ভ্রমণঅনলাইনডেস্ক: বৃষ্টির ভ্রূকুটি রয়েছে। তাই কেউ আর সময় নষ্ট করতে চান না। মহালয়ার পর থেকেই মহানগরীতে ঠাকুরদর্শনে নেমে পড়েছেন। কলকাতা শহরকে ভাগ করে নিয়েছেন কয়েকটি অঞ্চলে এবং এক এক দিন এক এক অঞ্চলে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন।
আপনাদের কথা ভেবে ভ্রমণঅনলাইনও রাস্তায় নেমে পড়েছে। যতটুকু ঘোরা সম্ভব সেটা মাথায় রেখে সাজিয়ে দিয়েছে পুজো পরিক্রমার ছক। শুরু করা যাক পূর্ব কলকাতা দিয়ে। প্রথমেই যাওয়া যেতে পারে ভিআইপি রোড অঞ্চলে। সেখান থেকে ঘুরে ঢুকে পড়ুন সল্টলেকে। তার পর বেলেঘাটা, কাঁকুড়গাছি হয়ে উলটোডাঙা।
ভিআইপি রোড অঞ্চল
দমদম পার্ক তরুণ দল
৪২তম বর্ষে দমদম পার্ক তরুণ দল। এই বছরের থিম ‘দেবীপক্ষ’। এখানে থিমের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজন। তাঁদের জীবনযাত্রা, আনন্দ, বেদনা ইত্যাদি অনুভূতি নিয়ে কাজ হয়েছে। থিম ফুটিয়ে তুলতে তাঁদের হাততালি, নাচ, ঘুমুর, বিনুনি, ট্রাফিক সিগন্যাল ইত্যাদিকে প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
দমদম পার্ক তরুণ সংঘ
থিমশিল্পী রিন্টু দাসের কথায়, “২০৯১তে পৃথিবীর চেহারা কেমন হবে, কী অবস্থা হবে, এ সব তা আজকের ফ্ল্যাট কালচারই অনেকটা আভাস দেয়। সব জলাজমি বুঝে বহুতল তৈরি হবে, অক্সিজেন থাকবে না, তার জন্য মারামারি শুরু হবে, অক্সিজেন নিয়েই বড়সড় কেলেঙ্কারি হবে, কালোবাজারি হবে।” দেবীমূর্তি যেখানে অধিষ্ঠিত তার সজ্জা একেবারে অন্যরকম। একটি সাবেকি দুর্গাদালান, হাঁড়িকাঠ, খাঁড়া, তুলসীমঞ্চ। দমদম পার্ক ট্যাঙ্ক নম্বর ৩–এর কাছে।
দমদম পার্ক ভারতচক্র
এদের এ বারের থিম ‘মূর্ত-বিমূর্ত’। দুয়ের দ্বন্দ্ব মেটাতে পারে তথ্য ও শিক্ষা। সেই বার্তাই ফুটে উঠেছে এদের পুজোমণ্ডপে। দমদম পার্ক ট্যাঙ্ক নম্বর ২–এর কাছে।
দমদম পার্ক যুবকবৃন্দ
গত শতকের শেষ থেকেই পরিবেশবিদরা বলে আসছেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে জল নিয়ে। যে কথা এই সময়ে বলা হয়েছিল তখন অনেকে হেসেছিলেন। কিন্তু এখন এটা বাস্তব সত্য। যে ভাবে মাটি থেকে জল টেনে নেওয়া হচ্ছে, তাতে এই বিশ্বের অনেক জায়গাই জলশূন্য হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও মহার্ঘ হবে জল। তাই এখন থেকেই জল বাঁচাতে হবে। ৫৩তম বর্ষে দমদম পার্ক যুবকবৃন্দের থিম হল ‘জল ধর, জল ভর’।
লেকটাউন অধিবাসীবৃন্দ
পরিবেশ এ বার অনেক পুজোরই থিম। লেকটাউন অধিবাসীবৃন্দের পুজোর থিমও সেই কেন্দ্রিক। গাছ লাগানো আর গাছ বাঁচানোর বার্তা দিয়েছে। ভাবনার শিরোনাম ‘নব পত্রিকা নয় নয়টি পাতা মাতৃরূপেন সংহস্তিতা’। মানবজাতিই তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছে। এ বার বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে গাছের ভূমিকা, তথা গাছকে মা রূপে পুজো করার ভাবনাই ফুটে উঠেছে এদের পুজোয়। ‘নবপত্রিকা’র এই আঙ্গিকটি নেওয়ার মূল উদ্দেশ্য সমাজকে বিশ্ব উষ্ণায়নের সম্পর্কে সতর্ক করা। আর এই উষ্ণায়নের হাত থেকে আমাদের বাঁচাতে পারে একমাত্র গাছ। তাই আবেদন গাছ বাঁচান এবং গাছ লাগান। পরিবেশ সন্দর রাখুন।
শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাব
৪৮তম বর্ষের পুজোয় তুলে আনা হয়েছে মৌর্য আমলের এক মন্দির। তাতেই পূজিত হচ্ছেন দশভুজা। পুজোর বিশেষ আকর্ষণ সুবিশাল ঝাড়বাতি। এটি রয়েছে গোটা মণ্ডপের অন্দর জুড়ে। সঙ্গে থাকছে বিভিন্ন জিনিসের কারুকাজ। প্রতিমার সাজেও রয়েছে চমক।
সল্টলেক
ভিআইপি রোড ধরে ঠাকুর দেখে এসে এ বার ঢুকে পড়ুন সল্ট লেকে।
লাবণি আবাসন
এ বার লাবণি আবাসনের থিম ‘তরঙ্গের উচ্ছ্বাস’। মণ্ডপে ও তার বাইরে অঙ্গসজ্জায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সেই তরঙ্গ। এবং ব্যবহার করা হয়েছে বাঁশ, কঞ্চি। প্রতিমা সাবেক। ভিতরে থিম অনুযায়ী আলোকসজ্জা।
বিজে ব্লক
বিজে ব্লক এ বছরের পুজোয় তুলে এনেছে কার্টুনশিল্প। মূল মণ্ডপ পাহাড়ের উপর, কার্টুন চরিত্র ভীমের বাড়ির আদলে। মণ্ডপে জাদুকর ম্যানড্রেক থেকে বেতাল, হাঁদাভোঁদা, টিনটিন – কী নেই! থিম অনুসারে আলোর ব্যবহার। মাতৃমূর্তি রাজবাড়ির প্রতিমার গড়নে।
একে ব্লক
এই বছরের থিম ‘মোহ’। দেখানো হয়েছে প্রত্যেক মানুষই একে অন্যের সঙ্গে কোনো না কোনো সম্পর্কে বাঁধা। সেটা বোঝাতেই গোটা মণ্ডপটি মাকড়সার জালের মতো। ফাইবারের প্রতিমা ঝুলন্ত। মণ্ডপের এক দিকে রয়েছে সাবেক প্রতিমা।
এই (পার্ট ওয়ান)
এদের থিম ‘লাঠি’। আসলে প্রবীণ নাগরিকরাই এদের ভাবনায়। তাই এই থিম। বয়স্কদের উপযোগী আস্ত শহর তুলে ধরা হয়েছে মণ্ডপে। বাইরে ৫২ আসনের প্রতীকী বাস। বড়ো ছাতা, লাঠি আর নলকূপ দিয়ে সাজানো হয়েছে মণ্ডপ। আসলে বোঝানো হয়েছে, নলকূপের ব্যবহার এখন যেমন ক্রমশ কমছে, প্রবীণরাও তেমনই ব্রাত্য হয়ে যাচ্ছেন।
এফডি ব্লক
এই পুজো তাদের থিম-ভাবনা থেকে খুব একটা সরে আসেনি। এ বারেও তাদের ভাবনায় শিশু- কিশোররাই। তাই থিমের নাম ‘এলেম নতুন দেশে’। আনন্দ দিতে পার্কের মধ্যেই তৈরি হয়েছে আরও একটি পার্ক। সেখানে রয়েছে প্রায় ২৫ রকমের ডাইনোসর। ৩৪তম বর্ষের পুজোয় থিমের নাম, ‘ডাইনোসর পার্ক-এফডি পারক’। প্রতিমা সাবেক। আলো মানানসই। পুজো উপলক্ষ্যে এফডি পার্কে বসেছে মেলা। সে-ও এক আকর্ষণ।
বেলেঘাটা
সল্টলেক থেকে বেরিয়ে পড়ে ঢুকে পড়ুন বেলেঘাটায়।
বেলেঘাটা সরকার বাজার বিবেকানন্দ সঙ্ঘ
এই পুজোর ভাবনা পরিবেশ কেন্দ্রিক। ‘জলই জীবন, জলের অপচয় বন্ধ করুন’- এ বার দুর্গাপূজোয় বেলেঘাটা সরকার বাজার বিবেকানন্দ সংঘ এই বার্তায় দিচ্ছে। এ বার এদের পুজো ৭১ বছরে পা দিল। বিশ্ব জুড়ে জল সংকট চলছে। তবু জল অপচয় বন্ধ হচ্ছে না। সমস্যায় পড়বে পরের প্রজন্ম। জল সংরক্ষণ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতেই এই থিম বেছে নিয়েছে। বেলেঘাটা মেন রোডে সরকার বাজারের কাছ মণ্ডপ।
বেলেঘাটা ৩৩ পল্লি
এ বার চলুন ৩৩ পল্লির ঠাকুর দেখতে। এ বছরের থিম ‘আমরা এক, একা নই’। জাতপাত-ধর্ম কেন্দ্রিক রাজনীতির বিরোধিতা করতে এর বার্তা দেওয়া হয়েছে। প্রবেশপথে ২৪ ফুট উঁচু লোহার ছাতার গায়ে রয়েছে বিভিন্ন ধর্মের অসংখ্য চিহ্ন। প্রতিমা ডোকরার, এসেছে বর্ধমানের গুসকরা থেকে। মণ্ডপে ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে প্রতিমা। ফুলবাগানের মোড় পেরিয়ে ডান দিকে পুজোমণ্ডপ।
কাঁকুড়গাছি
বেলেঘাটার ঠাকুর দেখে চলে আসুন কাঁকুড়গাছিতে।
কাঁকুড়গাছি যুবকবৃন্দ
এ বছর থিমের নাম ‘ভোরাই’, বোঝাতে চাওয়া হয়েছে অন্ধকারের শেষে নতুন দিনের সূচনা। বিরাট বজরার আদলে তৈরি হয়েছে মণ্ডপ। মণ্ডপে ঢোকার আগে উপরে রয়েছে প্লাই দিয়ে তৈরি নতুন সূর্য। অন্দরসজ্জায় ব্যবহার করা হয়েছে প্রায় দু’হাজার নৌকার দাঁড় এবং কাঠের কাজ। মাটির আরও কাজ রয়েছে। মাটির হাঁড়ি দিয়ে তৈরি হয়েছে ঝাড়বাতি। প্রতিমা সাবেক। কাঁকুড়গাছি মোড়ের আগে বাঁ দিকের রাস্তায় মণ্ডপ।
স্বপ্নার বাগান
পরিবেশ, বিশেষ করে জল এ বারের পুজোয় একটা জনপ্রিয় থিম। ৬৬তম বর্ষে স্বপ্নার বাগান-এর ভাবনাতেও জল সংরক্ষণ। অবিলম্বে জলের অপচয় বন্ধ না করলে যে ভয়াবহ সঙ্কট আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, বিভিন্ন ইনস্টলেশনের মাধ্যমে সেই বার্তাই তুলে ধরা হয়েছে। মণ্ডপে রয়েছে সমুদ্রসৈকতের পরিবেশ। নোনা জল কী ভাবে মিষ্টি জলকে গ্রাস করছে, তুলে ধরা হয়েছে সে কথাও। থিমের সঙ্গে মানানসই প্রতিমা। কাঁকুড়গাছি মোড় থেকে বাইপাসের দিকে, মানিকতলা মেন রোডে।
কাঁকুড়গাছি মিতালি
৮৩তম বর্ষে এদের থিমের নাম ‘ছদ্মবেশ’। দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমণ্ডি গ্রামের লোকসংস্কৃতি তুলে ধরা হচ্ছে এই থিমে। মণ্ডপ জুড়ে রয়েছে অসংখ্য মুখোশ, পেঁচা, মাটির ভাঁড়ের কাজ, ছদ্মবেশের অসংখ্য মডেল। প্রতিমা সাবেক। কুশমণ্ডি গ্রামের শিল্পীদের একটি দলও এসেছে পুজোর পাঁচ দিন ধরে নানা অনুষ্ঠান করার জন্য।
উলটোডাঙা
কাঁকুড়গাছি থেকে চলে আসুন উলটোডাঙায়। স্টেশন ছাড়িয়ে এগিয়ে চলুন অরবিন্দ সেতুর দিকে।
তেলেঙ্গাবাগান
কিছুটা এগিয়ে প্রথমেই ডান দিকে পড়বে তেলেঙ্গাবাগান। তেলেঙ্গাবাগান সর্বজনীনের এ বারের থিম ‘পুনর্জন্ম’। হিন্দু ধর্মের স্বীকৃত সত্য হল পুনর্জন্ম। জন্মান্তরবাদে আছে, মানুষ কাম ক্রোধ অহংকার মোহ এ রকম সব আসক্তি থেকে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত পুনর্জন্ম হতে থাকে। এক কথায় ষড়রিপুর প্রভাব থেকে মুক্ত না হলে জন্ম নেওয়া শেষ হয় না। সেই মুক্তিলাভের এক মাত্র পথ এই সব থেকে দূরে থাকা। প্রতিমার চার দিক রয়েছে বিভিন্ন দেবতা ও কাম ক্রোধ ইত্যাদি রিপুর মডেল। দেবীর দশ হাতে কিরণ। অস্ত্র নেই।
উলটোডাঙা পল্লিশ্রী
অরবিন্দ সেতুর দিকে আর একটু এগিয়ে ডান দিকে পল্লিশ্রীর মণ্ডপ। উলটোডাঙা পল্লশ্রীর এ বারের নিবেদন ‘বর্ণমৈত্রী’। তাদের এই বছরের থিমশিল্পী অশোক দত্তের কথায়, “প্রকৃতির সমস্ত রঙই দেবীর থেকেই সৃষ্টি, আবার তাঁর কাছেই লীন। মানুষের কাছে তাই তাঁরা বার্তা দিতে চান, ‘রঙটাকে ভালোবেসো, রঙ নিয়ে ভেদাভেদ করো না।”
করবাগান সর্বজনীন
অরবিন্দ সেতুর দিকে আরও এগিয়ে করবাগানের পুজো, পল্লিশ্রীর কাছেই। করবাগানের থিম ‘সমাপ্তি’। থিমের মূল বিষয় ‘শেষ বলে কিছু নেই। শেষ মানেই নতুন শুরু’। তাই সেখানে দুঃখ নেই। পুজো উদ্যোক্তাদের মতে, মৃত্যু মানেই শেষ নয়। নতুন শুরুর আভাস। তেমনই যে কোনো শেষ মানেই অন্য নতুন কিছুর শুভারম্ভ। সেই শুরু আর শেষের সন্ধিক্ষণ নিয়েই তাঁদের কাজ। থিমের সঙ্গে মানানসই আলো।
গৌরীবেড়িয়া সর্বজনীন
অরবিন্দ সেতু পেরিয়ে আসুন। সেতুর গা ঘেঁসে ডান দিকের রাস্তায় পূজামণ্ডপ। এ বারের থিম ‘ভিনদেশি তারা’। জীবনের ইঁদুর দৌড়ে শামিল হতে গিয়ে সন্তান কী ভাবে বাবা-মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে যায়, তা-ই দেখানো হয়েছে ৮৬ বছরে পা দেওয়া এই পুজোয়। মণ্ডপে রয়েছে ফেলে আসা বাড়ি, স্কুল, বাঁশঝাড়। মায়ের অধিষ্ঠান ঠাকুরদালানে। মণ্ডপের বাইরে অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে কর্পোরেট দুনিয়া।
লালাবাগান নবাঙ্কুর
ঢুকে পড়ুন রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে, শ্যামবাজারের দিকে নয়, মানিকতলার দিকে। দীনেন্দ্র স্ট্রিটে ঢুকে ডান দিকের রাস্তায় নবাঙ্কুরের মণ্ডপ। ৬০তম বর্ষে এই পুজোর স্লোগান ‘অনাহারের আহার’। খাবারের অপচয় বন্ধ করতে সচেতনতার বার্তা দেওয়া হয়েছে মণ্ডপে। অ্যালুমিনিয়াম আর স্টিলের বাসন দিয়ে মণ্ডপের ভিতর ও বাইরের সাজ। প্রতিমা সাবেক। দুর্গার গলায় লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক আর গণেশ।
হালসিবাগান সর্বজনীন
রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিট ধরে আরও বেশ খানিকটা এগিয়ে চলুন। বাঁ দিকে নীরদবিহারী মল্লিক রোডে পূজামণ্ডপ। এই পুজোর এ বার ৭৬ বছর। রানি রাসমণির জানবাজারের বাড়ির নকশায় মণ্ডপ। ঢোকার মুখে সিংহ। সেই সিংহদুয়ার পেরিয়ে রাজপ্রাসাদে ঢুকতেই সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলিযুগের অবতারবৃন্দ। একচালার প্রতিমা, ডাকের সাজ।
আপাতত এই পরিক্রমা এখানেই শেষ।