অল্পচেনা হিমাচলে/৭

এগিয়ে চলেছে চন্দ্র, ডান দিক থেকে আসছে ভাগা। দুয়ে মিলে এগিয়ে চলল চন্দ্রভাগা নদী।
শম্ভু সেন

অটল টানেল পেরিয়ে যেতেই চারদিকের দৃশ্য বেশ পাল্টে গেল। মানালি থেকে খুব বেশি দূর আসিনি, বড়জোর ৩৫ কিমি রাস্তা। কিন্তু উঠে এসেছি অনেকটাই – সাড়ে তিন হাজার ফুটেরও বেশি। ৬৪০০ ফুট উচ্চতার মানালি থেকে ১০ হাজারেরও বেশি সিস্‌সুতে।

এ যেন একটুকরো ইউরোপ। গাছের পাতা সব হলুদ। ইউরোপে গাছের পাতায় হলুদ রঙ ধরে ‘ফল সিজন’-এ। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর, এই তিন মাস জুড়ে ইউরোপের ‘ফল’, আমাদের শরৎ-হেমন্ত ঋতু। শীতে সব পাতা ঝরে যাবে। তার আগে এই হেমন্তকালে লাহুল-স্পিতি উপত্যকায় সব গাছের পাতা হলুদ হয়ে যায়। সিস্‌সু থেকে এই লাহুল উপত্যকার সূত্রপাত। তাই এখানেও পাহাড়ি গাছগুলো হরিদ্রাবর্ণ ধারণ করেছে।

অটল টানেল পেরোতেই আমাদের বাঁ পাশে পেয়ে গেলাম চন্দ্র নদীকে। মানালি ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা পথ বিপাশা আমাদের সঙ্গী ছিল। এ বার আমরা পেয়ে গেলাম চন্দ্রকে। মানালি থেকে কত সহজেই চলে এলাম এই লাহুল উপত্যকার ফটকে। অথচ বছর চারেক আগেও মানালি থেকে সিস্‌সু আসা খুব হ্যাপার ছিল। ঘণ্টা পাঁচেক সময় লেগে যেত। ১৩ হাজার ফুটের রোটাং পাস টপকে আসতে হত খোকসারে। তার পর সেখান থেকে সিস্‌সুর পথ। আর বছরের অন্তত চার মাস সেই পথ বন্ধ হয়ে যেত তুষারপাতের কারণে। আসলে রোটাং হয়ে যেত অগম্য। ফলে সিস্‌সুরা হয়ে যেত বিচ্ছিন্ন। এখন ছবিটা একেবারেই আধুনিক। এই সিস্‌সুতেও এখন ওয়াইফাই।

কেলং উপত্যকায় এখন ‘ফল’ সিজন।

প্রাতরাশ সেরে শানগড় থেকে রওনা হয়েছিলাম সাড়ে ৯টা নাগাদ। ঘন্টাখানেকের মধ্যে সালোয়ার পেরিয়ে কিছুক্ষণ পর পৌঁছে গেলাম লারজীতে, সায়ৈঞ্জ আর তীর্থনের সঙ্গম। একটু পরেই ঢুকে গেলাম আউটের টানেলে। তিন মিনিট লাগল টানেল পেরোতে। পৌঁছে গেলাম জ্বালাপুর। এখান থেকে মানালি ৬২ কিমি। বাঁ দিকে চলেছে বিপাশা। টাকোলিতে বিপাশা ক্রস করে চললাম। ঝকঝকে চার লেনের রাস্তা দিয়ে চলেছি। বোঝাই যাচ্ছে না আমরা কয়েক হাজার ফুটের উপরে রয়েছি।

সকাল সাড়ে ১১টা। পৌঁছে গেলাম তলোগীতে। ডানদিকে বেরোল মণিকরণের রাস্তা। পরশু এই রাস্তাতেই যাব, গন্তব্য পার্বতীর ধারে কাসল। কুলুকে বাইপাস করে চলেছি। মিনিট পনেরো পরে আবার বিপাশা পেরোলাম। চতনসেরি, রামপুর হয়ে পৌনে ১টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম মানালি ম্যালে।

