ভ্রমণ অনলাইন ডেস্ক: সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বড়নগর গ্রামকে ভারতের ‘সেরা পর্যটন গ্রাম’ হিসাবে সম্মান ও স্বীকৃতি দিয়েছে।
২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস। ভারতের গ্রামগুলিতে পর্যটনকে তুলে ধরার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এই দিবস উপলক্ষ্যে ২০২৩ সাল থেকে ‘সেরা পর্যটন গ্রাম’-এর সম্মান দেওয়া শুরু করে। ৮টি বিভাগে এই সম্মাননা দেওয়া হয়। বিভাগগুলি হল, অ্যাডভেঞ্চার পর্যটন, কৃষি পর্যটন, সম্প্রদায়ভিত্তিক পর্যটন, হস্তশিল্প, ঐতিহ্য, দায়িত্বশীল পর্যটন, আধ্যাত্মিক ও সুস্থতা পর্যটন এবং প্রাণবন্ত পর্যটন।
২০২৪-এ এই সম্মাননা পাওয়ার জন্য দেশের ৩০টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে ৯৯১টি আবেদনপত্র জমা পড়েছিল। তার মধ্যে ৮টি বিভাগে ৩৬টি গ্রামকে ‘সেরা পর্যটন গ্রাম’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কৃষি পর্যটন বিভাগে পুরস্কৃত হয়েছে ৫টি গ্রাম। তাদের মধ্যে অন্যতম হল রানি ভবানীর স্মৃতিধন্য বড়নগর গ্রাম। বাকি ৪টি গ্রাম হল কেরলের কুমারাকোম, মহারাষ্ট্রের কারড়ে, পাঞ্জাবের হনসলি এবং উত্তরাখণ্ডের সুপি।
পরপর দু’ বছর সেরা পর্যটন গ্রামের স্বীকৃতি মিলল মুর্শিদাবাদ জেলার গ্রামের। ২০২৩ সালে ভারতের অন্যতম সেরা পর্যটন গ্রাম হিসেবে মুর্শিদাবাদের কিরীটেশ্বরীকে স্বীকৃতি দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার।
ভবানীশ্বর মন্দির।
কোথায় বড়নগর
মুর্শিদাবাদ জেলার লালবাগ মহকুমার জিয়াগঞ্জ ব্লকের বড়নগর গ্রামকে বলা হয় ‘বাংলার কাশী’। আজিমগঞ্জ সিটি স্টেশন থেকে দেড় কিমি দূরে, জেলাসদর বহরমপুর থেকে দূরত্ব ২১ কিমির মতো।
কেন বিখ্যাত বড়নগর
নাটোর রাজবংশের গঙ্গাবাস ছিল এই বড়নগর। নাটোরের রানি ভবানী অষ্টাদশ শতকে একের পর এক মন্দির গড়ে তোলেন ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত এই বড়নগরে। তাঁর ইচ্ছা ছিল বড়নগরকে তিনি কাশীর মতো করে গড়ে তুলবেন। বড়নগর বিখ্যাত রানির গড়ে তোলা টেরাকোটা মন্দিরগুচ্ছের জন্য।
হস্তশিল্পের জন্যও বিখ্যাত বড়নগর। এখানকার তাঁতশিল্প, পেতল-কাঁসার শিল্প, মৃৎশিল্প এবং বাঁশ-বেতের তৈরি হস্তশিল্প রীতিমতো আকর্ষণ করে। তাঁতশিল্পের জন্য বিশেষ খ্যাতি আছে বড়নগরের। এখানে বোনা হয় বালুচরী, জামদানি আর টাঙ্গাইল শাড়ি। স্থানীয় বাজারে এবং মেলা-উৎসবে স্থানীয় শিল্পীরা নিজেদের তৈরি হস্তশিল্পসমূহ বিক্রি করেন।
কী দেখবেন বড়নগরে
এ যেন আর-এক বিষ্ণুপুর। বড়নগরের মূল আকর্ষণ পোড়ামাটির মন্দিররাজি। আধ কিমি এলাকা জুড়ে ডজনখানেক মন্দিরের সমাবেশ। এই সব মন্দির বিভিন্ন দেবতাকে উৎসর্গ করা – শিব, বিষ্ণু, কালী, দুর্গা।মন্দিরগাত্রে রয়েছে অনন্য পোড়ামাটির কাজ। তাতে মূর্ত হয়েছে রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনি, নানান পৌরাণিক আখ্যান, লোককাহিনি, দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কাহিনি। বাংলার মন্দিরস্থাপত্যের উজ্জ্বল নিদর্শন বরনগরের মন্দিরগুচ্ছ।
প্রথমে দেখে নিন একবাংলা পঞ্চানন শিব। শিববিগ্রহের পাঁচটি মুখ এখানে, তাই শিবঠাকুরের এখানে পঞ্চানন। খিলানে পোড়ামাটির কাজ।
উত্তর দিকে সামান্য যেতেই চারবাংলা মন্দির – ৪টি একচালা বাংলা মন্দির। তিন খিলানযুক্ত চতুষ্কোণ চত্বরের চারদিকে ৪টি মন্দির। দেবতা শিব। পোড়ামাটির অলংকরণে বৈচিত্র্য আছে।
এরই উত্তর-পশ্চিমে ভবানীশ্বর মন্দির। এই অষ্টকোণী মন্দিরে পঙ্খের কাজ অনবদ্য। এটিও শিবমন্দির। অদূরেই রানি ভবানীর কন্যা তারাসুন্দরীর তৈরি গোপালমন্দিরটি আজ দীর্ণ।
জোড়বাংলা – গঙ্গেশ্বর শিবমন্দির।
দুপাশে ভাঙা দুই শিবমন্দির। এদেরই বাঁয়ে রাজরাজেশ্বরী মন্দির। সপরিবার মহিষাসুরমর্দিনী মা দুর্গা এখানে বিরাজ করছেন। বিগ্রহটি অষ্টধাতুর। প্যানেলের দুর্গামূর্তিটি অনবদ্য। এই মন্দিরে মদনগোপাল, জয়দুর্গা, মহালক্ষ্মী, ঘোড়ার মতো গ্রীবাযুক্ত বিষ্ণুও বিরাজমান।
কিছুটা উত্তরে সেই রাজবাড়ি যা রানি ভবানীর নির্মিত এবং যেখানে ১৭৯৫ সালে তিনি দেহ রেখেছিলেন। রাজবাড়ির অনেকটাই বিধ্বস্ত। তবে রাজপরিবারের উত্তরপুরুষরা কিছু কিছু সংস্কার করেছেন। এখানে তৈলচিত্রে রাজপরিবারের বংশপরিচয় পাওয়া যায়।
রাজবাড়ি থেকে আরও উত্তরমুখী যেতে অষ্টভুজ গণেশমন্দির। এখানকার টেরাকোটার কাজ খুবই সুন্দর। এর আরও কিছুটা উত্তরে রানি ভবানীর গুরুবংশের মঠবাড়ি। এখানে রয়েছে কয়েকটি কালীমন্দির ও শিবমন্দির। বিপরীতে জোড়বাংলা – গঙ্গেশ্বর শিবমন্দির। আরও খানিকটা উত্তরে কিছুটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে বড়নগরের সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির চারচালা গঠনশৈলীর রামেশ্বর মন্দির।
কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন
বড়নগর বহরমপুর থেকে ২১ কিমি, মুর্শিদাবাদ থেকে ১০ কিমি, জিয়াগঞ্জ থেকে ৪ কিমি এবং আজিমগঞ্জ সিটি স্টেশন থেকে দেড় কিমির মতো। কলকাতা থেকে বড়নগরের দূরত্ব ২৩০ কিমির মতো। সরাসরি গাড়িতে চলে যেতে পারেন। কিংবা ট্রেনে বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ, জিয়াগঞ্জ বা আজিমগঞ্জ পৌঁছে গাড়িতে চলে যেতে পারেন। তবে আজিমগঞ্জ থেকে ইচ্ছা করলে হেঁটেও যাওয়া যায়।
থাকার জন্য চার জায়গাতেই হোটেল পাবেন। গুগুল সার্চ করলে পেয়ে যাবেন। আর পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগমের হোটেল রয়েছে বহরমপুর ও মুর্শিদাবাদে। অনলাইন বুকিং wbtdcl.wbtourismgov.in।