পুজোয় চলুন/ উত্তরপূর্ব ভ্রমণছক ৬: ত্রিপুরা

আর দিন সাতেকের অপেক্ষা। তার পরেই শুরু হয়ে যাবে পুজোয় বেড়াতে যাওয়ার জন্য ট্রেনের আসনের আগাম সংরক্ষণ। সুতরাং আর দেরি নয়। এখনই করে ফেলুন পুজোর ভ্রমণ পরিকল্পনা। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য ভ্রমণ অনলাইন এ বারও সাজিয়ে দিচ্ছে এক গুচ্ছ ভ্রমণ পরিকল্পনা। শুরু করেছে উত্তর-পূর্ব ভারত দিয়ে। আজ ত্রিপুরা।

ভারতের উত্তরপূর্বের রাজ্য হওয়ার ফলে পর্যটন মানচিত্রে ত্রিপুরা কিছুটা ব্রাত্যই। কিন্তু প্রাসাদ, জঙ্গল, পাহাড়, মন্দির, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, সব মিলিয়ে দেশের অন্য কোনো রাজ্যের থেকে কম যায় না ত্রিপুরা।

সফরসূচি

ভ্রমণ শুরু করুন আগরতলা থেকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে আগরতলা বিমান ও ট্রেনপথে যুক্ত। তবে দেশের একেবারে শেষ প্রান্তে হওয়ার কারণে ত্রিপুরা ভ্রমণের ক্ষেত্রে অন্তত একটা দিক বিমানপথ ব্যবহার করতেই পারেন। তাতে অনেক সময় বাঁচে।    

প্রথম দিন – আগরতলা পৌঁছোন। রাত্রিবাস আগরতলা।

দ্বিতীয় দিন– আগরতলায় ঘোরাঘুরি। রাত্রিবাস আগরতলা।

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত।

আগরতলায় দ্রষ্টব্য –

(১) উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ – শহর থেকে ১০ কিমি দূরে।

(২) মহারাজ বীর বিক্রম কলেজ – প্রাসাদ থেকে ৩ কিমি, টিলার টঙে কলেজটি। কলেজের পরিবেশ চেয়ে দেখার মতো।

(৩) চতুর্দশ দেবতা মন্দির ও প্রাসাদ – শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে ৬ কিমি।

(৪) কুঞ্জবন – শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে ৫ কিমি। অনুচ্চ টিলায় ত্রিপুরার রাজাদের অতীতের পুষ্পবন্ত প্রাসাদ তথা আজকের কুঞ্জবন। রয়েছে রাজাদের অবসর বিনোদনের জায়গা মালঞ্চ নিবাস। ১৯১৯-এ রবীন্দ্রনাথও ছিলেন এই মালঞ্চ নিবাসে। কাছেই বুদ্ধমন্দির – বেণুবন বিহার।  

(৫)  বাংলাদেশ বর্ডার – শহর থেকে ২ কিমি দূরে ।

কমলাসাগরে কালীবাড়ি।

তৃতীয় দিন – সকালে আগরতলা থেকে বেরিয়ে পড়ুন। চলুন ২৪ কিমি দূরে কমলাসাগর। কমলাসাগরের অদূরে টিলার ওপর কালীবাড়ি। দেখুন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত হাট। কাঁটাতারের বেড়ার ও-পারে বাংলাদেশকে। দেখা যাবে বাংলাদেশের কসবা রেলস্টেশন। রাত্রিবাস কমলাসাগর।

চতুর্থ দিন – গন্তব্য সিপাহিজলা অভয়ারণ্য হয়ে মেলাঘর। সিপাহিজলায় দেখুন চশমা বাঁদর-সহ নানা প্রাণী। অভয়ারণ্যের মধ্যে রয়েছে লেক। কমলাসাগর থেকে সিপাহিজলা ২৭ কিমি, সেখান থেকে২৯ কিমি মেলাঘর। মেলাঘর থেকে চলুন রুদ্রসাগর, ২ কিমি। বিশাল সরোবর রুদ্রসাগর, এর তীরে নীরমহল প্রাসাদ। কিন্তু নীরমহল দেখতে হলে নৌকায় রুদ্রসাগর পেরোতে হবে। সন্ধ্যায় দেখে নিন নীরমহলের লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো। রাত্রিবাস মেলাঘর।

নীরমহল।

পঞ্চম দিন – গন্তব্য পিলাক। দূরত্ব ৬১ কিমি। রাত্রিবাস পিলাক। এ দিন পিলাকে দেখে নিন –

