজেকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে ইদানীং। ক্যালেন্ডারে লাল কালি দেখলেই, পল্টু উঠছে লাফিয়ে। চলো পালাই, কিছু করে দেখাই। আর পড়ে যাচ্ছি দোটানায়, না গেলে ছুটি নষ্ট, আর গেলে বউ রুষ্ট। আবার সর্বদা সে সঙ্গে যাবে, তা-ও না। যেতে বললে হাজারো টালবাহনা, আর নিয়ে না গেলে নীরবে গঞ্জনা।
শান্তিপুর থেকে ফেরার পরই দোলযাত্রার ছুটি। অনেকদিন আগেই ছেড়েছি রঙখেলা, তা বলে বাড়ি বসে কী করি, তাই আবার পালানো। সঙ্গে ভায়রাভাই স্বপন, সহযাত্রী তার গিন্নী মানে আমার শ্যালিকা এবং তাদের কন্যা। গন্তব্য ইলামবাজার ছাড়িয়ে কাঁকসা দেউল পার্ক। তখন অবশ্য জানতাম না জয়দেবের অপর পাড়ে এর অবস্থান। মূলত গাছগাছালি দেখা আর অবকাশ যাপনের উদ্দেশ্যেই এই দেউল-যাত্রা। দোলের আগের দিন সন্ধ্যাতেই সশরীরে হাজির শ্যালিকার ঘরে, পর দিন সকাল সকাল ভোকাট্টা হওয়ার হাতছানি যে!
শ্বশুরকূলের জ্ঞাতিগুষ্টিতে আমার খাতির ভালোই। কমবেশি সকলেই পছন্দ করে এক ‘তিনি’ ছাড়া। তাঁর কাছে এখনও প্রিয়পাত্র হয়ে উঠতে পারিনি, শত প্রচেষ্টাতেও। তবে শ্বশুরকূলে আমার সাম্রাজ্যে সে ফাটল ধরাতে ব্যর্থ, বরং আমার বিরুদ্ধে নালিশ করলেই অবধারিত বাক্যবাণ জোটে তার কপালে। আমি তখন মিটিমিটি হাসি আর সে জ্বলে বেগুনপোড়া।
যাক, বউয়ের গুণগান বন্ধ এখন। স্বপনের নিজের গাড়ি, ফুটিসাঁকো মোড় থেকে বাদশাহি সড়ক ধরে রতনপুর পীরতলায় এসে ডান দিক দিয়ে নানুরের পথ ধরল। চল্লিশ বছরের অকেজো জীবনে এ চত্বরে আসা এই প্রথম। মাঝে মাঝে তাই ভাবি, কত কী দেখা হল না এ জনমে। সেটা ভাবতে ভাবতেই দেখে চলি গ্রামবাংলার চলছবি – ধানের গোলা, খামারবাড়ি, পুকুরপাড় ও তেপান্তরের মাঠ, সারি সারি তালগাছ আর পথচলতি মানুষ। আমাদের প্রাত্যহিক চলাফেরাতেই যে কত সহস্র ছবি তৈরি হয় অজান্তে, তারও কি কোনো হিসেব থাকে? জীবননদী বয়ে চলে তার আপন খেয়ালে, জন্মমৃত্যু, সুখদুঃখ, হাসিকান্না নিয়ে বেঁচে থাকাটাও তো এক ধরনের অলৌকিক জলযান, সদা চলায়মান।
রঙের ভয়ে জানলার কাচ তুলে দিয়ে, যান্ত্রিক ঠান্ডার কবলে আমরা চার জন। নানুর বাজারে দাঁড়িয়ে রয়েছি অনেকক্ষণ, দোলের একটা শোভাযাত্রা আসব আসব করেও আসছে না এগিয়ে, তাই রাস্তা স্থির, গতিহীন। করিৎকর্মা স্বপন গাড়ি ঘুরিয়ে অন্য রাস্তা নিল, ফলে দেখা হয়ে গেল আরও বেশ কিছু নতুন জনপদ।
বোলপুরের রাস্তাঘাট প্রায় স্তব্ধ তখন। প্রভাতফেরির শোভাযাত্রা শেষ হয়েছে সদ্য, কাতারে কাতারে লোক রাস্তায় নেমে বসন্তের রঙে রাঙিয়ে তুলেছে নিজেদের। আন্তর্জাতিক পরিচিতপ্রাপ্ত বোলপুরের সামগ্রিক চিত্র কোনোদিনই আমার মন ভরাতে পারে না, আরও পরিষ্কার, আরও সুশৃঙ্খল, আরও সবুজ নিয়ে রবি ঠাকুরের বোলপুরকে আমি দেখতে চাই। কিন্তু কংক্রিট-সভ্যতার বাস্তবতায় সে সুযোগ ইহজীবনে যে আর আসবে না, তা-ও জানি।
