দ্য গ্রেট গোয়া ৮ / বিদায় কোলভা, বিদায় গোয়া

কোলভায় দিনের শেষে।
স্বপ্ন পাল

গোয়া ভ্রমণ আক্ষরিক অর্থেই শেষ। আজ শুধুই বিশ্রাম। তবে বিশ্রাম মানে যে ঘরে বসে কাটানো সেটাও নয়। সকালে উঠেই চা খেতে খেতে সবাই মিলে বিচে চলে এলাম। বিচে আজ লোকসমাগম অন্য দিনের থেকে একটু বেশি। আজ আমরা পেতে বসার জন্য একটা বড়ো প্লাস্টিকের শিট নিয়ে এসেছি। একটা পছন্দসই জায়গা দেখে সেটা পেতেও ফেলা হল। সবাই বসল। আমি আর সৈকত বেনোলিম বিচের দিকে হাঁটা শুরু করলাম।

এক জায়গায় সমুদ্রের ধারে জেলেদের জালের কাছে একটা ইয়া বড়ো কাঁকড়া দেখি মর্নিং ওয়াক করছে। সেটাকে হাত দিয়ে ধরার জন্য যেই হাতটা বাড়িয়েছি ওমনি কাঁকড়ামশাই যুদ্ধ ঘোষণা করল। দাঁড়া উঁচিয়ে তেড়ে এল, ভয়ে সরে গেলাম।

দু’জনে আবার এগিয়ে চললাম। পায়ের তলায় লক্ষ লক্ষ ঝিনুক পড়ে আছে। চলতে চলতে আবার থামতে হল। হলুদ রঙের ওপর কালো আলপনা আঁকা সামুদ্রিক সাপ বালিতে পড়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে।  কিছুটা দূরে পড়ে থাকা একটা নারকেল পাতার ডাঁটির উপর চোখ পড়ল। দৌড়ে গিয়ে ওটা নিয়ে এলাম। হাতে সময় বড়োই কম। যে কোনো মুহূর্তে নিভে যেতে পারে তার জীবনদীপ। লাঠিটা দিয়ে মৃতপ্রায় সাপটাকে জলে ছেড়ে দিলাম। দাঁড়িয়ে দেখলাম সাপটা সাঁতার কাটতে পারছে।

পথে আরও একটা সামুদ্রিক সাপ আর একটা মৃতপ্রায় স্কুইডো পেলাম। তাদেরও সমুদ্রে ছাড়লাম। এই সব সামুদ্রিক প্রাণী জেলেদের জালে ধরা পড়ে। জেলেরা তীরে এসে তাদের বালিতে ছুড়ে ফেলে দেয়, কারণ এগুলো মানুষের কোনো কাজে লাগে না। এই নিরপরাধ প্রাণীগুলোকে কি বালিতে না ফেলে জলে ছুড়ে দেওয়া যায় না? তাতে তো তারা প্রাণে বাঁচে।

বেনোলিম বিচ।

হাঁটতে হাঁটতে দু’জনে এক সময় বেনোলিম বিচে চলে এলাম। এ পর্যন্ত আসাই ছিল আমাদের লক্ষ্য। ফেরার পথে দেখা হল এক অপুর্ব সুন্দর মাঝারি মাপের কাঁকড়ার সঙ্গে। সারা শরীরে উজ্জ্বল লাল, সাদা, বাদামি আর হলুদ রঙের বাহার। জানি না এই কর্কট প্রজাতির নাম কী। দেখে মনে হয় এই প্রজাতির কাঁকড়ার নাম হওয়া উচিত অর্নামেন্টাল ক্র্যাব। কাঁকড়াটাকে ধরে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে আবার জলে ছেড়ে দিলাম। তাকে ধরার জন্য কাঁকড়াটা অপমানিত হয়ে আমায় গালমন্দ করল কি না কে জানে। সে আমার দিকে একবার দাঁড়া উঁচিয়ে ভালো করে দেখে নিয়ে আবার হাঁটা লাগাল। আমরাও সামনের দিকে হাঁটা দিলাম।

হোটেলে ফিরে একবারে প্রাতরাশ-পর্ব সারা হল। এ বার সবাইকে জানিয়ে দিলাম, গোয়াতে যে যে কেনাকাটা করতে চাও তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ো। সুলতা ঘরেই রইল। আমরা বেরিয়ে পড়লাম। এক ঘণ্টা ধরে চলল কেনাকাটা-পর্ব। পাতলা গোল গলা টি-শার্ট আমরা সবাই কিনলাম। ওটা গরমে পরে যেমন আরাম পাওয়া যাবে তেমনই গোয়ার একটা স্মৃতিও হবে। এ ছাড়াও কাজু, ওখানকার প্যাকেট করা মিষ্টি প্রভৃতিও কেনা হল।

কোলভা সৈকতে জলক্রীড়ার ব্যবস্থা।

বেলা প্রায় ১১টা বেজে গেছে। সমুদ্রস্নানে বেরিয়ে পড়েছি। গোয়ার সব বিচেই স্নান করা, বোট চলাচল এবং ওয়াটার স্পোর্টস-এর জন্য আলাদা আলাদা জায়গা নির্দিষ্ট করা আছে পতাকা পুঁতে। এরিয়া দেখভাল করার দায়িত্বে লাইফগার্ডরা।

পালোলেম বিচের মতো এখানেও তেমন ঢেউ নেই। যেটুকু ঢেউ আছে তাতে সমুদ্রস্নানের মজা নেই। লাইফগার্ডরা বেশি দূরে যেতেও দেয় না। তারই মধ্যে এগিয়ে-পিছিয়ে নানা রকম পরীক্ষানিরীক্ষা করে বুঝলাম পাড়ের কাছে জলের মধ্যে বসে থাকলেই সব চেয়ে বেশি মজা পাওয়া যাবে। কোলভা বিচ প্রায় আড়াই কিমি লম্বা, সাদা বালির বিচ।

স্নান করার জায়গার পাশেই ওয়াটার স্পোর্টস-এর জায়গা। সেখান থেকে প্যারাসেলিং করা হচ্ছে। খদ্দেরের অভাব নেই। একজনকে ঘুরিয়ে এনে নামাচ্ছে তো আর একজনকে নিয়ে যাচ্ছে। খুব বেশি হলে পাঁচ মিনিটের অ্যাডভেঞ্চার, খরচ ১৫০০ টাকা! কোলভা বিচে এর বিপুলই চাহিদা।

ইতিমধ্যে আমাদের দলের বাকিরাও হাজির হয়েছে এবং জলে নেমে পড়েছে। সবাই মিলে পাড়ের কাছে জলের মধ্যে বসে পড়েছি, ভেঙে যাওয়া ঢেউ গায়ের উপর দিয়ে যাচ্ছে। বসে বসে গুলতানি করছি। এ যেন এক অভিনব আড্ডা মারার জায়গা।

সমুদ্র থেকে ফিরে সোজা হোটেলের সুইমিং পুলে নেমে পড়লাম। বহু দিনের অনভ্যাসের ফলে সকলেরই সাঁতার কাটতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল। শরীর যেন ভারী হয়ে গেছে, দমের এর ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। এসব প্রতিকুলতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে সবাই হঠাৎ পাওয়া পুরোনো মুহূর্তকে মুহুর্তকে উপভোগে ব্যস্ত।

আওয়ার লেডি অফ মার্সেস চার্চ।

দুপরে খাওয়াদাওয়ার পর এক প্রস্ত ঘুম। ঘুম যখন ভাঙল তখন গোধূলি। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। সমুদ্রে সুর্যাস্তটা দেখার ইচ্ছা ছিল, সেটা আর হল না। কী আর করা যাবে। ক’দিন ধরে যা পরিশ্রম হচ্ছে তাতে শরীরকে আর দোষ দিয়ে লাভ নেই। সুর্যাস্ত যখন দেখাই হল না তখন চার্চের সামনের মেলা থেকেই একটু ঘুরে আসার পরিকল্পনা করলাম।

বিচ থেকে চার্চের দূরত্ব প্রায় দেড় কিমি। দু’টো অটো করে চার্চের কাছে এলাম। চার্চেরই কোনো উৎসবকে কেন্দ্র করে এই মেলা। পোশাক-পরিচ্ছদ, সাজের দ্রব্য, গেরস্থালির দ্রব্য, খেলনা, খাবার প্রভৃতির স্টল। কোলভায় যাঁরা যান তাঁদের অনেকেই এই চার্চকে ভ্রমণ-তালিকায় রাখেন না। এই চার্চটির আসল নাম, আওয়ার লেডি অফ মার্সেস চার্চ। ১৬৩০ সালে ইগ্রেজা ডে নসসা সেনহরা দাস মার্সেস নামে এক পর্তুগিজ এই চার্চটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ১৮ শতকে চার্চটি নবনির্মিত হয়।

হেঁটে হোটেলে ফেরার প্রস্তাব দিলাম, সবাই রাজি হয়ে গেল। অতএব পায়ে পায়ে হোটেলের পথ ধরলাম। হাঁটতে হাঁটতে কোলভা সম্পর্কে দু-চার কথা বলে নিই। পর্তুগিজরা ১৫১০ সালে গোয়ায় যখন আসে তখন কোলভা ছিল মৎস্যজীবীদের একটি গ্রাম। তখন থেকেই কোলভা পর্তুগিজরাদের দখলে চলে যায় এবং ১৯৬১ সালে পর্তুগিজরা গোয়া ত্যাগ করার আগে পর্যন্ত তাদের দখলেই ছিল। বাংলার জমিদারি প্রথার মতো প্রথা ওখানেও তখন ছিল। একদম প্রথমে এই গ্রাম ছিল ডি ডিওগো রডরিগসের অধীনে।

কোলভা সৈকতে নারকেল গাছের সারি।

আঠারো শতকে রডরিগসের এক উত্তরসূরি সেবাস্টিও জোস রয়েজ কোলভার প্রজাদের সমুদ্রের ধার বরাবর বিচের সাদা বালিতে নারকেল গাছ বসানোর পরামর্শ দেন। তখন সেখানকার মানুষ তার এই পরামর্শকে তেমন পাত্তা দেয়নি। তারা মনে করেছিল এটা অহেতুক পরিশ্রম। রয়েজের দূরদৃষ্টি কতটা ছিল তা আজ আমরা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। সমগ্র গোয়া জুড়ে আজ শুধু নারকেলের চাষ।

গোয়া ভারতের অংশ হওয়ার আগে পর্যন্ত কোলভা রয়েজ পরিবারের সম্পত্তি ছিল। কোলভার অধিকাংশ অংশ ১৯৭৪ সালে ভারত সরকারের হাতে তুলে দিতে হয় রয়েজ পরিবারকে এবং বাকি অংশ তারা পরে বিক্রি করে দেয়। গল্প করতে করতে এক সময় পৌঁছে গেলাম হোটেলে।

সকালে উঠে প্রাতরাশ করে জিনিসপত্র নামিয়ে এনেছি। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সাড়ে ৮টায় ট্রেন। আসিফও গাড়ি নিয়ে এসেছে, তবে আমাদের জন্য নয়, সে আজ অন্য ট্যুরিস্টদের নিয়ে নর্থ গোয়া যাবে। গাড়ি থেকে নেমে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বিদায় জানাল। পিন্টু, চন্দ্রশেখরদা, রাধেদা সব কাজ ফেলে আমাদের বিদায় জানাতে এসেছে। ওরাই গাড়িতে জিনিষপত্র তুলে দিল। এদের সঙ্গে কয়েক দিনেই এমন মিশে গেছিলাম যে এখন মনটা খারাপ লাগছে।

গাড়ি ছেড়ে দিল। প্রতি দিনের মতো আজও আমি সৈকতের দেওয়া কালো টুপি পরে গাড়ির সামনে বসেছি। বাঁ দিকের লুকিং গ্লাসে দেখলাম তিনজনে আমাদের দিকে বিষণ্ণ মুখে তাকিয়ে আছে। মুখটা বাইরে বার করতে যাব এমন সময় গাড়িটা বাঁ দিকে বাঁক নিল এবং সাথে সাথে মানুষগুলোও চোখের আড়ালে চলে গেল। হয়তো আর কখনো দেখা হবে না এঁদের সঙ্গে। (শেষ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *