শম্ভু সেন
হিমাচলের অল্পচেনা গন্তব্যের মধ্যে অন্যতম হল তীর্থন ভ্যালি – তীর্থন নদীর পারে উপত্যকা অঞ্চল। ট্যুরিস্ট বলতে সাধারণত যাদের বোঝায় তাদের খুব একটা দেখা মেলে না এই তীর্থনে। যারা একটু ‘হটকে’ ট্যুরিস্ট তারাই আসে এই তীর্থনে। তিনটি তরুণ-তরুণীকে অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকতে দেখলাম তীর্থনের ধারে। ঠান্ডা জব্বর। তবে তার মোকাবিলায় জ্বালানো হয়েছিল আগুন। সেই আগুন পোহাতে পোহাতে তারা উপভোগ করছিল তীর্থনের বয়ে চলা, অন্ধকারের চাদরে ঢাকা পাহাড় দেখা আর আকাশের তারা চেনা। আমরাও সেখানে ছিলাম কিছুক্ষণ। নদীর দুপারে পাহাড়ের ঢালে দূরে দূরে ছন্নছাড়া কিছু ঘরবাড়ি যেন অন্ধকারের মধ্যেই জোনাকির আলো জ্বালিয়ে রেখেছে।
এই তীর্থন ভ্যালিতে যেখানে আজকের রাতের ঠিকানা আমাদের, সেই উষা রিভার সাইড রিসর্টটি একেবারে নদীর ধারে। সুতরাং পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নদীর বয়ে চলা উপভোগ করতে করতে কখন এখানে সময় কেটে যায়, টেরও পাওয়া যায় না। একটু রাত বাড়তেই আমরা আগুনের ধার ছেড়ে উঠে এসেছিলাম। তার পর রাতের আহার ছেড়ে কম্বলের তলায়। পরের দিন সকালে হোটেলকর্মীদের কাছে শুনলাম ওই তিন তরুণ-তরুণী অনেক রাত পর্যন্ত তীর্থনের ধারে বসেছিল।
জালোরি পাস থেকে। দূরে তুষারাবৃত পাহাড়।
নারকান্ডার হোটেল থেকে রওনা হয়েছিলাম ঠিক সকাল ৯টায়। মিনিট আটেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম নারকান্ডার বাজার ছাড়িয়ে সেই মোড়ে যেখান থেকে হাটু পিকের রাস্তা সোজা বেরিয়ে গিয়েছে। আমরা বাঁদিকের উতরাই পথ ধরলাম। এই রাস্তাই শতদ্রুকে একপাশে রেখে রামপুর-কল্পা হয়ে লাহুল-স্পিতি চলে গিয়েছে। আমরা অবশ্য এই উতরাই পথে শতদ্রুকে ছুঁয়ে অন্য পথ ধরব। আমাদের ট্র্যাভেলার বাস দ্রুত নামতে লাগল। প্রায় ন’ হাজার ফুট থেকে নেমে আসছি শতদ্রুর পারে।
ঘণ্টাখানেক পরে শতদ্রুকে পাশে পেলাম। এখানে আবার রাস্তা দু’ভাগ। সোজা রাস্তা শতদ্রুকে সঙ্গী করে চলে গেল রামপুর ছাড়িয়ে। আমরা বাঁদিকের পথ ধরলাম। এই পথেও শতদ্রু রয়েছে। এটা শিমলা থেকে মানালি যাওয়ার আর-একটি পথ, জালোরি পাস হয়ে। একটু পরেই শতদ্রু পেরোলাম। কিন্তু শতদ্রু পাশ পালটে ডানদিক থেকে বাঁদিকে চলে গেল এবং কিছুক্ষণ পরে আমরা শতদ্রুর সঙ্গ ত্যাগ করে চড়াই ভাঙতে শুরু করলাম। বৈহান, নগান, আনী, কান্দুগাড়, সরালি হয়ে পৌঁছে গেলাম জালোরি পাসে, ১০৩৫৭ ফুট উচ্চতায়। তেরো বছর পর আবার দেখা হল জালোরির সঙ্গে।
সেবার রামপুর থেকে শোজা যাওয়ার পথে পেয়েছিলাম জালোরিকে। জালোরি এখন অনেক পরিচ্ছন্ন হয়েছে। রাস্তা সুন্দর হয়েছে। পাসের মাথায় যে মন্দিরটি রয়েছে সেটি রঙচঙ করা হয়েছে। পাসের ওপর যেসব দোকানপাট রয়েছে, সেগুলো এখন অনেক সাজানোগোছানো। একটু ঘোরাঘুরি করলাম। হিমালয়ের ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ নিলাম। অনেক পাহাড়ের মাথায় বরফেরও চিহ্ন পেলাম। এখান থেকে হিমাচলের অনেক দুর্গম অঞ্চলে ট্রেক করে যাওয়া যায়। কফি পান করে ফের রওনা।
জালোরি পাসে মন্দির।
এই পথে শীর্ষদেশকে ছুঁয়ে আবার নামা শুরু। চার-পাঁচ কিমি পথ ভাঙতেই পৌঁছে গেলাম আমাদের পুরোনো জায়গায়। ২০১১-তে হিমাচল ভ্রমণে এসে রাত কাটিয়েছিলাম এই শোজা গ্রামে। বাসে যেতে যেতেই নজরে পড়ে গেল শোজায় আমাদের আবাসস্থলটি – রাজাস গেস্ট হাউস। আমাদের তখনকার সারথি মদনলাল শর্মাই নিয়ে এসেছিল এখানে। ছোট্ট পরিচ্ছন্ন গেস্ট হাউসটি আরও বড়ো, আরও সুন্দর হয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। খানিকক্ষণ পরে জিভি হয়ে চলে এলাম বনজারে। ঢুকে গেলাম তীর্থন ভ্যালিতে।
রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। তার ওপর গ্রামগুলি জনবসতিপূর্ণ। তীর্থনের ধার ধরে প্রচুর রিসর্ট। শেষ পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া গেল উষা রিভার সাইড রিসর্টের। ঘড়িতে তখন বিকেল পৌনে চারটে। এখনও তো মধ্যাহ্নভোজন সারা হয়নি।
প্রথম দর্শনেই ভালোবেসে ফেললাম তীর্থন ভ্যালিকে। বছরপনেরো আগেও এই জায়গা পর্যটকদের কাছে ব্রাত্য ছিল। তার অন্যতম প্রধান কারণ রাস্তার অবস্থা। এখানে রাত কাটানোর তেমন ব্যবস্থা ছিল না। দু-একটি রিসর্ট ছিল। কিন্তু সেখানে যাওয়া সাধারণ পর্যটকদের পক্ষে ছিল দুষ্কর। সে সব রিসর্টের দরজায় গাড়ি পৌঁছোত না। রিসর্ট নদীর ওপারে। আর গাড়ির রাস্তা এপারে। রিসর্টে পৌঁছোনোর জন্য ছিল নদীর ওপর দিয়ে রোপওয়ে। এখন আর সে সমস্যা নেই। বনজারের পর থেকে তীর্থনের ধারে যত গ্রাম আছে, সব জায়গাতেই গড়ে উঠেছে রিসর্ট-হোমস্টে।
উষা রিভার সাইড রিসর্ট, তীর্থন ভ্যালিতে আমাদের আস্তানা।
বিকেলে দুপুরের খাওয়া সেরে আমি আর ঋভু (শ্রয়ণ) পদচারণায়। মূল উদ্দেশ্য জায়গাটা চেনা। তীর্থনের পাড় ধরেই পিচের রাস্তা, সামান্য চড়াই। গ্রামগুলো ঘেঁষাঘেঁষি। এ অঞ্চলে জনবসতি ভালোই। আমরা যেখানে উঠেছি সেই উষা রিভার সাইড রিসর্ট মুঙ্গলা গ্রামে। নাগিন গ্রামের গায়েই। এর পরের গ্রাম হাঙ্গনি, তার পর বাড়িরোপা। তীর্থন নদীতে ট্রাউট মাছের চাষ চলছে। যেমন হিমাচল সরকারের মৎস্য দফতরের উদ্যোগে, তেমনই বেসরকারি উদ্যোগেও। পাহাড়ের গায়ে অনেক উঁচুতেও রয়েছে ঘরবাড়ি। আর সেখানে মাল পৌঁছে দেওয়ার জন্য মূল সড়ক থেকে রয়েছে রোপওয়ের ব্যবস্থা। বোঝাই যাচ্ছে মানুষ সেখানে পৌঁছে যায় পাকদণ্ডী ধরে।
সন্ধে নামল। আমরাও রিসর্টে ফেরার পথ ধরলাম। কাল আমাদের ঠিকানা শানগড় – হিমাচলের আর-এক অফবিট গন্তব্য। কেন সেখানে যাব? ক্রমশ প্রকাশ্য। (চলবে)
ছবি: শ্রয়ণ সেন
আগের পর্ব: অল্পচেনা হিমাচলে/৪