পুলোমাদি বলেছিলেন, জানো, শহুরে জীবনের জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে, আমেরিকার বহু শহরের নাগরিক, নগরসভ্যতা ছেড়ে মফস্সল বা গ্রামে সাধারণ খামারবাড়িতে শুরু করেছে দিনযাপন। নিয়ন আলো ব্যর্থ তাদের প্রাণকে আলোকিত করতে। সাধারণ জীবনযাত্রার অতি সাধারণ উপকরণ নিয়ে, তারা এখন বেজায় খুশি। ভোগবিলাস ত্যাগ করে প্রথম বিশ্বের হাজারো হাজারো নরনারী কেমন ভাবে চলে এসেছে আমাদেরই মায়াপুরে, ভেবে দেখুন। এ সব খবরে আমি মনের জোর পাই, বুঝতে পারি আলেয়ার পিছনে ছুটে নরকযন্ত্রণা ভোগ করার চেয়ে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে নিশ্চিন্তের ঘুম ঘুমোনো অনেক ভালো।
বোলপুর-ইলামবাজার সড়কের এক পাশেই প্রস্তাবিত বিশ্ববাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের জমিখানি চোখে পড়ল, কাগজে অনেক লেখালেখি পড়েছি এ নিয়ে। আরও কিছুটা এগোনোর পর শুরু হল শাল পিয়ালের জঙ্গল, রাস্তার দু’ধারে। গাছের ডালপালার মধ্য দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছে সূর্যের সোনালি আলো, ফাগুনের মাতাল বাতাসে ঝরে পড়ছে পর্ণমোচী বৃক্ষরাজির পুরালো পত্রপল্লব, আর দিনকয়েকের মধ্যেই নতুন সবুজে সেজে উঠবে এ বনাঞ্চল। সম্ভাব্য সে সাজের দৃশ্যকল্পে বিভোর হল মন। ইলামবাজার থেকে পানাগড়-মোরগ্রাম জাতীয় সড়ক ধরে কিছুটা এগিয়ে বাম দিকে ঘুরে গেল আমাদের বাহন গুগল বাবার নির্দেশনায়, যার বুদ্ধির ঝলকে মনে হচ্ছে যেন কেউ ওপর থেকে খেয়াল ও নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের নিয়ে চলেছে গন্তব্যের দিকে।
চলে এলাম জয়দেব কেঁদুলি, জলশূন্য অজয়ের বুকে বালির বাঁধ, তার ওপর দিয়ে পার হয়ে দেউল পার্কের দরজায়। কাজলডিহি পার হতেই গাছগাছালির ফাঁকেই উঁকি দিল রাঙা পলাশ। ঝামেলা হল দেউল পার্কে, ঠাঁই নাই, আর ঠাঁই নাই। তবে? নিশিযাপন করব কী ভাবে? অবসর আমোদের বুঝি দফারফা। পার্কের একজন খবর দিল, সামনে ‘অবকাশ’ নামে আর একটি আস্তানা আছে, দেখুন পান কিনা। গাড়ি কিছুটা এগোতেই নজরে পড়ল ইছাই ঘোষের সুউচ্চ দেউল। তার পরেই জঙ্গল শুরু। জঙ্গলপথ ধরে এগোতে এগোতেই দেখি আগে আগে আরও দু’টি গাড়ি। আগেভাগে যাতে ওরা ঘর দখল করতে না পারে, সেই ভেবেই গাড়ি থেকে নেমে দুই ভাই ঊর্ধশ্বাসে দিলাম দৌড়। ওরে বাবা, গিয়ে শুনি, ওঁরা মালিকের আত্মীয়-পরিজন, আজ আর ঘর পাওয়া যাবে না। তবে এক বয়স্কা ভদ্রমহিলা বললেন, একটু দাঁড়িয়ে যান, জয় আসুক, বলে দেখবেন একবার। বুঝলাম এ ওপরওয়ালার স্পষ্ট ইঙ্গিত, বয়স্ক লোকজন আমি এমনিতে পছন্দ করি, তাঁরা যখন চাইছেন, তখন হয়ে যাবে নিশ্চয়।
ডাক্তার নবারুণ ভট্টাচার্য ওরফে জয় এলেন ইনোভা চেপে, সঙ্গে পরিবার। আর্জি পেশ হল, লহমায় হয়ে গেল মুঞ্জুর, এক ফাঁকে অন্যের নজর এড়িয়ে খোদাতালাকে ধন্যবাদ দিয়ে দিলাম। ডাক্তারবাবু জানালেন, স্বজন-পরিজন নিয়ে আসলে ওঁরা রঙ খেলতে এসেছেন। ফি বছরই আসেন, সন্ধে হলেই ফিরে যাবেন, আমরা বেলাটুকু যেন একটু মনিয়ে নিই। পরে আবার খাওয়ার ব্যবস্থাও করে দিলেন উনি। একটু দেরি হবে হয়তো, তবে তা মেনে নিলাম সাদরে।
অজয়ে জল নেই, তার শুকনো খাত পড়ে রয়েছে আগামী বর্ষার অপেক্ষায়। ডাক্তারবাবু জানালেন, বর্ষায় অজয় উঠে আসে দ্বারে। সে সময়ের সেই জলছবি চোখে নিয়ে, মনে এঁকে, আমরা সবুজের মাঝে গেলাম হারিয়ে। গৌরাঙ্গপুর মৌজার শিবপুর বিটের এই জঙ্গলটিতে রয়েছে একটি হরিণ পুনর্বাসন কেন্দ্র, সহজেই চোখে পড়ে হরিণের সমাবেশ। যদিও এই কেজো তথ্যের বাইরে শুধু জঙ্গলের নির্জনতাই আমায় হাতছানি দেয় বেশি। খুব বড়ো গাছ নয়, আকাশ দেখা যায় দিব্যি, কিন্তু কোলাহলমুক্ত, পথিকহীন লাল মোরামের পথ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলে গিয়েছে অজানার সন্ধানে। সে পথে হাঁটতে হাটঁতে চকিতে চোখ পড়ে কোনো ময়ূরের ওপর, পদচারণার শব্দে তারা সচকিত হয়ে ওঠে। নানা বৃক্ষ আর নাম-না-জানা নানান ফুল ও বাহারি পাতা আমার নজর এড়ায় না। আপাদমস্তক লাল পাতায় সজ্জিত এমনই একটি গাছ দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম সহসা ।
বনকাটি গ্রাম পঞ্চায়েতের গৌরাঙ্গপুরে মেরেকেটে ১১০ জন লোকের বসবাস। রীতিমতো লোভনীয় পরিসংখ্যান। মনে মনেই বললাম, পাকাপাকি এখানে চলে এলেও বেশ হয়। এমনিতে নিজের চাহিদা খুব কম, দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের ব্যবস্থা আমি করে নিতে পারব ঠিক প্রকৃতির সহযোগিতায়, এখানে। গোপরাজা ইছাই ঘোষের দেউল আবার অবাক করে। ইট নির্মিত বিগ্রহবিহীন এই মন্দিরটি মধ্য-অষ্টাদশ শতকে নির্মিত। অনুমান করা হয়, ইছাই ঘোষ সম্ভবত দেবী ভগবতীর জন্য নির্মাণ করেন এই মন্দির। সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে জঙ্গলের মাথায়, শ্বেত শুভ্র আলো নিয়ে আকাশে জেগে উঠছে দোল পূর্ণিমার রুপোলি চাঁদ। একটু পরেই তার আলোয় ভেসে যাবে চরাচর। সারা দিনের নানান রঙের রেশ, স্নিগ্ধ সাদারজোছনায় হয়ে উঠবে মায়াময়।
ডাক্তারবাবুর কল্যাণেই খোলা আকাশের নীচে, শুষ্ক অজয়কে পাশে নিয়ে, চাঁদের আলোয় চৌকিতে বসে খাওয়ার সৌভাগ্য হয়ে গেল। কোথায় লাগে ডাইনিং টেবিলের সভ্যতা, খাওয়ার কেতা আর বাধ্যবাধকতার নৈশ আহার। মন ভরে গেল, ঘুম ভাঙল আদিম সত্তার, যেন আমি এই অরণ্যেরই লোক, বাড়ি-ঘর, মা-বাবা, সমাজ-সভ্যতার কোনো আকর্ষণ বিকর্ষণ নেই আর। এখানেই যেন আাসার কথা ছিল আমার। অনেক অনেক রাত পর্যন্ত সেই নির্জনতায় চুপচাপ একা একা বসে থেকে থেকে নাগাল পেলাম সেই আমিত্বের যা আত্মগোপন করেছিল নানান ঠিক ভুলের কুঠুরিতে, আমারই হৃদয়ের গহীন গহনে, বহু দিনের তরে।