(১) নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন – টেরাকোটার নানা মন্দির, স্তূপ, বিরল পাথরের শিবলিঙ্গ, ৮ হাতের শক্তি, নৃসিংহদেব, মহিষাসুরমর্দিনী, গণেশ, অবলোকিতেশ্বর, প্রাচীন মুদ্রা ছাড়াও অনেক কিছু।

(২) কালাপানিয়া নেচার পার্ক – পিলাক থেকে ১৪ কিমি।

(৩) মহামুনি বুদ্ধমন্দির – কালাপানিয়া থেকে আরও ১১ কিমি।

ষষ্ঠ দিন – এ দিনও থাকুন পিলাকে। ঘুরে আসুন ৬৯ কিমি দূরের তৃষ্ণা অভয়ারণ্য। নানা প্রজাতির বানরের জন্য বিখ্যাত এই অভয়ারণ্য – সোনালি বানর, লজ্জাবতী বানর, গুহা বানর, অসমিয়া বানর ইত্যাদি।  

সপ্তম দিন – সক্কালেই চলে আসুন উদয়পুর। দূরত্ব ৪৬ কিমি। রাত্রিবাস উদয়পুর। এখানে দেখে নিন –

মহামুনি বুদ্ধমন্দির।

(১) ভুবনেশ্বরী মন্দির – রবীন্দ্রনাথের ‘রাজর্ষি’ ও ‘বিসর্জন’ খ্যাত, শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে ৩ কিমি।

(২) ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির – অন্যতম সতীপীঠ, সতীর ডান পা পড়েছিল, শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে ৫ কিমি দূরে মাতাবাড়িতে।

(৩) ছবিমুড়া – গোমতী নদীতে নৌকায় ভেসে দেখুন পাহাড়ের গায়ে খোদিত ১৫-১৬ শতকের নানা শিল্পকর্ম। উদয়পুর থেকে ৩৮ কিমি।     

অষ্টম দিন – গন্তব্য মিজোরাম সীমানায় জম্পুই হিলসের পাদদেশে ভাংমুনে। দূরত্ব ২১৫ কিমি। রাত্রিবাস ভাংমুনে।

নবম দিনজম্পুই হিলসের প্রকৃতি উপভোগ করুন। টুরিস্ট লজ থেকে সূর্যোদয় উপভোগ করুন। সূর্যাস্ত দেখতে চলুন ৩০ কিলোমিটার দূরে বেটলিংচিপ-এ। ভাংমুন হেলিপ্যাড থেকেও সূর্যাস্ত দেখা যায়। বেটলিংচিপ পাহাড়ে আছে শিবমন্দির। রাত্রিবাস ভাংমুন।

জম্পুই পাহাড়ে সূর্যাস্ত।

দশম দিন – সক্কালেই বেরিয়ে পড়ুন, গন্তব্য কৈলাশহর/ধর্মনগর। ধর্মনগর ৭৭ কিমি, কৈলাশহর ৯১ কিমি। চলুন উনকোটি। উনকোটিকে বিখ্যাত করেছে এখানকার পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা শিল্পকর্ম। জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়, গা ছমছমে পরিবেশ। কৈলাশহর থেকে ১০ এবং ধর্মনগর থেকে ১৯ কিমি। রাত্রিবাস কৈলাশহর/ধর্মনগর।

একাদশ দিন – ফিরুন আগরতলা। ধর্মনগর থেকে দুরত্ব ১৭১ কিমি, কৈলাশহর থেকে ১৪০ কিমি। রাত্রিবাস আগরতলা।

দ্বাদশ দিন – ঘরপানে চলুন।

মনে রাখবেন

(১) দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে আগরতলা বিমানপথে যুক্ত। কলকাতা থেকে সারা দিনে অসংখ্য বিমান। তাই কলকাতা থেকে খুব সকালে বিমান ধরতে পারলে সে দিনই আগরতলা শহর ঘুরে নেওয়া যায়। কৈলাশহর বা ধর্মনগর থেকে ফিরে সে দিনই আগরতলা থেকে কলকাতার বিমান ধরা যায়। এই ভাবে ১০ দিনেই সাঙ্গ করা যায় ত্রিপুরা ভ্রমণ। আরও তাড়া থাকলে জম্পুই হিলসে ১ দিনও থাকতে পারেন। তা হলে ৯ দিনেই সাঙ্গ হয় ত্রিপুরা ভ্রমণ। তবে জম্পুই হিলসে এক দিন থাকলে বুড়ি ছোঁয়া হয়, ‘চির বসন্তের দেশ’ উপভোগ করা যায় না।

