সন্ধ্যায় দোতলা হোমস্টের চত্বরে বসে কথা হচ্ছিল গুরধিয়ান সিং ঠাকুরের সঙ্গে। শানগড়ের প্যারাডাইস হোমস্টের মালিক। বেশ ঠান্ডা রয়েছে। হিমাচলে আসা অবধি এত ঠান্ডা আমরা কোথাও পাইনি। আগুন পোয়াতে পোয়াতে ওঁর কথা শুনছি।
বয়স্ক মানুষটি বেশ মিশুকে। জ্যেষ্ঠপুত্র ও পুত্রবধূ, দুজনেই শিক্ষক, থাকেন শানগড়ের বাইরে। আর কনিষ্ঠপুত্র থাকেন বাবা-মায়ের সঙ্গেই, হোমস্টের ব্যাবসা দেখেন। গুরধিয়ানের কাছেই শুনলাম কী ভাবে একটু একটু করে হিমাচলের পর্যটন মানচিত্রে জায়গা করে নিচ্ছে শানগড়।
হিমাচলের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে গুরধিয়ানদের কয়েক পুরুষের বাস। বড়ো কঠিন ছিল তাঁদের জীবনযাত্রা। এই অঞ্চল কুলু জেলার অন্তর্গত হলেও জেলা সদরে পৌঁছনোর জন্য একটা সময় পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হেঁটে যেতে হত। পার্বতী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র পর্যন্ত হওয়ার পর সেই হাঁটা কিছুটা কমে। তবু বাকি থাকে সাত কিলোমিটার পথ। সে সময়ে শুধুমাত্র কিছু অত্যুৎসাহী ট্রেকার আসতেন এই শানগড়ে। কী ভাবে যেন তাঁদের কাছে পৌঁছে যেত শানগড়ের সৌন্দর্যের কথা।
২০১৭-এর পর রাস্তা হল। ধীরে ধীরে আসতে শুরু করলেন পর্যটকেরা। তবে এখনও শানগড় হিমাচলের এমনই এক পর্যটন-গন্তব্য যেখানে তথাকথিত ট্যুরিস্টদের পা খুব একটা পড়ে না। বছর ছ’-সাত আগেও ৭০০০ ফুট উঁচু শানগড় যে দুর্গম ছিল তা মালুম তখনই হচ্ছিল, যখন শেষ সাত কিলোমিটার পথ ভাঙছিলাম।
প্রাতরাশ সেরে রওনা হয়েছিলাম তীর্থন ভ্যালি থেকে। আজকের দূরত্ব খুব বেশি নয়, ৬০ কিমির মতো। তাই বেরোতে বেরোতে একটু গড়িমসি হয়ে গেল। ১০টা নাগাদ রওনা হলাম শানগড়ের উদ্দেশে।
বনজারের আগেই ডানদিকের রাস্তা দিয়ে নেমে এলাম তীর্থনের ধারে। পেরিয়ে এলাম তীর্থন নদী। পৌঁছলাম সিধোয়ান গ্রাম। এতক্ষণ তীর্থনকে ডানদিকে রেখে এগোচ্ছিলাম। এবার তীর্থন চলে এল বাঁদিকে। চলেছি জাতীয় সড়ক ৩০৫ ধরে। বালিচৌকি পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি। তীর্থন কখনও বাঁদিকে, কখনও ডানদিকে। এ ভাবেই পৌঁছে গেলাম লারজী। তীর্থন পড়ল সায়ৈঞ্জ নদীতে। এবার চললাম সায়ৈঞ্জ নদীকে বাঁদিকে রেখে।
লারজীতে কুলুর রাস্তা ছেড়ে শানগড়ের রাস্তা ধরেছি। বাঁদিকে বয়ে চলেছে সায়ৈঞ্জ। সালোয়ার পেরিয়ে একটু পরেই পৌঁছে গেলাম এনএইচপিসি-র পার্বতী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে। ঢুকে গেলাম গ্রেট হিমালয়ান ন্যাশনাল পার্কের এলাকায়। এখান থেকে শানগড় ৭ কিমি। শুরু হল এক অবর্ণনীয় যাত্রা। রাস্তা ক্রমশ উঠেছে, তবে তাকে সত্যিই যদি রাস্তা বলা যায়। আমাদের ট্রাভেলার বাস চলেছে নাচতে নাচতে। সিটে বসে থাকাই যাচ্ছে না। কোমরের হাড়গোড় ভেঙে যাওয়ার জোগাড়। স্টিয়ারিং-এর হাল ধরে যিনি বসে আছেন, তাঁর ক্ষমতাকে তারিফ করতেই হয়। বাসের এই নাচনকোঁদনে সিটে বসে থাকাই এক বিড়ম্বনা। তার ওপর স্টিয়ারিং ধরে ঠান্ডা মাথায় বাসকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যে কত কঠিন তা বলাই বাহুল্য। সারথি কমলজির কিন্তু কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। আমাদের নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়াই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। মন তখন দোলাচলে। এত কষ্ট করে চলেছি, উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে তো? হতাশ হতে হবে না তো?
ওই সাত কিমি পথটুকু পাড়ি দিতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। বেলা ১টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। আমাদের বাস ডানদিকের রাস্তা ধরে সামান্য নেমে হোমস্টের চত্বরে পার্কিং করল। ওখানেই রাস্তা শেষ। আর বাঁদিকের রাস্তা আরও এগিয়ে গেল।
আশেপাশে কিছু ঘরবাড়ি। আমাদের হোমস্টেটা দোতলা। কিছুটা ঘিঞ্জি এলাকা। প্রথম দর্শনে খুব একটা পছন্দ হল না শানগড়কে। আর সব সময় সেই সংশয়টা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। যার জন্য এত কষ্ট করে ছুটে এলাম, সেটি কোথায়? আশেপাশে তার তো টিকি দেখতে পাচ্ছি না। শেষ পর্যন্ত হতাশ হতে হবে না তো?