পর দিন সকালে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করলাম অরণ্যের অন্দরে। বন্যজন্তুর ভয় নয়, পাচ্ছিলাম মানুষেরই ভয়। অজ্ঞাত জায়গা, কেউ নেই, কোত্থাও নেই। শুধুই পাতা ঝরার নৈবর্ত, বহতা বাতাসের আলাপ আর জঙ্গলের অস্পষ্ট অথচ নিবিড় নির্জনতার আহ্বান। মাঝে মাঝে স্থানীয় কেউ কেউ চলে যায় নিজ কাজে মোরামপথ ধরে। প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষগুলিকে দেখে মায়া হয়, হয় হিংসাও। হিংসা হয় প্রকৃতির সান্নিধ্যে তারা থাকতে পারে বলে। জঙ্গলেই তাদের সকাল, দুপুর, সাঁঝ ও রাত্রি ঘনায়, প্রকৃতিই থাকে তাদের দৈনন্দিন ভাব ভালোবাসার সাথী হয়ে, সম্বৎসর।
জঙ্গলের অভ্যন্তরে আবিষ্কৃত হল মেধসাশ্রম শ্রীশ্রী গড়চণ্ডীধাম। মহাপুরাণ ও মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে সুরথ রাজা নিজ রাজধানী বোলপুর-সুপুর হতে বিতাড়িত হয়ে এই অরণ্য শবর কিরাতভূমিতে অবস্থানকালে, মেধসমুনির আদেশে মৃণ্ময়ী দুর্গাদেবীর প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা শুরু করেন। তাঁর হাত ধরেই বঙ্গপ্রদেশের রাঢ় বাংলায় মেধসাশ্রমে প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন হয়। গড়ের মধ্যে রয়েছে আরও অনেক দেবদেবীর মন্দির ও বিগ্রহ।
মন্দির দর্শনের পর সটান যাওয়া হল অজয়ের কিনারায়। ধু-ধু বালি, আগাছা আর হেথা হোথা আবদ্ধ নোংরা জল অবলীলায় আপনার মন খারাপ করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি নিয়ে মানুষের নিরন্তর অপব্যবহারের মাশুল যে একদিন আপনার আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও আগত পৃথিবীকে গুণতে হবে তা মালুম হবে অজয়কে দেখে। মানুষের লোভ-লালসা আর অবিবেচনা যে ধরণীকে একটু একটু করে ধ্বংসের দিকে নিয়ে চলছে প্রতিনিয়ত, তা অনুধাবন করার জন্য কোনো বৈজ্ঞানিক হওয়ার প্রয়োজন নেই, আপনার সংবেদনশীল মনই আপনাকে ইঙ্গিত দিয়ে দেবে, সুস্পষ্ট ভাবে।
এক রকম বিষন্নতা নিয়েই ফিরলাম ‘অবকাশ’-এ। স্নান-খাওয়া সেরে পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে এগোলাম সভ্যতার পথে। পিছিয়ে যেতে থাকল বনকাটি, দেউল পার্ক, কাজলডিহি। পথের বাঁকের পলাশ গাছটিকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি থামল জয়দেবের রাধাবিনোদ মন্দিরের সম্মুখে। জায়গাটি কেন্দুবিল্ব, বর্তমান নাম কেঁদুলি। ইটনির্মিত ও চতুবর্গ এই মন্দিরগাত্রের নকশি ইটে রয়েছে বিষ্ণুর দশ অবতার ও রামায়ণী কাহিনিচিত্রের বর্ণনা। বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচাঁদ বাহাদুর এর নির্মাণ করেন, সেটা ১৮৬৩ সাল। কথিত আছে, ভোজদেব ও বামাদেবীর পুত্র, ‘গীতগোবিন্দ’ রচয়িতা বৈষ্ণব কবি জয়দেবের আবাসস্থলে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত। কবি জয়দেব যোগবলে দেহত্যাগ করেন। কেঁদুলিতে রয়েছে তাঁর সমাধিমন্দির। প্রতি পৌষ সংক্রান্তিতে এখানে বিরাট মেলা ও মহোৎসব হয়, সমবেত হয় দেশ-দেশান্তরের নানা বর্ণের, নানা ধর্মের মানুষ। রাধাবিনোদ মন্দিরের পাশেই রয়েছে তিলোত্তমা স্মৃতি কীর্তন ও বাউল মঞ্চ, সেটাও দেখা হল ইতিউতি।
