অল্পচেনা হিমাচলে/১

মাশোবরার পথে। ছবি: শ্রয়ণ সেন
শম্ভু সেন

চলেছি চণ্ডীগড়ের পথে। রাজঘাটের পাশ দিয়ে যেতে যেতে রাস্তায় পথনির্দেশের সাইনবোর্ড চোখ পড়ল —  চণ্ডীগড় ২৬০ কিমি। তখনই মনে পড়ল ২০২০-এর শেষ দিকের কথা। এই পথেই তো পড়বে সেই জায়গা যেখানে দিনের পর দিন অবস্থান করেছিলেন হরিয়ানা ও পঞ্জাবের কৃষকরা। কেন্দ্রের নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিলেন উত্তর ভারতের কৃষকেরা। দিল্লি যাত্রার ডাক দিয়েছিলেন কৃষক নেতারা। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে হরিয়ানা আর পঞ্জাবের হাজার হাজার কৃষক নেমেছিলেন পথে। দলে দলে তাঁরা চলেছিলেন দিল্লির পথে। শেষ পর্যন্ত দিল্লি পুলিশ তাঁদের গতিরোধ করে হরিয়ানা-দিল্লি সীমানায়। জায়গাটার নাম সিংঘু বর্ডার। এই সিংঘু বর্ডারে দিনের পর দিন  অবস্থান করেন প্রতিবাদী কৃষকেরা। অবশেষে কৃষকদের আন্দোলনের চাপে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় সরকার।

শ্রয়ণের ‘ট্র্যাভেলিজম’-এর সঙ্গী হয়ে অচেনা, অল্পচেনা হিমাচল দর্শনের অভিলাষে কলকাতা থেকে রওনা হয়েছিলাম গত পরশু বিকেলে। রাজধানী এক্সপেসে সওয়ার হয়ে নিউ দিল্লি এসে পৌঁছোলাম কাল সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ। প্রায় আধঘণ্টা লেটে। নিউ দিল্লি স্টেশন থেকে আমাদের ১০ জনের দলকে তুলে চণ্ডীগড়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য হাজির ছিল একটা ইনোভা আর একটা সুইফট্ ডিজায়ার। গুছিয়ে বসে স্টেশন থেকে রওনা হতে হতে প্রায় ১১টা। মিনিট পঁয়তাল্লিশ পর পৌঁছে গেলাম সেই সিংঘু বর্ডারে, যে জায়গা ২০২০-এর পরেও মাঝেমাঝেই উঠে এসেছে খবরের শিরোনামে। জায়গাটা দেখেই কৃষক আন্দোলনের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। এখনও তার চিহ্নগুলো রয়ে গিয়েছে সেখানে। সেই কংক্রিটের ঢাউস ব্যারিকেডগুলো একদিকে সার করে সরানো। রয়েছে পুলিশের গার্ড রেলগুলোও।

এগিয়ে চললাম। সোনপত ছাড়িয়ে কিছুটা যেতেই মধ্যাহ্নভোজের বিরতি। সামনেই রিয়্যাল পাঞ্জাবি ধাবা। ঠিক ধাবা বলতে যে ছবি ভাসে এ ধাবা সে ধাবা নয়। একেবারে সাজানোগোছানো শীততাপনিয়ন্ত্রিত আধুনিক রেস্তোরাঁ, বিশাল এলাকা জুড়ে। যে যার মনোমত খাবার নিল। আমরা তিনজন পছন্দ করলাম ভেজ চাও আর লস্যি। পেটপুজো সেরে ফের রওনা হতে হতে সোয়া ১টা। 

মাশোবরা থেকে। ছবি শ্রয়ণ সেন

পৌনে ২টো নাগাদ পেরিয়ে গেলাম পানিপথ। সেই পানিপথ, যেখানে যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদিকে পরাস্ত করে এ দেশে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাবর। সেই পানিপথ, যেখানে হঠাৎ বনে যাওয়া দিল্লিরাজ হিমুকে হারিয়ে সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করেছিলেন আকবর। সেই পানিপথ, যেখানে আফগান সম্রাট আহমদ শাহ দুরানির সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল মারাঠা বাহিনীর। পানিপথ পেরোতে পেরোতে বোঝার চেষ্টা করছিলাম ঠিক কোথায় যুদ্ধ হয়েছিল। বিশাল সাজানোগোছানো শহর। পথের ধারে রানা প্রতাপের মূর্তি। কেন, তা বুঝতে পারলাম না।

গীতা উপদেশস্থলি কুরুক্ষেত্র মেঁ আপকা স্বাগত – ঘণ্টাখানেক পরে সারা পথ জুড়ে বিশাল সাইনবোর্ড। মধ্যযুগ থেকে অনেক পিছিয়ে গেলাম — মহাভারতের সময়ে। পানিপথ থেকে চলে এলাম কুরুক্ষেত্রে – এক যুদ্ধস্থল থেকে আর-এক যুদ্ধস্থলে। যথারীতি গাড়ির জানলা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম ঠিক কোথায় ছিল যুদ্ধস্থল। ঠাওর করতে পারলাম না। বাঁদিকে পড়ল ব্রহ্ম সরোবর। না, সরোবর নজরে আসেনি, সাইনবোর্ডে দেখলাম। তা এই কুরুক্ষেত্র এলাকা পেরোতে আমাদের সোয়া ঘণ্টামতো লাগল। কারণ এই সোয়া ঘণ্টা পরেই রাস্তা জুড়ে আবার দেখলাম সাইনবোর্ড — ধর্মনগরী কুরুক্ষেত্র মেঁ যাত্রা কে লিয়ে আপকো ধন্যবাদ। না, পথের হিসেবটা সোয়া ঘণ্টা নয়। এই সোয়া ঘণ্টা থেকে আধ ঘণ্টা বাদ যাবে। মন্নত হাভেলিতে চা খেয়েছি, ছবি তুলেছি। এতে আধ ঘণ্টা সময় গিয়েছে। সুতরাং কুরুক্ষেত্রের দুটি সাইনবোর্ডের মাঝের দূরত্ব পেরোতে আমাদের পৌনে একঘণ্টা সময় লেগেছে। কিন্তু এতটা দূরত্বের মধ্যে কুরুক্ষেত্রের কোনো প্রাচীনত্বের চিহ্ন পেলাম না।

সূর্যাস্তের পরে রঙের খেলা। মাশোবরা। ছবি শ্রয়ণ সেন

অবশেষে আম্বালা ক্যান্টনমেন্ট পেরিয়ে চণ্ডীগড় শহর অনেকটা ভেদ করে যখন আমাদের নির্দিষ্ট হোটেলে এসে পৌঁছোলাম তখন ঘড়িতে সাড়ে ৫টা বাজে।

আমাদের প্রথম গন্তব্য মাশোবরা। শিমলা থেকে নলদেরা-তাতপানি যাওয়ার পথে পড়ে মাশোবরা। পাইন-দেওদারে ছাওয়া মাশোবরা গ্রাম ক্রমশ উঠে আসছে হিমাচলের পর্যটন মানচিত্রে।

প্রাতরাশ সেরে চণ্ডীগড়ের হোটেল থেকে রওনা হয়ে গেলাম সকাল সাড়ে নটা নাগাদ। এই পথে আবার চলেছি ১৩ বছর পরে। তবে মাঝে একবার এসেছিলাম হিমাচলে বছরসাতেক আগে। কিন্তু সেবার চণ্ডীগড় থেকে পিঞ্জোর গার্ডেন হয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম বিলাসপুরের পথে।কালকাকে বাইপাস করে পরোয়ানু হয়ে কিছুটা এগোতেই পাহাড় ক্রমশ কাছে চলে এল। তারপর তো পাহাড়ই সঙ্গী। পাহাড় ভেঙে ক্রমশ উপরে উঠতে শুরু করলাম। পেরিয়ে এলাম ধরমপুর, পেরিয়ে এলাম বারোগ।

পাহাড়ের কোলে আলোর মেলা। মাশোবরা। ছবি শ্রয়ণ সেন

এ পথে বারোগ এলেই মন চলে যায় ১৯৯৭-এর স্মৃতিতে। তখন পুত্র শ্রয়ণ তথা ঋভুর ছ’বছর। সেবার কালকা থেকে শিমলা গেছিলাম টয় ট্রেনে। টয় ট্রেনে বারোগ টানেলের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে এই টানেলের গল্প শোনাতে হয়েছিল ঋভুকে। কালকা-শিমলা পথে রয়েছে ১০৩টে টানেল।  এর মধ্যে বারোগ টানেল দীর্ঘতম – ১.১৪ কিমি। ১৯০০ সালের গোড়ার দিকে এই টানেল তৈরি করার দায়িত্ব পান ব্রিটিশ ইনজিনিয়ার কর্নেল বারোগ। কাজ শুরু করার পর কিছুতেই আর শেষ করতে পারছিলেন না বারোগ। টানেলের দৈর্ঘ্য বেড়েই চলেছে। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার তাঁকে কাজ থেকে বরখাস্ত করে জরিমানা করে। অপমানে, লজ্জায় বারোগ আত্মঘাতী হন। ওই নির্মীয়মাণ টানেলের মুখেই বারোগকে সমাহিত করা হয়। পরে এই টানেলের কাজ শেষ করেন আর-এক ব্রিটিশ ইনজিনিয়ার এইচ এস হ্যারিংটন। কিন্তু বারোগের স্মৃতিতে এই জায়গার নাম হয় বারোগ।

কালকা-শিমলা পথে নগরায়ন দেখে চমকে গেলাম। জাতীয় সড়ক পাঁচ অনেক জায়গাতেই চার লেনের। রাস্তার দুধারে, আশেপাশের পাহাড়ের ঢালে ক্রমশই গজিয়ে উঠছে কংক্রিটের জঙ্গল। পেরিয়ে গেলাম সোলান, কান্দাঘাট, তারাদেবী। 

শিমলা শহর পেরোতেই আমাদের আধ ঘণ্টা লেগে গেল। টয় ট্রেনের স্টেশন, ম্যাল যাওয়ার রাস্তাকে ডানদিকে রেখে ধরলাম কুফরির পথ। কিছুক্ষণ পর পথ হল দুভাগ। ডানদিকের উপরের পথ চলে গেল কুফরি-ফাগু-নারকান্ডা হয়ে। আমরা ধরলাম বাঁহাতি পথ। অল্পবিস্তর নেমে এল। কংক্রিটের জঙ্গল শেষ। পাইন, দেওদারের জঙ্গল ঘিরে ধরল আমাদের। প্রাণ জুড়োল।

একটু পরেই পৌঁছে গেলাম মাশোবরা। ঘড়িতে তখন ২টো। ২১৪৯ মিটার উঁচুতে অবস্থিত মাশোবরা প্রথম দর্শনেই প্রেমে জড়িয়ে নিল। এ যেন আর-এক পাতনিটপ। পাইন-দেওদারের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে পিচঢালা পথ। বিকেলে সেই পথে হাঁটাহাঁটি, আর হোটেলের বারান্দা থেকে সূর্যাস্ত দর্শন। আপাতত আমাদের ঠিকানা মাশোবরা।

আরও ভ্রমণ কাহিনি পড়ুন এখানে ক্লিক করে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *