শ্রয়ণ সেন
উত্তরাখণ্ডের জোশীমঠ ভ্রামণিক এবং তীর্থযাত্রীদের কাছে খুব পবিত্র এক শহর। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরেই উত্তরাখণ্ডের এই প্রাচীন শহরে আতংকের পরিবেশ। রাতবিরেতে মাটির তলা থেকে ভেসে আসে অদ্ভুতুড়ে সব আওয়াজ। বহু বাড়িতে ফাটল ধরছিল আগেই। ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির সেই তালিকাটা এখন হু হু করে বাড়ছে। প্রশাসনের হিসেবে অন্তত পাঁচশো! শহরের আনাচে-কানাচে এখন একটাই আলোচনা। তলিয়ে যাচ্ছে জোশীমঠ।
পাহাড়ি এই শহরের জেপি কলোনি হোক বা মাড়োয়ারি এলাকা — রোজ নতুন নতুন বাড়িতে ফাটলের আতংক দেখা দিচ্ছে। শুক্রবার সন্ধেতে একটি মন্দির ভেঙে পড়েছে। তবে সেটি পরিত্যক্ত হওয়ায় হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। পাশাপাশি, শহরের রাস্তা থেকে চাষের জমি — বহু জায়গায় বিপজ্জনক ফাটলের মুখে উন্মুক্ত হয়েছে পাতালের অন্ধকার।

কোথাও আবার ফাটল চুঁইয়ে বেরিয়ে আসছে ভূগর্ভস্থ জলের ধারা। এই পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার থেকে বদরীনাথ জাতীয় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। শুক্রবার সকাল থেকেই উত্তরাখণ্ড সরকারের তরফে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
ঘটনা শুরু গত সোমবার। ওই দিন মাঝরাতে মাটির নীচে আচমকা বিকট শব্দ শুনতে পান শহরের বাসিন্দারা। তার পর থেকেই একটার পর একটা বাড়ি থেকে ফাটলের খবর আসতে শুরু করে। কিছু বাড়িতে আবার ফাটল চুঁইয়ে জল বেরিয়ে আসতে শুরু করে।
সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, জোশীমঠে অন্তত ৫৬১টি বাড়িতে ফাটল দেখা গিয়েছে। কিছু জায়গায় মাটির ফাটল থেকে উঠে আসছে জল। ইতিমধ্যে পর্যটকদের জন্য বন্ধ করা হয়েছে এশিয়ার দীর্ঘতম রোপওয়ে। এই রোপওয়ে করেই জোশীমঠ থেকে আউলি পর্যন্ত যান পর্যটকরা। দু’টি হোটেল পুরোপুরি বন্ধ করা হয়েছে।

কেন তলিয়ে যাচ্ছে জোশীমঠ? কারণ খুঁজতে গিয়ে উঠে আসছে প্রায় ৫০ বছরের পুরোনো একটি রিপোর্টের কথা। ১৯৭৬ সালে মিশ্র কমিটি নামে একটি সমীক্ষক দলের রিপোর্টে স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল, হিমালয়ের ধসপ্রবণ এলাকার উপরে গড়ে উঠেছে শহরটি। রিপোর্টে জানিয়েছিল, ‘‘সড়ক মেরামতি বা অন্য নির্মাণ কাজের জন্য বোল্ডার খনন করে সরানো উচিত নয়। পাহাড়ের ধারে বিস্ফোরণ ঘটানোও অনুচিত। আর গাছকে শিশুর মতো লালনপালন করা উচিত।”
তৎকালীন উত্তরপ্রদেশের গাড়োয়ালের কমিশনার এমসি মিশ্রের নির্দেশে সেই কমিটি তৈরি করা হয়েছিল। কমিটিতে ছিলেন ১৮ জন। সেনা, আইটিবিপি, শ্রীকেদারনাথ-বদরীনাথ মন্দির কমিটির সদস্যরাও ছিলেন কমিটিতে। ১৯৭৬ সালের ১০ থেকে ১৫ মে জোশীমঠ-সহ গাড়োয়ালে ভূমি পরিদর্শন করে সেই কমিটি। পরিদর্শনের পরেই রিপোর্ট দিয়ে মিশ্র কমিটি বলে, ‘‘অতীতের ভূমিধসের উপর তৈরি হয়েছে জোশীমঠ।’’
কমিটি সুপারিশ করে, প্রাচীন ওই শহরে বেশি নির্মাণকাজ চালানো ঠিক নয়। তাদের সাফ দাবি ছিল যে মানুষের কর্মকাণ্ডের জেরে জোশীমঠের স্থায়িত্ব বড়োজোর ১০০ বছর। এর মধ্যে শহরটি ধীরে ধীরে তলিয়ে যাবে।
কিন্তু কে শোনে কার কথা! সে সব সতর্কবার্তা উড়িয়ে দিয়ে দিনে দিনে আড়ে-বহরে শহর বেড়েছে। ধাপ কেটে, সুড়ঙ্গ খুঁড়ে তৈরি হয়েছে রাস্তাঘাট, নতুন জনবসতি। সঙ্গে একের পর এক জলাধার, জলবিদ্যুৎ প্রকল্পও।
উত্তরাখণ্ড কিন্তু অতীতেও ভয়াবহ দুর্যোগের কবলে পড়েছে। অতীতের সতর্কবাণী না মেনে উত্তরাখণ্ড ফল ভুগেছিল ২০১৩ সালে। মেঘভাঙা বৃষ্টিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৬ হাজার জনেরও বেশি মানুষ। সেই ফল ভুগেছিল জোশীমঠও। তার পরেও শিক্ষা নেওয়া হয়নি। গাড়োওয়াল অঞ্চল জুড়ে প্রকৃতিতে ধ্বংস করে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ ক্রমেই বেড়েছে।
কর্ণপ্রয়াগ পর্যন্ত রেল লাইন, চার ধাম সংযুক্ত করার জন্য চার লেনের সড়ক, ১১ হাজার ফুট উচ্চতার কেদারনাথের ভোল পালটে ফেলা, প্রকৃতির ওপরে যতটা অত্যাচার করা যায় সব করা হয়েছে উত্তরাখণ্ডের এই গাড়োয়াল অঞ্চলে। কিন্তু লাভটা কী হল? চার লেনের রাস্তা তো দূর, জোশীমঠ থেকে বদরীনাথগামী বর্তমান রাস্তায় এখন নানা জায়গায় ফাটল। রাস্তার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে বিপদ আসন্ন।

শুধু ২০১৩-এর বিপদ নয়, দুর্যোগ ২০২১ সালেও হানা দিয়েছিল জোশীমঠে। গ্লেসিয়ার ফেটে হড়পা বান দেখা দিয়েছিল বিষ্ণুগঙ্গা এবং অলকানন্দায়। কাদা-ধসের বন্যায় তলিয়ে গিয়ে প্রায় ২০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তখন থেকেই জোশীমঠের বাড়িগুলিতে বড়ো বড়ো ফাটল নজরে আসতে শুরু করে।
বিজ্ঞানীদের মতে, ভারী নির্মাণকাজের জেরে বিপদের মুখে আজ শহরটি। শুধু রেল লাইন বা সড়ক প্রকল্পই নয়, বিজ্ঞানীরা সরাসরি আঙুল তুলেছেন দু’টি নির্মাণকাজের দিকে। তপোবন-বিষ্ণুগড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও হেলাং পাসে নির্মাণকাজ। টনক নড়ার ফলে আপাতত সেই দু’টি ক্ষেত্রে কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন চামোলির জেলাশাসক।
বার বার দুর্যোগের সঙ্গে যুঝে ওঠার পর মাথা তুলে দাঁড়ালেও ক্ষত আর সেরে ওঠেনি। বার বার জানান দিয়েছে সেই ক্ষত। তার থেকে রক্তপাত এখনও অব্যাহত।
জোশীমঠের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির জন্য উত্তরাখণ্ড সরকারের তরফ থেকে কিছু পদক্ষেপ করা হচ্ছে। তাদের পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে। আর্থিক সাহায্যও করা হচ্ছে। কিন্তু ভিটেমাটি হারিয়ে যে সহায়সম্বলহীন হয়ে পড়া মানুষগুলি আজ যে বড্ড অসহায়। মানুষের কর্মযজ্ঞের ফলই এখন ভুগতে হচ্ছে সবাইকে।

প্রকৃতির ওপরে অত্যাচার চালালে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেবেই, এটা যে এখন শুধু কথার কথা নয়, বরং বাস্তবচিত্র, সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছে জোশীমঠ।