উনকোটির শিল্পকর্ম।

(২) আগরতলা এখন ট্রেন পরিষেবা চালু হয়েছে। হাতে সময় থাকলে অন্তত একটা যাত্রা ট্রেনে করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে লামডিং-বদরপুর পাহাড়ি সেকশনের ট্রেন যাত্রা উপভোগ করতে পারবেন। কলকাতা থেকে আগরতলা যাওয়া-আসার ট্রেন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। শিয়ালদহ থেকে প্রতি মঙ্গল, বৃহস্পতি, শুক্র এবং রবিবার সকাল ৬:৩৫ মিনিটে ছেড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস আগরতলা পৌঁছোয় পরের দিন বিকেল ৫.৫৫ মিনিটে। ফিরতি ট্রেন প্রতি মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি ও রবিবার সকাল ৮.০৫-এ আগরতলা থেকে ছেড়ে শিয়ালদহ পৌঁছোয় পরের দিন সন্ধে ৭:২৫-এ।

(৩) গুগুল সার্চ করে বিমানের সময় দেখে নিন।

কী ভাবে ঘুরবেন

(১) ভ্রমণ যে হেতু আগরতলায় শুরু হয়ে আগরতলায় শেষ, তাই একটা গাড়ি ভাড়া করে ঘুরলে সব থেকে আরামদায়ক হবে। তবে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার জন্য বাস সার্ভিস আছে। তবে তাতে সময়সূচি রক্ষা করা কঠিন।

(২) ত্রিপুরা সরকারের প্যাকেজ ট্যুরেও ঘুরতে পারেন। তবে এক সঙ্গে সবটা কভার হবে না। দেখুন ত্রিপুরা পর্যটনের ওয়েবসাইট  www.tripuratourism.gov.in।

জম্পুই হিলসে ইডেন টুরিস্ট লজ থেকে।

কোথায় থাকবেন

ত্রিপুরা পর্যটন এখন অনেক বেশি উন্নত। সব জায়গাতেই রয়েছে পর্যটন উন্নয়ন নিগমের টুরিস্ট লজ। অন্য রাজ্যের সরকারি হোটেলের থেকে ভাড়াও তুলনায় অনেক কম। আগরতলায় আছে গীতাঞ্জলি গেস্ট হাউস, কমলাসাগরে রয়েছে কুমিল্লা ভিউ টুরিস্ট লজ, মেলাঘরে আছে সাগরমহল টুরিস্ট লজ, পিলাকে রয়েছে পিলাক টুরিস্ট লজ, উদয়পুরে রয়েছে গোমতি যাত্রী নিবাস, জাম্পুইয়ে আছে ইডেন টুরিস্ট লজ, কৈলাশহরে আছে ঊনকোটি টুরিস্ট লজ এবং ধর্মনগরে রয়েছে জুরি টুরিস্ট লজ। সব হোটেল অনলাইনে বুক করা যায় ত্রিপুরা পর্যটনের ওয়েবসাইটে গিয়ে  www.tripuratourism.gov.in।

এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় বেসরকারি হোটেল আছে। হোটেল বুকিং-এর ওয়েবসাইটগুলিতে গিয়ে অনলাইন বুক করতে পারেন।

আরও পড়তে পারেন

পুজোয় চলুন/ উত্তরপূর্ব ভ্রমণছক ১: গুয়াহাটি-হাফলং-শিলচর

পুজোয় চলুন/ উত্তরপূর্ব ভ্রমণছক ২: গুয়াহাটি-পোবিতোরা-কাজিরাঙা-মাজুলি-শিবসাগর

পুজোয় চলুন/ উত্তরপূর্ব ভ্রমণছক ৩: গুয়াহাটি-শিলং-চেরাপুঞ্জি-মওলিননং-ডাওকি

পুজোয় চলুন/ উত্তরপূর্ব ভ্রমণছক ৪: শিলং-চেরাপুঞ্জি-মওলিননং-গুয়াহাটি-ভালুকপং-বমডিলা-তাওয়াং-দিরাং

পুজোয় চলুন/ উত্তরপূর্ব ভ্রমণছক ৫: গুয়াহাটি-নামেরি-বমডিলা-তাওয়াং-দিরাং

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *