
তেরো বছর পরে এ পথে আবার। এ পথেই তো? নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
একটু খোলসা করেই বলি। সালটা ছিল ২০১১। সময়টাও ছিল পুজোর পরে পরেই। নিজেই হিমাচলের ট্যুর প্রোগ্রাম বানিয়েছিলাম। পনেরো দিনের ট্যুর। সেই ট্যুরে প্রথম গন্তব্য ছিল শিমলা। দ্বিতীয় গন্তব্য খাড়াপত্থর। শিমলা আগে বিশদে ঘুরেছি। তাই মাত্র একরাত্রি বাস সেখানে। দ্বিতীয় দিন সকাল থেকে কার্যত আমাদের ভ্রমণ শুরু। কলকাতায় বসেই হিমাচল পর্যটনের হোটেল বুকিং করে রেখেছিলাম। গাড়িও ঠিক করা ছিল। সেই গাড়ি চলে এল শিমলায় হিমাচল পর্যটনের ‘দ্য হলিডে হোম’-এ। আলাপ হল সারথির সঙ্গে। নাম, মদনলাল শর্মা। আমাদের ট্যুর প্রোগ্রাম জানতে চাইলেন সারথি। বললাম। শুনেই বললেন ‘বিলকুল গলদ’। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। ভ্রমণ শুরু হতে না হতেই সারথির যদি এই প্রতিক্রিয়া হয়, তাহলে গোটা ট্যুরটার কী হবে? চিন্তায় পড়লাম। কিন্তু ভেবে কী হবে? ট্যুর তো হবেই আর এই মদনলালকে নিয়েই ট্যুর করতে হবে।

সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ রওনা হলাম শিমলা থেকে। মিনিট পঁয়তাল্লিশের মধ্যে কুফরি-ফাগু হয়ে চলে এলাম থিয়োগে। অত্যন্ত শীর্ণ রাস্তা। ফলে প্রচণ্ড জ্যাম। নারকান্ডাগামী রাস্তা ছেড়ে গাড়ি ঘুরল ডানদিকে। এখান থেকে খাড়াপত্থর ৪৫ কিমি। এই রাস্তা পাড়ি দিতে আমাদের সময় লাগল ঘণ্টাতিনেক। রাস্তার অবস্থা অবর্ণনীয়। ভাঙাচোরা রাস্তা বললে কম বলা হয়। সারথি মদনলালের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি খুব বিরক্ত। বারোটারও পরে পৌঁছোলাম খাড়াপত্থরে হিমাচল পর্যটনের ‘দ্য গিরিগঙ্গা রিসর্ট’-এ। দুদিন ছিলাম সেখানে। রোহরু ঘুরেছি, হাটকোটিতে হাটকেশ্বরী দুর্গামাতাকে দর্শন করেছি। মদনলাল সব জায়গা ঘুরিয়েছেন, কিন্তু মুখে হাসিটি নেই। খাড়াপত্থরে দুদিন কাটিয়ে চললাম তৃতীয় গন্তব্য নারকান্ডায়। মদনলাল অন্য রাস্তা ধরলেন। ধীরে ধীরে মনের মেঘ কেটে গেল সারথির। হাসিমুখ দেখলাম তাঁর। তারপর পরের পনেরো দিনে স্বাভাবিক ভাবেই অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন মদনলাল। কথায় কথায় জানতে চেয়েছিলাম, আমাদের ট্যুর প্রোগ্রামটা শুনেই কেন উনি ‘বিলকুল গলদ’ বলেছিলেন। মদনলাল হেসে বলছিলেন, প্রথমেই খাড়াপত্থরের নাম শুনে তাঁর মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কারণ ওই রাস্তা। ওই রাস্তায় যেতে হবে জেনে তাঁর মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল।

সেই রাস্তাতেই চলেছি। আর মদনলালের বিশেষণটাই প্রয়োগ করে বলছি, ‘বিলকুল’ পালটে গিয়েছে খাড়াপত্থর-হাটকোটি-রোহরুর রাস্তা।
মাশোবরা থেকে রওনা হতে হতে সাড়ে নটা বেজে গেল। চলেছি রোহরু ছাড়িয়ে আরও দশ কিমি। আপাতত দুদিনের ঠিকানা পাব্বর রিভার ক্যাম্পস। মাশোবরা থেকে শিমলার দিকে বেশ খানিকটা গিয়ে গাড়ি ডানদিকের চড়াই রাস্তা ধরল। এটিই কুফরি-ফাগু-নারকান্ডা-রামপুর- কল্পা হয়ে লাহুল-স্পিতি যাওয়ার রাস্তা। পর্যটকদের কাছে খুব পরিচিত রাস্তা। আর কুফরি-ফাগুকে তো শিমলার প্রায় শহরতলি বলা যায়। মনে আছে, ফাগু ছাড়ালে আসবে থিয়োগ। সেখান থেকে আমরা ডানদিকে রোহরুর পথ ধরব। মাশোবরা থেকে ঘণ্টাখানেকের পথ পাড়ি দিয়ে চলে এলাম থিয়োগ। আর এখানেই চক্ষু ছানাবড়া।

তেরো বছর আগে থিয়োগের যে মোড় থেকে ডানদিকে খাড়াপত্থরের পথ ধরেছিলাম, এই মোড় কি সেই মোড়? কত ঘিঞ্জি সংকীর্ণ ছিল সেই মোড়। আর এটা? এ তো বিশাল জায়গা। গাড়ি স্বচ্ছন্দে ঘুরে গেল ডানদিকে। তার পর আমার বিস্ময় ক্রমশ বেড়েই চলল। বিশাল চওড়া অতি মসৃণ পথ। বারবার ফিরে যাচ্ছিলাম আমার তেরো বছর আগের ভ্রমণস্মৃতিতে। এই কি সেই রাস্তা যে রাস্তায় যেতে হবে জেনে মদনলাল আমাদের ভ্রমণসূচি শুনে বলেছিলেন ‘বিলকুল গলদ’? বুঝলাম খাড়াপত্থর-হাটকোটি-রোহরু এখন আর হিমাচলের অফবিট গন্তব্য নয়। পথের ধারের জনপদগুলোও অনেক পালটে গিয়েছে। এখন আর সেই গ্রামীণ জনপদ নেই। সবগুলোই এক একটা জমজমাট শহর। তাহলে কি খাড়াপত্থরের চরিত্রও পালটে গিয়েছে। সেও তো আদতে একটা গ্রাম। কোটখাইয়ের কাছে চা-পানের জন্য কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আরও এগিয়ে চললাম এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম খাড়াপত্থর।

গিরিগঙ্গা নদী পেরোতেই বুঝে গেলাম খাড়াপত্থর আছে খাড়াপত্থরেই। রাস্তাটাই শুধু চওড়া মসৃণ হয়েছে। বাদবাকিটা একেবারে একরকম। সেই তিন রাস্তার মোড়, সেরকমই দোকানপাট আর ঠিক সেই চেহারায় হিমাচল পর্যটনের ‘দ্য গিরিগঙ্গা রিসর্ট’। এই রিসর্টেই ছিলাম দুটো দিন। দারুণ উপভোগ করেছিলাম পাব্বর উপত্যকা। সেই রিসর্ট, সেই জনপদ একই রকম দেখে মন ভরে গেল।
চলে এলাম পাব্বর নদীর ধারে হাটকোটিতে। পাড়ি দিয়ে এলাম ৯০ কিমি পথ। ঘড়িতে প্রায় দেড়টা। হিমাচলের মন্দির-স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন হাটেশ্বরী তথা হাটকেটশ্বরী মন্দির। মূলত পাথর আর কাঠের তৈরি এই মন্দির ঠিক কত পুরোনো সে সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত। অনেকে বলেন, এই মন্দির নির্মাণ করেন আদি শংকরাচার্য। আবার অনেকে বলেন, মন্দিরের স্থাপত্য দেখে অনুমান হয় এই মন্দির ষষ্ঠ থেকে নবম শতকের মধ্যে গুপ্ত সম্রাটদের আমলে তৈরি। মন্দিরগাত্রে বেশ কিছু শিলালিপি রয়েছে আজও যেগুলির পাঠোদ্ধার করা যায়নি।

হাটকোটি মন্দিরে মা দুর্গাকে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পুজো করা হয়। অষ্টধাতুর বিগ্রহ। মা এখানে অষ্টভুজা। বাহন সিংহ। রয়েছে মহিষাসুরও। এই মন্দিরচত্বরেই রয়েছে শিবমন্দির। এখানকার শিবলিঙ্গকে ছুঁয়ে প্রণাম করতে হলে শরীরকে অন্তত অর্ধেক বেঁকিয়ে দরজা দিয়ে ঢুকতে হয়। রয়েছে আরও পাঁচটি পাথরের মন্দির, আকারে পাঁচ রকম, বড়ো থেকে ছোটো, আর একটু ছোটো, আরও ছোটো – এইভাবে। এই মন্দিরগুলি নাকি ছিল পঞ্চপাণ্ডবের খেলনাঘর। পিছনে পাহাড়ের সারি, পাশেই বহমান পাব্বর নদী – সব মিলিয়ে বিরল স্থাপত্যের হাটকোটি মন্দির হিমাচলের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্য। হাটকোটি মন্দিরে আধঘণ্টাখানেক কাটিয়ে রোহরু শহর ছাড়িয়ে যখন পাব্বর রিভার ক্যাম্পসে পৌঁছোলাম ঘড়িতে তখন তিনটে।
মধ্যাহ্নভোজন সারতে সারতে চারটে বেজে গেল। নদীর ধারে এই রিসর্ট। পাহাড়ি নদী পাব্বরের বয়ে চলা কেমন যেন একটা উন্মাদনা সৃষ্টি করে। সন্ধেটা কাটল রিসর্টের বাগানে বসে। জবরদস্ত ঠান্ডায় আগুন পুইয়ে জমে উঠল আড্ডা।
রিসর্টের ঘরে শুয়ে সারা রাত পাব্বরের বয়ে চলার সুর শুনেছি। রাত যত গভীর হয়েছে পাব্বর যেন তত উচ্ছল হয়ে উঠেছে।
সকাল হল। আজ আমাদের গন্তব্য চনশল পাস। দূরত্ব ৩৮ কিমি। হাজারপাঁচেক ফুট থেকে উঠে যাব প্রায় তেরো হাজার ফুট উচ্চতায়। রিসর্ট থেকে যাত্রা শুরু হল সাড়ে ৯টা নাগাদ। ৩৮ কিমি পথ ভেঙে তেরো হাজার ফুটে উঠতে সময় লাগল আড়াই ঘণ্টা। পথে পড়ল চিড়গাঁও, টিক্কাড়ি, লড়োত প্রভৃতি জনপদ। শেষ ২০ কিমি পথের অবস্থা খুবই খারাপ। এই পথেই হিমাচলের সঙ্গে উত্তরাখণ্ডের যোগাযোগ। পাস মানে গিরিপথ। পাহাড়ি পথ এঁকেবেঁকে পাহাড়ের মাথায় উঠে আবার নেমে যায়। যুক্ত হয় পাহাড়ের দুপাশের দুই দুর্গম অঞ্চল। চনশল তেমনই একটি জায়গা।
কথা হচ্ছিল ওই এলাকার দুই বিশিষ্ট মানুষ দুর্গা সিং আর বসন্ত সিংয়ের সঙ্গে। তাঁরা ছিলেন এক বরযাত্রীদলে। গতকালই বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। বর-বধূকে নিয়ে তাঁরা ফিরে চলেছেন বরের পিতৃগৃহে। চলেছেন চনশল পাসের একদিক থেকে আর-এক দিকে। একফাঁকে সবাই নেমেছেন পাসে। একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন। জানতে চাইলেন, আমরা কোথা আসছি, কজন আছি, হিমাচলের কোথায় কোথায় যাব ইত্যাদি। আমাদের ভ্রমণসূচি শুনে দুজনেই খুব খুশি হলেন। বুঝলেন, আমরা একটু অন্য ধাতুর পর্যটক। ওঁরা জানালেন, চনশল পাসের পর্যটক মরশুম মে-জুন মাস। তখন চায়ের অনেক অস্থায়ী দোকান বসে এখানে।
স্বাভাবিকভাবেই চনশলে বেশ ঠান্ডা। সোয়েটারের ওপর জ্যাকেট চাপিয়ে ঘুরছি। আকাশে যথেষ্ট মেঘ। কাছে-দূরের পাহাড়চুড়োগুলো স্পষ্ট দৃশ্যমান নয়। একটু আপশোশ থেকে গেল। ভরা শীতে এই চনশল বরফে ঢেকে যায়। ঘণ্টাখানেক চনশলে কাটিয়ে ফিরে এলাম পাব্বর-তীরের রিসর্টে। পথে পেলাম বৃষ্টি। রিসর্টে ফিরে আসার পরে আবার ভালোরকম বৃষ্টি। তারই মাঝে দুপুরের আহার সারা হল বিকেলে।

বৃষ্টি থামতেই আমি আর শ্রয়ণ বেরিয়ে পড়লাম বৈকালিক পদচারণায়। পাব্বরের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নজর চলে গেল পাহাড়শীর্ষে। বরফে ছেয়ে গিয়েছে পাহাড়ের মাথা। বুঝলাম, আর কিছুক্ষণ চনশলে থাকলে তুষারপাতের সাক্ষী হতে পারতাম।
রাতের খাওয়া সেরে আবার পদচারণায় বেরিয়েছিলাম দুজনে। বৃষ্টিধৌত আকাশে তারাদের আসর বসেছে। তাকিয়েছিলাম একদৃষ্টিতে। জ্বলজ্বল করছে সপ্তর্ষিমণ্ডল-সহ আরও অনেক তারা। আশেপাশের পাহাড়ে আলোর ঝিকিমিকি। তারই মাঝ থেকে নিজেকে প্রকাশ করছে বরফে ছাওয়া চনশল পাস। (চলবে)
ছবি শ্রয়ণ সেনছবি শ্রয়ণ সেন
আগের পর্ব: অল্পচেনা হিমাচলে/২