ইলামবাজার-বোলপুর রাস্তায় ফেরার পথে নজরে পড়ল ‘উড ফসিল পার্ক’। গাড়ি ঘুরিয়ে পাকা রাস্তা থেকে চার কিমি জঙ্গলের ভিতরে হদিশ মিলল তার। গ্রামটির নাম আমখই, চারিদিকে জঙ্গল, মাঝে এই আদিবাসী মহল্লা আর সেখানেই গড়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম ও একমাত্র জীবাশ্ম পার্কটি। জীবাশ্ম পড়েছিলাম সেই ছোটোতে, ভূগোল বইয়ের পাতায়। আজ চোখের সামনে, হাত দিয়ে অনুভব করা যায় এতটাই নিকটে তার উপস্থিতি। কোটি কোটি বছর আগে ভূত্বকের নানান প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার দ্বারা এই কাঠ জীবাশ্মের সৃষ্টি যা সাধারণ ভাবে পাওয়া যায় পাললিক শিলায়। ২০০৬ সালে আমখই গ্রামে পুকুর খননের সময় পাওয়া গেছে প্রদর্শিত জীবাশ্মগুলি। আজ থেকে দেড় কোটি বছর আগে অন্ত মায়োসিন যুগের সাক্ষ্য বহন করছে সংগৃহীত ফসিল সমূহ। অতীতে এই অঞ্চলে যে সুবিশাল গভীর বনভূমির অস্ত্বিত্ব ছিল, তার প্রমাণ এই অমূল্য কাষ্ঠ জীবাশ্মের সমাহার।
বন্ধু সেবাব্রত বলে, ভোগবাদের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেলে, মাটির কাছাকাছি ফিরে আসা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না মানুষের। সহজ সরল নির্ভেজাল দিনাতিপাত তাই সর্বদা উপভোগ্য এবং অনুসরণীয়। খড়ের চাল, নিকানো উঠোন, মাটির দেওয়াল, সে দেওয়ালে মেঠো রঙের নানা আঁকিবুকি, কারুকাজ – আমখই আমার হৃদয় হরণ করে। গ্রামবাসীর প্রতি দিনের রোজনামচা, তাদের হাসি ভরা সরল মুখ, ন্যাংটা খুদের পুকুরে ঝাঁপ আর এই বিস্তৃত শাল পিয়ালের মিছিল আমায় সভ্যতায় ফিরতে বাধা দেয়। যেতে নাহি দিব বলে পথ আটকায় কখনও বনকাটি, কখনও আমখই, কখনও বা কাজলডিহি।
কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে দুর্গাপুর হয়ে যাওয়া যায় আবার পানাগড়-মোরগ্রাম সড়ক ধরে ১১ মাইল এসে সেখান থেকে বাঁ দিকে রাস্তা ধরে পৌঁছে যাওয়া যায় দেউল পার্ক। অজয় পেরিয়ে জয়দেব কেঁদুলি। আবার কলকাতা থেকে বোলপুর- ইলামবাজার হয়ে জয়দেব কেঁদুলি। নিজস্ব গাড়ি থাকলে সুবিধা।
হাওড়া বা শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেনে পানাগড়, দুর্গাপুর বা বোলপুর গিয়ে সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে দেউল পার্ক ও জয়দেব কেঁদুলি। ট্রেনের সময়ের জন্য দেখে নিন erail.in ।
কোথায় থাকবেন
থাকার জন্য রয়েছে দেউল পার্ক ইকো রিসর্ট (০৯৮৩১৫৫৫৫৯৪), অবকাশ।