শতদ্রু পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম তত্তাপানিতে। শিমলা জেলা ছেড়ে মান্ডি জেলায়। একটু এগোতেই বাঁদিকে নজরে পড়ল ‘হট স্প্রিং’-এর সাইনবোর্ড। আমাদের ট্র্যাভেলার বাস থেমে গেল। একে একে সবাই বাস থেকে নেমে বাঁধানো উতরাই পথে সামান্য এগিয়ে গেলাম। একটু গিয়েই থমকে গেলাম। কোথায় ‘হট স্প্রিং’? এ তো ‘হোটেল হট স্প্রিং’। হতেই পারে। তত্তাপানির খ্যাতি তার উষ্ণ প্রস্রবণের জন্য। সুতরাং এখানে ‘হট স্প্রিং’-এর নামে হোটেল থাকতেই পারে। কিন্তু তাহলে উষ্ণ প্রস্রবণ কোথায়?
আমাদের উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরতে দেখে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলেন একজন। তাঁর কাছেই জানতে পারলাম, উষ্ণ প্রস্রবণ হোটেলের মধ্যেই। কীভাবে সেখানে যেতে হবে তাও বুঝিয়ে দিলেন তিনি। তাঁর নির্দেশিত পথে আমরা হোটেলর মধ্যে দিয়েই উষ্ণ প্রস্রবণে পৌঁছে গেলাম। অত্যন্ত সুন্দর পরিচ্ছন্ন ঘেরা জায়গায় একটি চৌবাচ্চা। খুব বেশি হলে কুড়ি ফুট লম্বা, ফুটদশেক চওড়া আর ফুটতিনেক গভীর। পরিচ্ছন্ন নীল জল। হাত দিয়ে দেখলাম। বেশ গরম সন্দেহ নেই। আমরা বিস্মিত। এরকম উষ্ণ প্রস্রবণ কল্পনায় ছিল না। বক্রেশ্বর দেখেছি, তপ্তপানি দেখেছি, মানালির বশিষ্ঠ কুণ্ড দেখেছি। সেখানে গরম জলে দাপিয়ে বেড়ান স্নানার্থীরা। এখানে কোনো স্নানার্থীর চিহ্নই নেই। এরকম জনমনিষ্যিশূন্য সফিসটিকেটেড উষ্ণ প্রস্রবণ কখনও দেখিনি। বিশ্বাস হচ্ছে না, এটাই তত্তাপানির উষ্ণ প্রস্রবণ। অথচ হোটেলকর্মীরা তো বলছেন এটাই আসল হট স্প্রিং।
প্রস্রবণের জল ছুঁয়ে চলে এলাম হোটেলের পিছনের অংশে। সামনেই বয়ে যাচ্ছে শতদ্রু। তারই পাড়ে একটা ঘেরা জায়গায় সুন্দর বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে হোটেলের তরফে। হোটেলকর্মীরা এরই ফাঁকে তাঁদের হোটেল নিয়ে আমাদের কাছে প্রচার করছেন। ইচ্ছা করলে আমরা এখানে দুপুরের ভোজন সারতে পারি, আধঘণ্টায় বডি ম্যসাজ করাতে পারি ইত্যাদি ইত্যাদি।
নজরে পড়ল বাঁদিকে শতদ্রুর ধারে একটি মন্দির। হোটেলের পিছন দিক দিয়ে বেরিয়ে শতদ্রুর পাড় ধরে চলে যাওয়া যায় সেই মন্দিরে। আমরা তা-ই করলাম। সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরের গর্ভগৃহে যাওয়ার আগেই নজরে পড়ল গোটাচারেক ছোট্ট ছোট্ট ঘেরা জায়গা জলভর্তি। খুব বেশি হলে এক-একটি ঘেরা জায়গা একফুট বাই একফুট বাই একফুট। একটি কল থেকে অবিরাম জল এসে ভরিয়ে দিচ্ছে ওই ঘেরা জায়গাগুলি। আর দুটি মুখ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে সেই জল। স্থানীয় মানুষজন বললেন এও উষ্ণ প্রস্রবণ। আমাদের বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, শতদ্রুর পাড়ে একটা বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে ছিল উষ্ণ প্রস্রবণ। শতদ্রুতে ড্যাম হওয়ার ফলে ওই উষ্ণ প্রস্রবণ টুকরো টুকরো হয়ে যায়। তারই একটা অংশকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ‘হোটেল হট স্প্রিং’। আর কিছু কিছু অংশের জল তুলে স্থানীয় প্রশাসন কলের মাধ্যমে সেই জল সরবরাহ করছে।
শতদ্রুর পাড়ের মন্দিরে লক্ষ্মী-নারায়ণকে দর্শন করে ফিরে চললাম। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। তত্তাপানির এই উষ্ণ প্রস্রবণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পুরাণের কাহিনি। মহর্ষি জমদগ্নি এই উষ্ণ প্রস্রবণের জল তাঁর পুত্র পরশুরামকে দান করেছিলেন। উন্নয়নের বানে ভেসে গিয়ে একটা উষ্ণ প্রস্রবণের আদত প্রাকৃতিক চেহারা আমরা রক্ষা করতে পারলাম না।
মাশোবরার হোটেল বেলভিউ থেকে সকাল দশটা নাগাদ বেরিয়ে পড়েছিলাম নলদেরা, তত্তাপানি ঘুরে আসার বাসনা নিয়ে। নলদেরা ১০ কিমি, সেখান থেকে আরও ৩০ কিমি তত্তাপানি। পাইনে ছাওয়া মান্ডিগামী সড়ক ধরে এগিয়ে চললাম। ফেরার পথে নলদেরা দেখব, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা ধরলাম তত্তাপানির পথ। রাস্তা ক্রমশ নেমে চলল। আমরা নামব অনেকটাই – ২১৪৯ মিটার থেকে ৬৫৫ মিটারে। একটু পরেই দেখতে পেলাম শতদ্রুকে। অনেক নীচে। উতরাই পথে যত নামতে লাগলাম ততই শতদ্রু তার আসল চেহারায় ধরা দিতে লাগল। পঞ্চনদের অন্যতম শতদ্রু, হিমাচলের জীবনীশক্তি। সেই শতদ্রু তীরেই তত্তাপানি। দুর্গাপুর, বসন্তপুর, সুন্নি প্রভৃতি জনপদ পেরিয়ে পৌঁছোলাম তত্তাপানি। দেখলাম উষ্ণ প্রস্রবণ। কেমন দেখলাম, তা আগেই বলেছি। দেওয়াল লিখন পড়লে জানা যায়, তত্তাপানিতে উষ্ণ প্রস্রবণ রয়েছে। কিন্তু স্বাভাবিক উষ্ণ প্রস্রবণ খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। ‘হোটেল হট স্প্রিং’ কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা উষ্ণ প্রস্রবণকে রক্ষা করছে। কিন্তু এভাবে হোটেলের মধ্যে তাকে বন্দি করে, সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে?
ফেরার পথে থামলাম নলদেরায়। জনপ্রতি ৩০ টাকার টিকিট কেটে বেশ কিছুটা চড়াই ভেঙে দেখে এলাম আঠারো হোল গলফ্ কোর্স। নলদেরার প্রেমে পড়েছিলেন ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জন। তাঁরই উদ্যোগে তৈরি হয় ওই গলফ্ কোর্স। আর এই গলফ্ কোর্সের মাঝেই রয়েছে মাহু নাগ মন্দির। আদতে ‘নলদেরা’র অর্থ নাগেদের ডেরা অর্থাৎ সর্পের আবাসভূমি। গলফ্ কোর্স ঘুরে দেখার জন্য জনপ্রতি শপাঁচেক টাকায় ঘোড়াও মেলে। দরাদরি করলে হয়তো কমসমও হতে পার।
হিমাচল পর্যটনের হোটেল গলফ্ গ্লেডে মধ্যাহ্নভোছনের পাট চুকিয়ে সোজা চলে গেলাম ২০ কিমি দূরের অতিপরিচিত শিমলায়। ম্যালকে বুড়িছোঁয়া করে যখন মাশোবরার হোটেলে ফিরলাম তখন সন্ধ্যা সমাগত। আগামীকাল আমাদের গন্তব্য পব্বর নদীর তীরে রোহরু।
আগের পর্ব পড়ুন: অল্পচেনা হিমাচলে/১