শম্ভু সেন
বসে আছি হাটুমাতার মন্দিরের চাতালে। হাটুমাতা মা দুর্গারই এক রূপ। সম্পূর্ণ কাঠের মন্দিরটি হিমাচলী স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন। এই পাহাড়চুড়োয় মা কত দিন ধরে বিরাজ করছেন তা কেউই বলতে পারেন না। তবে বর্তমানের কাঠের মন্দিরটি একেবারেই নতুন। তেরো বছর আগে যখন এসেছিলাম তখন মন্দির নির্মাণের কাজ সবে শুরু হয়েছে। তখন দেখে বুঝতে পারিনি পাহাড়শীর্ষে কতটা জায়গা জুড়ে তৈরি হবে এই মন্দির। আজ বুঝলাম এর ব্যপ্তি।
১১১৫২ ফুট উচ্চতার হাটু পিকে মন্দিরফটকে পৌঁছে দিল গাড়ি। ফটক থেকে বাঁধানো পথ ধরে কিছুটা হাঁটা। তার পর মূল মন্দিরের চত্বরে প্রবেশ। সাজানো বাগান ঘুরে মূল মন্দিরে প্রবেশ। কাঠের মন্দির বলে মূল মন্দিরে ধূপ জ্বালানো মানা।
হাটুমাতার মন্দির।
মাকে দর্শন করে বেরিয়ে এসে কিছুটা হাঁটাহাঁটি করলাম আমরা। কাছেপিঠের পাহাড়গুলো নিচু। আর দূরের বহু উঁচু পাহাড়ের শীর্ষদেশ বরফাবৃত। বেশ কিছুক্ষণ ধরে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করলাম। চোখ মেলে দিলাম যতটা সম্ভব। হাটুমাতা মন্দিরের কাছেই তৈরি হয়েছে হিমাচল প্রদেশ লোক নির্মাণ বিভাগের বাংলো। দেখে বুঝলাম এখনও চালু হয়নি। তবে এটুকু বুঝলাম অদূর ভবিষ্যতে হাটু পিকে এসে রাত কাটানো যাবে।
সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ রওনা হয়েছিলাম রোহরুর পাব্বর রিভার ক্যাম্পস থেকে। গন্তব্য নারকান্ডা। নারকান্ডা যাওয়ার দুটো শর্টকাট রাস্তা আছে। একটা রোহরু থেকেই, আর-একটা খাড়াপত্থর থেকে। জিপিএস বলছে, এই শর্টকাট রাস্তায় আড়াই ঘণ্টা লাগবে নারকান্ডা পৌঁছোতে। কিন্তু সারথি কমলজি কোনো শর্টকাট রাস্তা ধরতে চান না। সম্ভবত আমাদের ট্র্যাভেলার বাস নিয়ে যাওয়ার পক্ষে কোনো রাস্তাই সুবিধের নয়। অগত্যা ঘুরপথেই চললাম নারকান্ডা।
ঘুরপথ মানে আমাদের পরিচিত পথটি। পাব্বর নদীর ধার ধরে চলে এলাম হাটকোটি পর্যন্ত। তার পর নদীর ধার ছেড়ে পাহাড় চড়া শুরু। এবার ফিরতি পথে কিন্তু অন্য দৃশ্য, যা যাওয়ার সময় চোখে পড়েনি – পাহাড়শীর্ষে বরফ। দূরের যে পাহাড়গুলো বেশ উঁচু তার মাথাগুলো বরফে মোড়া। এ সবই তো দেখতে চায় পর্যটক। তখনই মনে হয় ভ্রমণ সার্থক হল। খাড়াপত্থর-কোটখাই পেরিয়ে এলাম ছোট্ট জনপদ কোকনালায়। যাত্রার বিরতি। চা-টা খেয়ে আনুষঙ্গিক কিছু কাজ সেরে ফের রওনা।
রোহরু থেকে নারকান্ডার পথে।
হাটকোটি থেকে পথ বেশ চড়াই। খাড়াপত্থরে উঠে গেলাম সবচেয়ে বেশি উচ্চতায় – ৮৮০০ ফুট। খাড়াপত্থর ছাড়াতেই নামা শুরু। কোটখাইয়ে নেমে এলাম ৬১০০ ফুট উচ্চতায়। ঘণ্টাতিনেকে পৌঁছে গেলাম থিয়োগে। ডানদিকে ধরলাম নারকান্ডার পথ, যে পথ চলে গিয়েছে রামপুর-কল্পা হয়ে লাহুল-স্পিতির অন্দরে। আরও ঘণ্টাখানেক পথ ভেঙে পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্যে, নারকান্ডা থেকে ৬ কিমি আগে এক নিরালা নির্জন জায়গায়, শ্যাম রিজেন্সিতে। ২২ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে এই হোটেলটি আমাদের একদিনের ঠিকানা।
আমাদের এবারের হিমাচল ভ্রমণ শুরু হয়েছিল অচেনা মাশোবরা দিয়ে। তার পরের গন্তব্য রোহরু এর আগে একবার ঘুরেছি। আর তৃতীয় গন্তব্য নারকান্ডায় এই নিয়ে তিনবার পা পড়ল। প্রথমবার এসেছিলাম শিমলা থেকে, বুড়িছোঁয়া করে গিয়েছিলাম। তার পরে এসেছিলাম চোদ্দো বছর পরে, ঠিক তেরো বছর আগে। উঠেছিলাম হিমাচল পর্যটনের ‘হোটেল হাটু’তে। সেবার দর্শন হয়েছিল হাটুমাতার। এবারও সেই অভিলাষে পৌঁছে গেলাম হাটু পিকে।
হিমাচল প্রদেশ লোক নির্মাণ দফতরের নবনির্মিত বাংলো।
হোটেল থেকে নারকান্ডা বাজার ৬ কিমি। সেখান থেকে হাটু পিক ১১ কিমি। আমাদের ট্র্যাভেলার বাস হাটু পিকে যাবে না। তাই শ্রয়ণকে স্থানীয় গাড়ি ভাড়া করতে হল। দুপুরের আহার সেরে সাড়ে তিনটে নাগাদ দুটি গাড়িতে বেরিয়ে পড়লাম হাটু পিকের পথে। নারকান্ডা বাজার ছাড়িয়ে পথ দুভাগ। বাঁদিকের পথ নেমে গেল রামপুরের দিকে। আমরা ধরলাম সোজা পথ। কিলোমিটারদুয়েক যেতেই পথ আবার দুভাগ। যে অতি সঙ্কীর্ণ পথটি সোজা পাহাড় ভেঙে খাড়া উঠেছে, আমরা সেই পথের সওয়ারি হলাম। আর মুহূর্তের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, কেন এই পথে ট্র্যাভেলার বাস আসে না। পিচঢালা মসৃণ সরু পথটি পাইন, ওক, পপলারের ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে উঠে গিয়েছে পাহাড়শীর্ষে। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে গেলাম ১১১৫২ ফুট উচ্চতার হাটু পিকে।
শেষ বিকেলে হাটু ঘুরে ফিরে এলাম আমাদের আজকের আবাসস্থলে। কাল আমাদের গন্তব্য তীর্থন ভ্যালির মুঙ্গলা গ্রামে, এতবার হিমাচল ঘোরার পরেও যে জায়গায় আমাদের পা পড়েনি কখনও। (চলবে)
ছবি: শ্রয়ণ সেন
আগের পর্ব: অল্পচেনা হিমাচলে/৩