মানালি, এই নিয়ে তিন বার। তবে এই মানালিতে থাকা হয়েছিল এক বারই। সেই ১৯৯৭ সালে। সে বার এখানে এসে পাঁচ দিন ছিলাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘুরেছি। তার পর ২০১১। সে বার ছিলাম ২১ কিলোমিটার দূরে দেবিকা রানি ও স্বেতস্লাভ রোয়েরিখের স্মৃতিধন্য নগ্গরে, হিমাচল পর্যটনের নগ্গর ক্যাসলে। তবে যেখানেই থাকি মানালি ম্যালে এসে ঘোরাঘুরি করেছি। এ বারেও তার অন্যথা হল না।

মানালি ম্যাল খুব একটা পাল্টায়নি। বরং যেটুকু পরিবর্তন হয়েছে, তাতে ভালোই হয়েছে। বিপাশার ধার দিয়ে নতুন রাস্তা হওয়ায় ম্যালের বেশ কিছুটা অংশে বড়ো গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে খোশ মেজাজে হাঁটাহাঁটি করতে বেশ সুবিধা হচ্ছে।

ত্রিলোকীনাথ মন্দির।

ট্রাভেলার বাস থেকে নামতেই প্রায় ঘেরাও হয়ে গেলাম। কেউ বলছেন, “চলুন, আজ ভালো শুক্তো হয়েছে”, কেউ বলছেন, “ভালো আলুপোস্ত খাবেন?” আর মাছ তো আছেই। হিমাচলের আর কোনো জায়গায় মানালির মতো এত ভালো বাঙালি খানা আর কোথাও পাওয়া যায় কি না সন্দেহ। আমার অভিজ্ঞতা তো বলে, না।

শ্রয়ণ ঘণ্টা আড়াই সময় দিয়েছে। সাথিরা সব এদিক-ওদিক চলে গেল। অনেকেরই কেনাকাটার নানা রকম প্ল্যান আছে। আমরাও চললাম তেরো বছর আগে দেখা তিব্বতী মন্যাস্টেরির উদ্দেশে। সে রকমই আছে। ঝলমলে প্রেয়ার ফ্ল্যাগে সাজানো মন্যাস্টেরির। রয়েছে তিব্বতী ছবির সুন্দর সংগ্রহ। মন্যাস্টেরিতে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে, কিছু কেনাকাটা করে, চাইনিজ খাবারে দুপুরের আহার পর্ব সেরে ফের রওনা।          

আড়াই ঘণ্টা পর মানালি থেকে রওনা হলাম। আধ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম সোলাং। একটু পরেই ডান দিকে রোটাং-এর রাস্তা বেরিয়ে গেল। একটু পরেই ধুন্ধি ব্রিজ পেরিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম অটল টানেল। সাড়ে ৮ কিমি দীর্ঘ টানেল পেরোতে সময় লাগল ১০ মিনিট। টানেল থেকে বেরোতেই ডান দিকে পেয়ে গেলাম সেই পুরাতন রাস্তা, যেটি খোকসার থেকে আসছে। মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌঁছে গেলাম সাড়ে ১০ হাজার ফুট উচ্চতার সিস্‌সুতে। ঘড়িতে তখন বিকেল ৫টা।

সিস্‌সুতে আমাদের অবস্থান চন্দ্র নদীর ধারে হোটেল ত্রিবেণীতে। হোটেলে বসেই প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করছি। আস্বাদ নিচ্ছি লাহুল উপত্যকার ‘ফল’ মরসুমকে। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে চন্দ্র নদী। একটু পরেই যে ভাগার সঙ্গে মিলন হবে, সেই আনন্দে তার ছুটে চলা। নদীর ও পারে সুদীর্ঘ সুউচ্চ পাহাড়মালা, কোথাও কোথাও মাথায় জমে রয়েছে বরফ।    