কোথায় সেই ‘মেডো’, যা খাজিয়ারকেও হার মানায়? দুপুরের খাওয়া সেরে আমাদের হোমস্টেতেই তার হদিস করে নিলাম।
হোমস্টে থেকে বেরিয়ে সামান্য দু’-চার পা হেঁটে উঠে এলাম সেই রাস্তায়, যেটিকে বাঁদিকে রেখে আমাদের ট্রাভেলার ডানদিকের রাস্তা ধরে নেমে গিয়েছিল হোমস্টের আঙিনায়। এগিয়ে গেলাম অল্প কিছুটা। হোমস্টের সামনে থেকে সামান্য ঢাল বেয়ে যে পথ উঠে এসেছে কয়েক পা, সেই পথ ধরেও আমরা আসতে পারতাম। কিন্তু ওই ঢালটাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারিনি। এই বয়সে যদি গড়িয়ে পড়ি! কার্যত আমাদের হোমস্টের সামনেই সেই ‘মেডো’র ফটক। তবে কিছুটা চোখের আড়ালে বলে দেখা যায় না। উঠে আসতে মিনিটদুয়েক সময় লাগল। ফটকের গায়ে একটা সাইনবোর্ড। তাতে এই ‘শানগড় মেডো’ নিয়ে রয়েছে কিছু নির্দেশিকা।
তিন-চার ধাপ সিঁড়ি ভেঙে বাঁধানো পায়ে চলা পথ। বেড় করে রেখেছে সুবিস্তীর্ণ তৃণাচ্ছাদিত ভূমিকে। সবুজ ঘাসে ছাওয়া পাহাড়ি ঢেউখেলানো জমি। আর সেই জমির অনেকটাই পাইনের জঙ্গলে ঘেরা। পায়ে চলা পথে সেই জঙ্গলে ঢুকে যাওয়া যায়। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ওই জঙ্গল গ্রেট হিমালয়ান ন্যাশনাল পার্কের এলাকাভুক্ত। জঙ্গলের পিছন থেকে উঁকি মারছে পাহাড়শ্রেণি। তার কারও কারও শীর্ষদেশ বরফে মোড়া।
ওই তৃণভূমিতেই কিছুটা দূরে সাংচুল মহাদেবের মন্দির। দূর থেকেই তার অপূর্ব হিমাচলী শৈলীর সৌন্দর্য অনুধাবন করলাম। পাহাড়ি ঢেউখেলানো জমি দিয়ে হাঁটছি। কখনও খানিকটা নেমে যাচ্ছি, আবার উঠে আসছি। পৌঁছে গেলাম মন্দিরে। ভিতরে মহাদেবের দণ্ডায়মান বিগ্রহ। কাঠের মন্দিরের গায়ে অপূর্ব কারুকাজ। পাণ্ডবদের কাহিনি জড়িয়ে আছে এই মন্দিরে। শোনা যায়, পাণ্ডবরা অজ্ঞাতবাসের সময় বেশ কিছু দিন এই শানগড়ে কাটিয়েছিলেন। এই তৃণভূমিতে তাদের পাদস্পর্শ পড়েছিল।
বাঁধানো পায়ে চলা পথের একটা অংশ পাইনের জঙ্গল থেকে তৃণভূমিকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। আর-একটা অংশ তৃণভূমির আর-এক ধার দিয়ে চলে গিয়েছে শানগড় গ্রামের ভিতরে। এখানেও সাংচুল মহাদেবের আর-একটি মন্দির রয়েছে। দেখে মনে হল এই মন্দিরের সঙ্গেই রয়েছে বসতবাড়ি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, দুটি মন্দিরই দেখাশোনা করে একটিই পরিবার। তাদেরই বাস এখানে। শানগড় গ্রামে যে মন্দির রয়েছে তার গঠনশৈলী অনেকটাই সারাহানের ভিমাকালী মন্দিরের মতো।
এই তৃণভূমি সংক্রান্ত কিছু নির্দেশিকা পর্যটকদের উদ্দেশে লিখে রাখা হয়েছে সাইনবোর্ডে। এই তৃণভূমি সাংচুল মহাদেবের সম্পত্তি। একে নোংরা করলে আর্থিক জরিমানা করা হয়। সন্ধের পরে এখানে আসা যায় না। সকালেও সূর্যোদয়ের বেশ কিছুক্ষণ পরে এই তৃণভূমিতে প্রবেশ করা যায়। জানি না, এই সব কারণেই কিনা, ‘শানগড় মেডো’র পরিচ্ছনতা খাজিয়ারকেও হার মানায়।
শানগড়ের এই তৃণভূমি ভরা শীতে বরফে ঢেকে যায়। তখন তার আর-এক সৌন্দর্য। আপাতত তুষারশূন্য এই তৃণভূমি ভেসে যাচ্ছে ঝলমলে রোদে। ঠান্ডার শানগড়ে বড়ো আরামের রোদ। লোভ সামলাতে পারলাম না। টানটান হয়ে শুয়ে পড়লাম। একেবারে চিতপটাং। সোজা নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি। এ রকম নীল আকাশ কোথাও কি দেখেছি? মন ভরিয়ে দিল শানগড়। (চলবে)