
বাইশগজী দেওয়াল থেকে আমবাগানের মাঝখান দিয়ে বাঁ দিকে মাটির রাস্তা চলে গিয়েছে। বাঁ দিকে কিছু দূর হেঁটে যাওয়ার পর দেখলাম অস্পষ্ট এক বোর্ডে লেখা ‘বল্লালবাটি’। এটা যে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছে সেটা স্পষ্টই বোঝা যায়। কারণ আমরা উপর থেকে নীচের দিকে দেখছি। নাম শুনে বোঝা যাচ্ছে এটাই হয়তো সেনরাজ বল্লাল সেনের ভবন ছিল।
অন্যান্য জায়গায় কিন্তু নীল বোর্ডে ছোটো করে একটা ইতিহাস লেখা পেয়েছি। কিন্তু এখানে তেমন কিছুই নেই। পুরাতত্ববিদ বিমল বন্দোপাধ্যায় একটি মাটির ঢিবি খুঁড়ে বার করেন এই বল্লালবাটি। এটা আদৌ বল্লাল সেনের তৈরি কিনা সেটা নিয়ে বেশ বড়ো প্রশ্ন। তবে ইতিহাস অনুযায়ী ধরে নেওয়া হয়েছে যে এটি আসলে বল্লাল সেনই বানিয়েছিলেন আর সুলতান বারবক শাহ এটা সংস্করণ করেন বা প্রথম থেকে আবার করে তৈরি করেন।
আরও পড়ুন: ইতিহাসের দেশে ১ / এলাম বড়ো সোনা মসজিদে
সামনে দিয়েই বয়ে যেত গঙ্গা। ভেতরে বাগান ছিল, পুকুর ছিল। বাইশগজী পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছিল। প্রাসাদটি গোল ইঁটের স্তম্ভের উপর ছিল। বড়ো বড়ো গোল গোল ইটের স্তম্ভগুলো এখনও আছে। স্থানীয়রা বলল, ওই স্তম্ভের মাঝে যে বড়ো ফুটো, তার মধ্যে বসানো হত শাল কাঠের গুঁড়ি। তার উপর প্রাসাদ। প্রাসাদ আর নেই, স্তম্ভগুলো আছে।

আগে যেখান দিয়ে গঙ্গা ছিল, সেখানে ছিল একটা সৌধ। আজও সেটা জাহাজঘাটা নামে পরিচিত। এখন গঙ্গা সরে গিয়েছে তিরিশ কিলোমিটার দূরে।
এ বার যেখানে এলাম সেখানে আগেই একটু চা খেয়ে নিতেই হল। গলা শুকিয়ে কাঠ। এই জায়গাটিকে যাকে বলা যায় দ্রষ্টব্য-কমপ্লেক্স। অনেকগুলো দ্রষ্টব্য একই জায়গায়।
সামনেই শুধু দেওয়াল-বিশিষ্ট একটি বাড়ি। বাড়িটার ছাদ নেই। ভেঙে পড়ে গিয়েছে। ভেতরে একটাই সমাধিক্ষেত্র। ভেতরে একটু জঙ্গলের আভাস হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাব স্পষ্ট। হয়তো এই বাড়িটা ছিল বিশ্রামের জন্য। শাহ সুজা ছিলেন গৌড়ের সুবাদার। তাঁরই তৈরি এটা। তবে এর অস্তিত্ব বোধহয় আর বেশি দিন নেই।

পাশেই একটা গেট। ঢুকে বাঁ দিকে একটা মসজিদ। আর সোজাসুজি বাংলার টেরাকোটা মন্দিরের আদলে একটা ঘর। অনেকটা কুঁড়েঘরের মতো। পরিষ্কার করে রঙ করা। জানলাম এটা ফতে খাঁর সমাধি।
সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র সুজা ছিলেন বাংলার সুবেদার। খবর পেলেন পিতাকে বন্দি করে ভাই আওরঙ্গজেব ভারতসম্রাট হয়েছেন। সুজা জ্বলে উঠলেন। ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছিলেন আওরঙ্গজেবকে আক্রমণ করবেন বলে। সুজা ছিলেন নিয়ামতুল্লার ভক্ত। নিয়ামত ছিলেন পীর। সব বিষয়েই সুজা তাঁর পরামর্শ নিতেন। এ দিকে আওরঙ্গজেবের কাছে খবর পৌঁছোল নিয়ামতের পরামর্শে সুজা তাঁকে আক্রমণ করবেন। সুতরাং হত্যা করতে হবে এই নিয়ামতকে। বাংলার রঙ্গমঞ্চে তাই প্রবেশ ঘটল দিলির খাঁ-এর। দিলির গৌড়ে এসে বসবাস শুরু করেন। সঙ্গে আছে তাঁর দুই ছেলে। কিন্তু তাঁর এক ছেলে গৌড়ে আসার পরেই মারা যায় রক্তবমি করে। সেই ছেলে ফতে খাঁ। ভয় পেলেন দিলির খাঁ। তাঁর মন বলল, যাঁকে হত্যা করতে এসেছেন তাঁর অসীম ক্ষমতা। তাঁর অভিশাপেই তিনি পুত্রহারা হলেন। শেষ পর্যন্ত দিলির খাঁ নিয়ামতের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ওই কুঁড়েঘরটিতে আছে সেই ফতে খাঁ-এর সমাধি। এক জনের প্রাণ গেল বলেই আরও এক জন প্রাণে বেঁচে গেলেন।
এরই উলটো দিকে কদম রসুল মসজিদ। কদম মানে পা আর রাসূলুল্লাহ মনে হজরত মহম্মদ। একটা পাথরের উপর পায়ের ছাপ আছে। লোকে বলে, পান্ডুয়ার জালালুদ্দিন তারবিজি নামে একজনের কাছে ছিল এই পায়ের ছাপ। সম্রাট হোসেন শাহ সেই পাথরটি এখানে নিয়ে আসেন। তাঁর ছেলে নুসরত এই মসজিদটি তৈরি করান। তিন দিকে তিনটি দরজা, তিনটিই বন্ধ।

বাইরে লোহার পাঁচিল দেওয়া। তার মধ্যে সুন্দর বাগান। বাগানের ওপর দিয়ে সোজা দৃষ্টি গেলে দেখা যায় একটা গেট। এরই নাম লুকোচুরি গেট। সুলতান হয়তো রানিদের সঙ্গে এখানে লুকোচুরি খেলতেন। এটাকে গৌড়ের প্রবেশপথ হিসাবেও মনে করা হয়। আসল নাম ছিল শাহি দরওয়াজা। দুই দিকে পাহারাদারদের জন্য ব্যবস্থা। হোমরাচোমরা কেউ এলে উপর থেকে পুষ্পবৃষ্টি করা হত, আর সানাই বাজানো হত।
লুকোচুরি গেটের ঠিক আগেই একটা মাটির রাস্তা ডান দিকে গিয়েছে। সেখান দিয়ে গিয়ে কার একটা বাড়ির মধ্যে দিয়ে গিয়ে পৌঁছোলাম আরও একটা মসজিদে। এটার নাম চিকা মসজিদ। এটি দেখতে মসজিদ হলেও এটা হয়তো জেল বা কারাগার ছিল। এই নিয়ে অবশ্য একটু ধন্দ আছে।
আরও পড়ুন: ইতিহাসের দেশে ২ / দাখিল দরওয়াজা, ফিরোজ মিনার, বাইশগজী দেওয়াল
ওপরে বিশাল গোলাকৃতি গম্বুজ। মনে হল বিড়লা প্ল্যানেটরিয়ামের থেকেও বড়ো। কিন্তু যেটা বলতেই হয় সেটা হল গম্বুজে কোনো ঢালাই বা লোহার স্ট্রাকচার ব্যবহার করা হয়নি। শুধু মাত্র ইঁট দিয়ে ওই গোলকটি তৈরি হয়েছে। সত্যি বিস্ময়কর! বছরের পর বছর দাঁড়িয়ে আছে ওই গম্বুজ। চার দিকে চারটি গেট আছে, সব ক’টিতেই লোহার জাল লাগানো হয়েছে। তিনটি কবর আছে ভেতরে। শুনলাম সেটি মাহমুদ শাহ ও তাঁর পরিবারের।

এখানে আসার আগে আমার ধারণা ছিল চিকা আর চামকাটি মসজিদ একই। কিন্তু তা তো নয়। চামকাটি মসজিদ আলাদা। কাছেই। তাই হেঁটেই যেতে হবে। মোটামুটি জানা যায়, এক ধরনের নীচ জাতির মুসলিম আছেন, যাঁরা বিভিন্ন মুসলিম পরবে নিজেরাই নিজেদের চামড়া কাটেন ছুরি দিয়ে। তার থেকেই হয়তো এই নাম। এই মসজিদে উচ্চ বর্ণের মুসলিমরা নমাজ পড়তে আসতেন না। অন্যান্য মসজিদে চামকাটি মুসলিমদের ঢুকতেও দেওয়া হত না। তাই শুধুমাত্র চামকাটি মুসলিমদের জন্যই এই মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল। এর পাশেই গুমটি দরওয়াজা। হয়তো দুর্গের আরও একটি প্রবেশ পথ। চারটি স্তম্ভ আছে, তাতে আছে সুন্দর কাজ।
আমরা এখান থেকে লুকোচুরি গেট দিয়ে বেরিয়ে চললাম সোজা। যাওয়ার পথে চোখে পড়ল লাইন দিয়ে লরি চলেছে। অধিকাংশই স্টোনচিপস নিয়ে যাচ্ছে। সব লরিই অতিরিক্ত ভারে নুয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ বর্ডারের সামনে বিএসএফ-এর কড়া পাহারা।
এখানেই আমাদের গৌড় দেখা শেষ। এর পর আমরা আবার মালদা টাউনে লাঞ্চ খেয়ে চলে যাব পাণ্ডুয়া। (চলবে)
কী ভাবে যাবেন
ভারতের সব বড়ো শহরের সঙ্গেই মালদার ট্রেন যোগাযোগ আছে। কলকাতা থেকে মালদা যাওয়ার অজস্র ট্রেন। ছাড়ে হাওড়া, শিয়ালদহ আর কলকাতা স্টেশন থেকে। ট্রেনের সময়ের জন্য দেখে নিন erail.in ।
সংক্ষিপ্ততম সড়কপথে কলকাতা থেকে মালদার দূরত্ব ৩৬০ কিমি। এই পথ বর্ধমান, ভাতার, খড়গ্রাম, রমাকান্তপুর, ফারাক্কা হয়ে। নিজেরা গাড়ি নিয়ে গেলে এই পথে যেতে পারেন।
কলকাতা থেকে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে (পথ কৃষ্ণনগর, বহরমপুর, ফারাক্কা হয়ে) নিয়মিত বাস চলে মালদার।
কোথায় থাকবেন
পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের টুরিস্ট লজ রয়েছে মালদায়। অনলাইন বুকিং www.wbtdcl.com । এ ছাড়া মালদায় অনেক বেসররকারি হোটেল, রিসর্ট রয়েছে। গুগলে ‘accommodation in malda’ সার্চ করলে এদের সন্ধান পেয়ে যাবেন। পেয়ে যাবেন এদের সম্পর্কে রিভিউও।
ছবি: লেখক ও সংগৃহীত