সেই ত্রিলোকীনাথ মন্দিরেই বৌদ্ধদের প্রেয়ার ফ্ল্যাগ।

পরের দিন ১০টা নাগাদ রওনা হলাম চললাম ত্রিলোকিনাথের পথে। রাস্তার ধারে লেখা জাতীয় সড়ক ৩। বাঁ দিক দিয়ে বয়ে চলেছে চন্দ্র নদী। কিছুক্ষণ পরে পৌঁছে গেলাম তান্ডিতে, চন্দ্র আর ভাগার সঙ্গমে। চন্দ্র আসছে চন্দ্র তালের কাছে বড়া-লাচা লা-র (পাস) পুব দিকে গ্লেসিয়ার থেকে আর ভাগা আসছে ওই একই পাসে কাছে সূর্য তাল থেকে। সৃষ্টি হল চন্দ্রভাগার বা চেনাব। এই চেনাব জম্মু-কাশ্মীর দিয়ে ঢুকে গিয়েছে পাকিস্তানে। তার পর তার মিলন সিন্ধু নদীর সঙ্গে। পঞ্জাবের পঞ্চ নদীর এক নদী চন্দ্রভাগা, যাকে আমরা দর্শন করেছিলাম গত বছরের জম্মু-কাশ্মীর ভ্রমণে।     

ভাগার ওপর তান্ডি ব্রিজ পেরিয়ে চললাম। ডান দিকে ভাগা। একটু এগোতেই রাস্তা দু’ ভাগ। ওপরের রাস্তা উদয়পুর, ডান দিকে নীচের রাস্তা চলে গেল কেলং। কেলং এখান থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে। আমরা উদয়পুরের দিকে একটু এগোতেই বাঁ দিকে পেয়ে গেলাম চন্দ্রভাগাকে। লোতে, ঝালনা, ঝুন্ডা হয়ে পৌঁছে গেলাম থিরট। চলেছি আপেলের এলাকা দিয়ে। ডান দিকে পাহাড়ের ঢালে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আপেল বাগান, একটার পর একটা। অনেকটাই পাড়া হয়ে গিয়েছে, তবে এখনও বেশ কিছু আপেল আছে গাছে। রাস্তার ধারে দরাদরি কেনাকাটাও চলছে। ফেরার পথে কেনাকাটা হবে, এই সিদ্ধান্ত করে আমরা এগিয়ে চললাম। 

সিস্‌সু থেকে খানিকটা নেমে এসেছি। ৮৯৫০ ফুট উচ্চতার থিরটে রাস্তা আবার দু’ ভাগ। ডানদিকে উপরের রাস্তা চলে গেল উদয়পুর, এখান থেকে ১৫ কিমি। আমরা বাঁ দিকে নেমে এলাম। চন্দ্রভাগা পেরোলাম। নদী এখন ডান দিকে। এখান থেকে ত্রিলোকীনাথ ৫ কিমি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ৯ হাজার ফুট উচ্চতায় ত্রিলোকীনাথে। 

হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মসমন্বয়ের এক উজ্জ্বল উদাহরণ এই ত্রিলোকীনাথ। একই বিগ্রহকে পুজো করে হিন্দু ও বৌদ্ধরা। ত্রিলোকীনাথ বিগ্রহকে হিন্দুরা শিবজ্ঞানে পুজো করে আর বৌদ্ধরা ‘আর্য অবলোকিতেশ্বর’ বলে মানে। তিব্বতীরা এঁকে বলে ‘গর্জ ফাগস্পা’। গর্ভগৃহের সামনে যেমন রয়েছে নন্দীর বিগ্রহ, তেমনই এই মন্দির সাজানো রয়েছে সুদৃশ্য প্রেয়ার ফ্ল্যাগে। এই ত্রিলোকীনাথ এতই পবিত্র যে হিমালয়ের কোলে তৃতীয় পবিত্রতম তীর্থস্থল বলে মানা হয়, কৈলাস আর মানস সরোবরের পরেই। ২০০২ সালে প্রাপ্ত এক শিলালিপি থেকে জানা যায়, ত্রিলোকীনাথ গ্রামের রানা ঠাকুর শাসকরা দশম শতাব্দীতে এই মন্দির তৈরি করেন।  

ত্রিলোকীনাথ দর্শন হল। ঘণ্টাখানেক কাটালাম ত্রিলোকীনাথে। লোতেতে আপেল কিনে হোটেলে ফিরতে ফিরতে বিকেল ৫টা। এরই মাঝে প্রায়-বিকেলে ‘কাফে সিসসু’তে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম।

কাসলে পার্বতীর ধারে ‘রিভার গার্ডেন’-এ।

পরের দিন সকাল ৯টা নাগাদ রওনা হয়ে গেলাম কাসলের পথে। পরিচিত পথে অটল টানেল পেরিয়ে বিপাশাকে ডাইনে-বাঁয়ে রেখে চলে এলাম তলোগী। মাঝে চতনসেরিতে চা বিরতি। তলোগী থেকেই বাঁদিকে বেরিয়েছে কাসল-মণিকরণের পথ। এই পথ এখন এগিয়ে গিয়েছে মণিকরণ থেকে আরও ১৭ কিমি, তোস পর্যন্ত। এখান থেকে পিন-পার্বতী ভ্যালি ট্রেক শুরু হয়। তলোগী থেকে ৩২ কিমি পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গেলাম পার্বতী নদীর ধারে কাসলে। জারি-হুরলুধার হয়ে কাসল পৌঁছে গেলাম ১টা নাগাদ। মাঝে চতনসেরিতে চা বিরতি।

কাসলে আমাদের ঠেক ছিল পার্বতীর ধারে ‘রিভার গার্ডেন’ রিসর্ট। বিপাশার উদ্দেশে পার্বতীর বয়ে চলা দেখতে দেখতেই সময় কেটে যায় এখানে। কাছেই মণিকরণ, ৪ কিলোমিটার। বিকেলেই ঘুরে এলাম। শিখ ও হিন্দু ধর্মের তীর্থস্থান মণিকরণ। পার্বতীর ধারে এই মণিকরণে রয়েছে শিব-পার্বতী মন্দির এবং শিখ গুরুদ্বার। শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানক তাঁর শিষ্য ভাই মর্দানাকে নিয়ে এখানে এসেছিলেন। এখানকার পাহাড়ি দুঃস্থ মানুষদের জন্য খুলেছিলেন লঙ্গর। মণিকরণ আরও বিখ্যাত তার উষ্ণ প্রস্রবণের জন্য। তত্তাপানির উষ্ণ প্রস্রবণের মতো হতাশ করল না মণিকরণ। দেখে ভালো লাগল, এই উষ্ণ প্রস্রবণের উপর দিয়ে কেউ হোটেল খোলার চেষ্টা করেনি। বলতে দ্বিধা নেই, গুরুদ্বার আর মন্দিরের জন্যই সেটা করা সম্ভব হয়নি। এরাই দেখভাল করছে উষ্ণ প্রস্রবণের।

কাসলে ঠান্ডা কিছুটা কম, অন্তত সিস্‌সু বা শানগড়ের মতো নয়। কার্যত আজই আমাদের ভ্রমণের শেষ দিন। কাল সকালেই রওনা হয়ে যাব চণ্ডীগড়ের পথে। তাই সন্ধ্যায় একটা আসরের আয়োজন করল শ্রয়ণ। মূলত গানের। দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল আমাদের দশ রাতের ভ্রমণ। (শেষ)

ছবি: শ্রয়ণ সেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *