
লেখার আগে একটু ভূমিকা। অনেক দিন পরে আবার লিখতে বসেছি। উদ্দেশ্য একটি ভ্রমণবৃত্তান্ত লেখার। কিন্তু লিখতে গিয়ে মুশকিলে পড়লাম। মুশকিল হল এ বারের দ্রষ্টব্য হল ইতিহাস। তাই যা দেখেছি তার একটু ইতিহাস না দিলে লেখাটাই হয় না। অতএব ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখা। কিন্তু ইন্টারনেটে যা আছে তার পুরোটা লিখতে গেলে একটা মহাভারত লেখা হয় যাবে। তাই সেই অতীতকে ক্ষুদ্র আকার দেওয়ার চেষ্টা শুরু হল। জানি যে এই লেখায় ভ্রমণ কম, ইতিহাস বেশি। এত ইতিহাস পাঠকের মনে বিরক্তি জাগাতে পারে। তাই যতটা সম্ভব ইতিহাসকে ছোটো করার চেষ্টা করলাম।
ষোলোই ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার, রাত সাড়ে দশটা। শিয়ালদহ। আমাকে নিয়ে এক ডজন সহযাত্রী নয়-এর বি প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে গিয়েছে। নতুন পরিচয়। তাই শুরু হল আলাপচারিতা। শিয়ালদহ স্টেশন মুখরিত হয়ে উঠল আমাদের ডজন খানেক মানুষের আলাপচারিতায়। যথাসময়ে এল পদাতিক এক্সপ্রেস।
আরও পড়ুন জঙ্গলের ডাকে ঝাড়গ্রামে
ট্রেনে একেবারেই ঘুম আসে না। খুব ভোরে সবাইকে ডেকে তুললাম। মালদহ যখন নামলাম তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। রাতের ঘন অন্ধকার একটু ফিকে। স্টেশনের বাইরে চা। গাড়ি যখন এল আলো ফুটে গিয়েছে। রথবাড়িতে সরকারি হোটেল। চেক ইন করেই বেরিয়ে পড়লাম। ফোর্সের ক্রুজার গাড়ি। বারো জনের স্থান হল অনায়াসে।
রাস্তায় সামান্য ব্রেকফাস্ট। গুড়ের রসগোল্লা দারুন। আমরা এগিয়ে গেলাম গৌড়ের দিকে।

আমাদের কাছে একটা লিস্ট করা আছে, যেটা মিলিয়ে মিলিয়ে আমরা দেখব। যদিও প্রথমেই রামকেলি বাদ হয়ে গেল। আমরা রামকেলি থেকে আরও আধ কিলোমিটার দূরে বড়ো সোনা মসজিদে পৌঁছে গেলাম। রামকেলি বাদ হয়ে গেল বটে তবু জায়গাটা নিয়ে দু-চার কথা বলে রাখি।
রামকেলিতে আছে শ্রীচৈতন্যদেবের পায়ের চিহ্ন। শ্রীচৈতন্যদেবের মূর্তির ঠিক পেছনে মন্দির। সেখানেই এক বেদির উপর তাঁর পায়ের ছাপ। গৌড়ের সুলতান ছিলেন হুসেন শাহ। তাঁর মন্ত্রী ছিলেন রূপ আর সনাতন। দু’জনেই হিন্দু। হোসেন শাহ এই দু’জনের কাজে খুশি হয়ে এই রামকেলি গ্রামে জমি দিয়েছিলেন। হুসেন শাহ এই দু’জনকে উপাধিও দিয়েছিলেন। রূপের উপাধি হল দবির খাস, আর সনাতনের উপাধি সাকোর মল্লিক।
আরও পড়ুন ডাক দিয়ে যায় সুবর্ণরেখা
পরে শ্রীচৈতন্য নীলাচল থেকে হেঁটে পৌঁছোন রামকেলি। তার পর রূপ আর সনাতন দু’জনেই বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন। তখন তাঁদের নাম হয় রূপ গোস্বামী আর সনাতন গোস্বামী। এই দু’জনেই বৈষ্ণবধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এঁরা একটি বৈষ্ণব মেলারও প্রবর্তন করেন। মেলায় জমজমাট হয়ে ওঠে রামকেলি।
সেই রামকেলি ফেলে রেখে চলে এসেছি বড়ো সোনা মসজিদ।
গৌড়ের সব ক’টি সৌধ পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে। গৌড়ের রূপকার ছিলেন সম্রাট হোসেন শাহ। সময়টা ছিল পনেরো শো ছাব্বিশ। ঠিক ওই বছরেই পানিপথের যুদ্ধ হয় বাবর আর ইব্রাহিম লোদীর মধ্যে। ভারতবর্ষে শুরু হয় মুঘল সাম্রাজ্য। ইতিহাস বলে তখন এই গৌড়ই ছিল বাংলার রাজধানী। আমরা যেখানে উঠেছি, মালদার ইংলিশবাজারের অন্তর্গত সেই রথবাড়ি থেকে গৌড় প্রায় চোদ্দো কিলোমিটার। কাছেই বাংলাদেশ বর্ডার।

আমরা এসেছি বড়ো সোনা মসজিদে। আদিনা মসজিদের সঙ্গে তুলনা করছি না। কিন্তু আদিনা গৌড়ে নয়, পাণ্ডুয়ায়। তাই বলা যেতেই পারে এটাই গৌড়ের সব চেয়ে বড়ো আকারের সৌধ। ছোটো সোনা মসজিদ বলে যেটা ছিল সেটা এখন চলে গিয়েছে বাংলাদেশে। জিলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ওটা ছোটো ছিল বলেই এর নাম হল বড়ো। এখন প্রশ্ন হল, সোনা মসজিদ কেন? শোনা যায়, এর ছাদ নাকি সোনালি রঙের ছিল। প্রধানত গম্বুজগুলো ছিল সোনালি। তাই নাম হল সোনা মসজিদ। এর আরও একটা নাম হল বারোদুয়ারি। কিন্তু অনেক খুঁজেও এগারোটাই দরজা পেলাম। তাই বারোদুয়ারি নাম নিয়ে মাথা চুলকেও কোনো কুলকিনারা পেলাম না। আগে কি তা হলে আরও একটা দরজা ছিল?
বাইরে থেকে দেখতে কালো পাথরের তৈরি। কিন্তু নীচের থেকে লিনটন অবধি পাথর হলেও ওপরের দিকটা টেরাকোটার এক ইঞ্চি ইটের গাঁথনি। বিষ্ণুপুর বা মল্ল রাজাদের দেশে পুরোটাই ছিল টেরাকোটা, যেখানে বলা যেতে পারে সবটাই হিন্দু স্থাপত্য। এখানে কিন্তু দেখলাম হিন্দু আর মুসলিম স্থাপত্যের মিশেল। মন্দির ধ্বংস করে তার মালমশলা দিয়েই তৈরি হয়েছে এই সব মসজিদ। তাই মিশেল হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
এক দিকের ছাদ থাকলেও, অন্য দিকের ছাদটা আর নেই। চুয়াল্লিশটা গম্বুজের এগারোটি মাত্র রয়ে গিয়েছে। একটু উঁচু জায়গার উপর এই স্থাপত্য। দেখলেই বোঝা যায় যে বেশ যত্ন নেওয়া হয় চারিদিকের। শোনা যায় এই জায়গাটা লর্ড কার্জন রিপেয়ার করিয়ে ছিলেন তাই আজও দাঁড়িয়ে আছে। নীচে অনেক চৌকো স্তম্ভের মতো মাটিতে সারি দিয়ে রয়েছে। মনে হয় সেগুলো কবর। সেটা যদিও শুধুই ধারণা। ধারণাটা বদ্ধমূল হয়েছিল আদিনা মসজিদে গিয়ে।

সুলতান হোসেন শাহ বড়ো সোনা মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু করলেও শেষ করতে পারেননি। তাঁর ছেলে সুলতান নসরত শাহ শেষ করেন এর নির্মাণ। পাথরের দেয়ালগুলোয় হাত দিলাম। সেই কোন কবে কার হাত পড়েছিল এই দেয়ালগুলোয়। আজও ছুঁয়ে দেখতে পাচ্ছি। লোকগুলো নেই, তাঁদের কাজ, তাঁদের কীর্তিগুলো রয়ে গেছে। মনে মনে তাঁদের কুর্নিশ না জানিয়ে পারলাম না।
সময় সীমিত, তাই এগিয়ে যেতেই হবে। পাইলটকে জিজ্ঞাসা করলাম, এর পর কোথায় যাব। বুঝলাম, সে চেনে সব, কিন্তু নাম জানে না কোনোটারই। কিন্তু আমি জানি পরের গন্তব্য দাখিল দরওয়াজা। (চলবে)
কী ভাবে যাবেন
ভারতের সব বড়ো শহরের সঙ্গেই মালদার ট্রেন যোগাযোগ আছে। কলকাতা থেকে মালদা যাওয়ার অজস্র ট্রেন। ছাড়ে হাওড়া, শিয়ালদহ আর কলকাতা স্টেশন থেকে। ট্রেনের সময়ের জন্য দেখে নিন erail.in ।
সংক্ষিপ্ততম সড়কপথে কলকাতা থেকে মালদার দূরত্ব ৩৬০ কিমি। এই পথ বর্ধমান, ভাতার, খড়গ্রাম, রমাকান্তপুর, ফারাক্কা হয়ে। নিজেরা গাড়ি নিয়ে গেলে এই পথে যেতে পারেন।
কলকাতা থেকে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে (পথ কৃষ্ণনগর, বহরমপুর, ফারাক্কা হয়ে) নিয়মিত বাস চলে মালদার।
কোথায় থাকবেন
পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের টুরিস্ট লজ রয়েছে মালদায়। অনলাইন বুকিং www.wbtdcl.com । এ ছাড়া মালদায় অনেক বেসররকারি হোটেল, রিসর্ট রয়েছে। গুগলে ‘accommodation in malda’ সার্চ করলে এদের সন্ধান পেয়ে যাবেন। পেয়ে যাবেন এদের সম্পর্কে রিভিউও।
ছবি: লেখক