আজ বাদে কাল বোধনের ঢাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে কাঠি পড়বে। কিন্তু কলকাতা ও শহরতলিতে মানুষের ঠাকুর দেখার ঢাকে কাঠি পড়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। বেশির ভাগ নামকরা পুজোরই উদ্বোধন হয়ে গিয়েছে। ‘তিতলি’ও চলে গিয়েছে। রাস্তায় নিশ্চিন্তে বেরিয়ে পড়েছেন মানুষজন। মহালয়ার পর থেকেই ফি সন্ধ্যায় মহানগরের রাস্তায় হচ্ছে জ্যাম। তাই ভ্রমণ অনলাইনও বেরিয়ে পড়ল, পুজো পরিক্রমা সারতে। কলকাতা শহরকে কী ভাবে ভাগ করবেন, কী ভাবে শুরু করবেন ঠাকুর দেখা, কোন কোন ঠাকুর দেখবেন – এ সবেরই সুলুকসন্ধান।
আজ রবিবার পঞ্চমী। শুরু করা যাক পূর্ব কলকাতা দিয়ে। প্রথমেই যাওয়া যেতে পারে ভিআইপি রোড অঞ্চলে। সেখান থেকে ঘুরে ঢুকে পড়ুন সল্টলেকে। তার পর বেলেঘাটা, কাঁকুড়গাছি হয়ে উলটোডাঙা।
ভিআইপি রোড অঞ্চল
দমদম পার্ক তরুণ দল
এই পুজোয় থিমের নাম ‘আবাহন’। আসলে শৈশব ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন। মণ্ডপে ঢুকেই মনে হবে শিশুমুখ খোদাই করা অসংখ্য সূর্যমুখী ফুল আকাশ থেকে গড়িয়ে আসছে। প্রতিমার সামনে স্বর্গীয় দৃশ্য। এয়ারপোর্টের দিকে যেতে বাঁ দিকে দমদম পার্ক পোস্ট অফিসের কাছে।
দমদম পার্ক তরুণ সংঘ
শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ‘গণশা’দের কথা বলা হয়েছে এদের মণ্ডপে। মণ্ডপে ঢুকে একটা ছোটো গল্পের মতো যাত্রা শুরু হবে দর্শকদের। সেই গল্পের শেষে মিলবে মুক্তির স্বাদ। যে ‘গণশা’দের কথা এখানে বলা হচ্ছে তাদের জন্য মা-ও কাতর। তাই তাঁর সাজ সাদামাটা। দমদম পার্ক ট্যাঙ্ক নম্বর ৩–এর কাছে।
দমদম পার্ক ভারতচক্র
মেয়েরা ‘ঘরে ও বাইরে’ কেমন করে এগিয়ে চলেছেন, পুজোমণ্ডপে সে কথাই বলছে এরা। সর্বত্রই মেয়েদের উড়ান। মূল মণ্ডপ শিবলিঙ্গের আদলে। দমদম পার্ক ট্যাঙ্ক নম্বর ২–এর কাছে।
দমদম পার্ক যুবকবৃন্দ
এদের থিমও নারীকেন্দ্রিক – ‘মা গো তোমায় রাখব কেমন করে’। নারীর অবস্থার কথা সাপ-সিঁড়ির রূপকে বলা হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে সাফল্য যেমন আসে, তেমনই নারীর জীবনে সাপের দংশনও সমানে চলে। দমদম পার্ক ট্যাঙ্ক নম্বর ৪–এর কাছে।
লেকটাউন অধিবাসীবৃন্দ
৫৬ বছরে এদের থিম ‘কৃষ্টির পরম্পরা’। গ্রামবাংলার শিল্পের ধারাকে একটা কোলাজের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মণ্ডপে। পুজো প্রাঙ্গণে ঢোকার মুখে ডোকরা শিল্পের নিদর্শন, হস্তীমুখী ষাঁড়। ঘুঘুমারির শীতলপাটি, নতুন গ্রামের কাঠের পুতুল, চড়িদার মুখোশ, পাঁচমুড়ার টেরাকোটা, পিংলার পটচিত্র – কী নেই মণ্ডপে। কোচবিহারের মদনমোহন ঠাকুরবাড়ির চত্বরে ভবানীদেবীর আদলে প্রতিমা। জয়া সিনেমা হলের কাছে মণ্ডপ।
লেকটাউন নেতাজি স্পোর্টিং
৩৯ বছরে থিম ‘বাংলার নাটক-কথা’। বাংলার নাটকের এ-কাল সে-কাল দুর্গাপুজোর আবহে বলতে চাওয়া হয়েছে। মণ্ডপে ঢুকেই দর্শকরা যাত্রাপথের মধ্য দিয়ে যাবেন। সেই পথে নাটকের ইতিহাস সম্পর্কে নানা তথ্য। শেষে প্রতিমা দেখে মনে হবে দুর্গা যেন নাটকেরই এক চরিত্র। যশোর রোডের দিকে লেকটাউন এ ব্লকের কাছে।
নতুন পল্লি প্রদীপ সংঘ
৩৮তম বছরে থিম ‘সাজিয়ে নিয়ে অতীত গাথা, আসল ফিরে বিবাহ কথা’। এ দেশে বিবাহ একটা সুপ্রাচীন রীতি। কিন্তু এই পবিত্র বন্ধন নারী নির্যাতন, বধূহত্যার মতো অনাচার থেকে মুক্তি দিতে পারেনি নারীকে। অশুভ শক্তির বিনাশ শেষে প্রতিমা অষ্টমঙ্গলার সাজে। বাসস্টপ নতুনপল্লি। এস কে দেব রোডের ওপর পুজো।

শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাব
মহালয়ার কয়েক দিন আগেই পুজো উদ্বোধন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে এরা। এদের এ বারের থিম ‘পদ্মাবত’। মণ্ডপের সামনে রয়েছে ঘোড়া। আছে ফরিদাবাদের ঝাড়বাতি। প্রতিমার সাজেও রয়েছে চমক। বহুমূল্য হিরের গয়নায় সজ্জিতা শ্রীভূমির দুর্গাপ্রতিমা। ভিআইপি রোডে শ্রীভূমি বাসস্টপ।
সল্টলেক
ভিআইপি রোড ধরে ঠাকুর দেখে এসে এ বার ঢুকে পড়ুন সল্ট লেকে।
লাবণি আবাসন
৪৪তম বর্ষে লাবণি আবাসনের থিম ‘ভিন্ন গ্রহে, প্রাণের সন্ধানে’। দর্শকদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মহাকাশের অনন্ত সম্ভারের মাঝে। থিম অনুসারে মণ্ডপের পরিকল্পনা ও আলোর ব্যবহার। প্রতিমা সাবেকি।
বিজে ব্লক
৩৫তম বর্ষের পুজোয় তুলে আনা হয়েছে চিনের ইউনান প্রদেশের জনজাতিদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা। ওই অঞ্চলের একটি দল উৎসবের চার দিন অনুষ্ঠান পরিবেশন করবে পুজো প্রাঙ্গণে। প্রতিমায় থাকছে থিমের মিশেল।
একে ব্লক
৩১তম বর্ষের থিম ‘সল্টলেকে সীতাহরণ’। দেখানো হয়েছে শুভ ও অশুভের দ্বন্দ্ব এবং সেখান থেকে শুভ শক্তির জয়। মণ্ডপের প্রবেশপথে রয়েছে ৫৫ ফুট উঁচু রাবণের মডেল।
এই (পার্ট ওয়ান)
৩৫তম বর্ষে এরা বলছে দু’টি হাতের গল্প। এক হাত দিয়ে সৃষ্টি, অন্য হাত দিয়ে তৈরি হচ্ছে ধ্বংসের অস্ত্র। কয়েক হাজার হাতের মডেল দিয়ে সেজে উঠেছে মণ্ডপ। প্রতিমার অলংকরণেও সেই চিন্তার প্রতিফলন।

এফডি ব্লক
মানুষকে, বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের আনন্দ দিতে পার্কের মধ্যেই তৈরি হয়েছে আরও একটি পার্ক। সেখানে রয়েছে প্রায় ২৫ রকমের ডাইনোসর। ৩৪তম বর্ষের পুজোয় থিমের নাম, ‘ডাইনোসর পার্ক-এফডি পারক’। প্রতিমা সাবেক।
বেলেঘাটা
সল্টলেক থেকে বেরিয়ে পড়ে ঢুকে পড়ুন বেলেঘাটায়।
বেলেঘাটা সরকার বাজার
৭০তম বছরে এদের পুজোর শিরোনাম ‘রং-বেরঙের বেণুর সাজে, দুর্গা এ বার মোদের মাঝে’। বিষয়বস্তুর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে আলোকসজ্জা। ডেঙ্গি-সচেতনতা তৈরি করতে বার্তা দেওয়া হয়েছে মণ্ডপে। বেলেঘাটা সিআইটি মোড়ে এসে চলুন হেমচন্দ্র নস্কর রোডের এই মণ্ডপে।
বেলেঘাটা ৩৩ পল্লি
এ বার চলুন ৩৩ পল্লির ঠাকুর দেখতে। জ্যামিতির উপকরণ দিয়ে তৈরি হয়েছে মণ্ডপ। বয়সে নবীন এই পুজোর এ বারের থিম, ‘ঈশান কোণে ঈশানী’। দেবী দুর্গার অবস্থান ঈশান কোণে। সেখান থেকে এই ভাবনা। সাবেক প্রতিমায় তামার গয়না। ফুলবাগানের মোড় পেরিয়ে ডান দিকে পুজোমণ্ডপ।
কাঁকুড়গাছি
বেলেঘাটার ঠাকুর দেখে চলে আসুন কাঁকুড়গাছিতে।
কাঁকুড়গাছি যুবকবৃন্দ
৮৮তম বছরে এখানে তুলে আনা হয়েছে ওড়িশার রঘুরাজপুরের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি। সেখানকার চিত্রকলাতেই সেজে উঠেছে মণ্ডপ। গ্রামের শিল্পীরা মণ্ডপে বসে ছবি আঁকছেন। প্রতিমায় রয়েছে মেহগনি কাঠের কাজ। সঙ্গে মানানসই গয়না। কাঁকুড়গাছি মোড়ের আগে বাঁ দিকের রাস্তায় মণ্ডপ।
স্বপ্নার বাগান
সাবেক ও থিমের সহাবস্থানের বার্তা রয়েছে স্বপ্নার বাগানে। মণ্ডপের দু’টি ভাগ। প্রথমটি থিমের – সাজানো হয়েছে বাতিল প্লাস্টিক বোতল, থার্মোকল, টিন দিয়ে। এর পরে দর্শকরা ঢুকবেন সাবেক মণ্ডপে। আয়নায় আছে দু’ ধরনের প্রতিমা। সাবেক না থিম, কোনটা পছন্দ – ভোটেরও ব্যবস্থা আছে। কাঁকুড়গাছি মোড় থেকে বাইপাসের দিকে, মানিকতলা মেন রোডে।
কাঁকুড়গাছি মিতালি
পুজো মানেই আনন্দ। সেই আনন্দে মাতোয়ারা করার ব্যবস্থা মিতালির পুজোয়। ছেলেবেলায় ফিরে যাচ্ছেন দর্শকরা। ১৩ ফুট উঁচু প্রতিমার সবার নজর কাড়ছে। কাঁকুড়গাছি মোড় থেকে বাইপাসের দিকে, ঘোষবাগান বাজারের কাছে এই পুজো।
উলটোডাঙা
কাঁকুড়গাছি থেকে চলে আসুন উলটোডাঙায়। স্টেশন ছাড়িয়ে এগিয়ে চলুন অরবিন্দ সেতুর দিকে।
তেলেঙ্গাবাগান
কিছুটা এগিয়ে প্রথমেই ডান দিকে পড়বে তেলেঙ্গাবাগান। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের লক্ষ্য ছিল ধর্মের দীনতা মলিনতা ঘুচিয়ে একটি সুন্দর দেশ হিসাবে ভারতবর্ষকে গড়ে তোলা। কিন্তু কোথায় স্বপ্নের ভারতবর্ষ। চারি দিকে শুধু স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। তবু উৎসব নিয়ে আসে আশার আলো। নতুন আশ্বাস। বাঙালির শ্রেষ্ঠোৎসব দুর্গাপুজো। সেই পুজোকে কেন্দ্র করে তাই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ওই স্বপ্নকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সেই ‘আলোর পথযাত্রী’দের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয়েছে তেলেঙ্গাবাগান সর্বজনীনে।

উলটোডাঙা পল্লিশ্রী
অরবিন্দ সেতুর দিকে আর একটু এগিয়ে ডান দিকে পল্লিশ্রীর মণ্ডপ। ৭০তম বর্ষে উলটোডাঙা পল্লশ্রীর নিবেদন ‘অন্তহীন প্রাণ’। এই বিষয়কে মণ্ডপে ফুটিয়ে তুলতেই শিল্পী আশ্রয় নিয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ আর জগন্নাথের। মণ্ডপের ভেতরে বিভিন্ন ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই বিষয়। সেখানে মাতৃশক্তি অর্থাৎ নারীশক্তিকে প্রাণের ধারকশক্তি হিসাবে দেখানো হয়েছে।

করবাগান সর্বজনীন
অরবিন্দ সেতুর দিকে আরও এগিয়ে করবাগানের পুজো, পল্লিশ্রীর কাছেই। ‘বাঁধনে বাঁধা’ ৭১তম বর্ষে করবাগান সর্বজনীন। থিমের মূল বিষয় শিক্ষার বাঁধন। জীবনে যা কিছুই করতে চাও তার সবই নির্ভর করে শিক্ষাগত যোগ্যতার ওপর। তার ওপর নির্ভর করে কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতিও। সেই শিক্ষার বাঁধনে আটকে থাকে সবই। থিমের সঙ্গে মানানসই আলো।
উলটোডাঙা যুববৃন্দ
করবাগানের কাছেই উলটোডাঙা যুববৃন্দের পূজামণ্ডপ। বাংলার তাঁতশিল্পকে থিম হিসাবে বেছে নিয়েছে সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে যাওয়া এই পুজো। মণ্ডপসজ্জায় থাকছে তাঁতের কাপড়ের কারুকাজ। প্রতিমার গয়নাতেও রয়েছে তাঁতের ব্যবহার। মায়ের আঁচলে রয়েছেন তাঁর সন্তানেরা।
গৌরীবেড়িয়া সর্বজনীন
অরবিন্দ সেতু পেরিয়ে আসুন। সেতুর গা ঘেঁসে ডান দিকের রাস্তায় পূজামণ্ডপ। এ বারের থিম ‘স্মৃতির রঙ্গমঞ্চ’। কেমন ছিল কলকাতার ‘থিয়েটার-পাড়া’, সেটাই ফিরে দেখবে ৮৫ বছরে পা দেওয়া এই পুজো। মণ্ডপ সেজেছে স্টেজের আদলে। নাটকে ব্যবহৃত আলো, আবহ – সব কিছুর সঙ্গে পরিচয় করানো হচ্ছে দর্শকদের। প্রতিমার অধিষ্ঠান ‘কমা’র মাধ্যমে।
লালাবাগান নবাঙ্কুর
ঢুকে পড়ুন রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে, শ্যামবাজারের দিকে নয়, মানিকতলার দিকে। দীনেন্দ্র স্ট্রিটে ঢুকে ডান দিকের রাস্তায় নবাঙ্কুরের মণ্ডপ। ৫৯তম বর্ষে এই পুজোর স্লোগান ‘উপকারী প্লাস্টিক থাকুক, বাদ যাক অপ্রয়োজনীয় প্লাস্টিক’। প্লাস্টিক দূষণ রুখতে এ ভাবেই সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে মানুষের কাছে। মণ্ডপসজ্জায় পিংলার পটচিত্র।
সম্মিলিত লালাবাগান
কাছেই লালাবাগান ময়দানে পুজোমণ্ডপ। বোধন থেকে বিসর্জন, পাঁচ দিনের এই দুর্গা আরাধনার অন্যতম অঙ্গ হল দর্পণ। ৭০তম বর্ষে তাই এই পুজোর থিম ‘দর্পণে অর্পণ’। বিভিন্ন আকারের আয়না ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে ছোটো শিসমহল। সেই শিসমহল পেরিয়ে দর্শকরা ঢুকবেন মণ্ডপে। সনাতন প্রতিমার আকর্ষণ রুপোর গয়না।
হালসিবাগান সর্বজনীন
রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিট ধরে আরও বেশ খানিকটা এগিয়ে চলুন। বাঁ দিকে নীরদবিহারী মল্লিক রোডে পূজামণ্ডপ। ৭৪ বছরে এদের নিবেদন ‘ফোক লোক’। দর্শকরা মুখোমুখি হচ্ছেন আফ্রিকার জনজাতি সংস্কৃতির। তার সঙ্গে জুড়ে আছে বাংলার লোকসংস্কৃতিও।
আজকের মতো পরিক্রমা এখানেই শেষ করুন।