একটু চলেই পৌঁছে গেলাম দাখিল দরওয়াজায়। এটি যে কে তৈরি করেছিল তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ বলেন হুসেন শাহ ১৪২৫ সালে এটা তৈরি করেছিলেন। আবার বলা হয় এই সৌধটির রূপকার বারবক শাহ।
যদি গৌড়কে একটা দুর্গ বলে ধরে নেওয়া হয়, তা হলে এটাই তার তোরণ বা প্রবেশদ্বার। গৌড়ে দাখিল হওয়ার জন্যই এই দরওয়াজা। তাই নাম হল দাখিল দরওয়াজা। তবে দুর্গ কিন্তু সত্যি ছিল। তার নাম ছিল লখনৌতি। আশ্চর্য হওয়ার পালা। উত্তরপ্রদেশের লখনউ এখানে যে কী করে এল কে জানে।
এটা পুরোটাই প্রায় ইটের তৈরি। পাথরের ব্যবহারও আছে, কিন্তু কম, লিনটন অবধি। এই ফটক ষাট ফুট উঁচু এবং তিয়াত্তর ফুট চওড়া। সব ক’টা ইটই টেরাকোটার। এক ইঞ্চি চওড়া।
দাখিল দরওয়াজার আর একটি নাম আছে – সেলামি দরওয়াজা। ভেতর দিয়ে একটা রাস্তা গিয়েছে। বেশ চওড়া। সম্ভবত ৩৫ ফুট। এতটাই চওড়া যে কেউ হাতির পিঠে চেপে ভেতরে আসতে পারত। দু’ পাশ থেকে কামান দাগা হত যখন সুলতান বা হোমরাচোমরা কেউ আসতেন। তোপধ্বনি করে সম্মান প্রদর্শন করা হত বা সেলাম জানানো হত। তাই সেলামি দরওয়াজা।
ভেতরে ডান আর বাঁ দিকে দু’টো ঘোর অন্ধকার করিডোর। এটা হয়তো প্রহরীদের জন্য ছিল। আর সেখানে আছে অনেক অনেক চামচিকে। আমাদের ঢুকতে দেখে তারা ভীষণ কিচিমিচি শুরু করল। বিরক্তও করল।
পাশেই একটু উঁচু টিলা। ওঠা বেশ চাপের। তবে উঠতে পারলে ওপর থেকে সৌধের ছাদটা দেখা যায়। এখানেও ঘাস সুন্দর করে ছাঁটা। বেশ সাজানোগোছানো।
এখান থেকে বাইরে এসে একটা বড়ো পুকুর, তার পাশেই বেশ বড়ো একটা আমবাগান। আমবাগানে পিকনিক হয়, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। মাটি আর দেখা যাচ্ছে না। সাদা থার্মোকলের আস্তরণ। দেখলাম থার্মোকলের গেলাস, থালা আর বাটি। মাটি নেই। দেখলেই রাগ হয়। কিন্তু যুগটাই মেনে নেওয়ার। তাই এটাও মেনেই নাও।
এর পর সোজা রাস্তায় চললাম ফিরোজ মিনার। বাঁ দিকে পুকুর, ডান দিকে ফুলের বাগান দিয়ে সাজানো মালদহের মনুমেন্ট ফিরোজ মিনার। গিয়ে দেখলাম গেট বন্ধ। ওখান দিয়েই সিঁড়ি। ৭৩টি সিঁড়ি আছে। ঘুরে ঘুরে একেবারে ওপরে পৌঁছেছে। কিন্তু উপরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। পথ বন্ধ। অতএব বাইরে থেকেই দেখা। ইন্টারনেট অনুযায়ী ফিরোজ মিনার ৮৪ ফুট উঁচু।
এই মিনারের স্থপতি একজন ক্রীতদাস। নাম সইফুদ্দিন ফিরোজ। মিনারের বয়স সাতশো বছর।
বারবক শাহকে খুন করে গৌড়ের সুলতান হয়েছিলেন ফিরোজ। মিনারটা প্রথম দিকে এত উঁচু ছিল না। ফিরোজ তো সুলতান হয়েই তাঁর নামাঙ্কিত মিনার তৈরি করার অর্ডার দিয়েছেন। মিনার তৈরি হচ্ছে। এক দিন হঠাৎ ফিরোজ ঠিক করলেন মিনার কেমন তৈরি হচ্ছে দেখতে যাবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। মিনার তৈরি দেখতে এলেন ফিরোজ। কথা বললেন মিস্ত্রির সঙ্গে। ফিরোজ জিজ্ঞাসা করলেন এই মিনার আরও উঁচু করা সম্ভব কিনা। মিস্ত্রি বলল, হাঁ অনেক উঁচু করা সম্ভব। শুনে ফিরোজ রেগে কাঁই। মিস্ত্রিকে জিজ্ঞাসা করলেন তা হলে কেনই বা আর উঁচু করা হয়নি? মিস্ত্রি বলল, উঁচু করতে গেলে যা মালপত্র লাগবে তার কিছুই ছিল না। ফিরোজ এ বার আরও রেগে গেলেন। মিস্ত্রিকে জিজ্ঞাসা করলেন, সেটা তাঁকে জানানো হয়নি কেন?
মিস্ত্রি এ বার আর কোনো উত্তর দেয় না। ফিরোজ রাগে ফুঁসছেন। হুকুম দিলেন, মিস্ত্রিকে মিনার থেকে নীচে ফেলে দিতে। সেইমতো উঁচু মিনার থেকে ফেলে দেওয়া হল মিস্ত্রিকে।
এ বার ফিরোজ গটমট করে নেমে এলেন মিনার থেকে। এসেই ডাকলেন তাঁর পরিচারককে। চাকরের নাম হিঙ্গু। হিঙ্গুকে আদেশ দিলেন তখনই মোরগ্রামে যেতে। হিঙ্গু পত্রপাঠ মোরগ্রাম চলে এল। কিন্তু সুলতানকে জিজ্ঞাসা করার সাহস হয়নি মোরগ্রামে তাঁর কী কাজ। এটাও হিঙ্গু জানে এখন ফেরত গেলে তাঁকেও হয়তো ওই মিনার থেকে ফেলে দেওয়া হবে। ওরে বাবা। তার থেকে গ্রামেই ঘুরে বেড়ানো ভালো, এই বলে গ্রামেই ঘুরঘুর করতে লাগল হিঙ্গু।
হিঙ্গুকে এক ব্রাহ্মণের ছেলে দেখতে পেল। দেখেই বুঝল কিছু একটা হয়েছে। তখন সে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে। হিঙ্গু সব বলার পর ছেলেটি তাকে বলল, তুমি এখান থেকে একজন ভালো মিস্ত্রি নিয়ে যাও, যে উঁচু মিনার বানাতে পারে। হিঙ্গু একজন মিস্ত্রিকে নিয়ে গেল ফিরোজের কাছে। ফিরোজ খুশি হলেন। হিঙ্গু অকপটে বললেন সেই ছেলেটির কথা, যে হিঙ্গুকে বুদ্ধি দিয়েছিল। ফিরোজ বুঝলেন ছেলেটি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। এখনই তাঁকে রাজসভায় ডেকে এনে চাকরিতে বহাল করার আদেশ দিলেন তিনি।
ফিরোজের পরে সুলতান হন হুসেন শাহ। আর সেই ছেলেটি কিন্তু সত্যি তাঁর মন্ত্রী হন। সেই ছেলের নাম সনাতন। এ রকম একটা দুর্দান্ত গল্প শুনে আমরা এগোলাম বিশালদেহী এক পাঁচিলের সন্ধানে। এ বার সেই গল্প।
ফিরোজ মিনার থেকে রওনা দিয়েছি। গাড়িটা ডান দিকের একটা রাস্তা ছেড়ে সোজা বেরিয়ে যাচ্ছিল। আমরা হাঁ হাঁ করে উঠলাম। ওদিকটায় কী আছে? পাইলট বলল, একটা উঁচু পাঁচিল। কেউ দেখতে যায় না। কিন্তু আমরা যে যাব। অতএব ব্যাক গিয়ার।
ডান দিকে বেঁকে একটু গেলেই বিশাল উঁচু এক ভাঙা পাঁচিল। সেটা বিশাল চওড়াও বটে। তবে ভেঙে পড়ছে। পাঁচিলটা হয়তো আরও অনেকটাই ছিল। এখন তার একটা ছোট্টো অংশ দেখতে পাচ্ছি। পাশ দিয়ে শুঁড়িপথ। হয়তো লখনৌতি বা গৌড়ের দুর্গের পাঁচিল ছিল এটা। সুরক্ষার জন্যই তৈরি হয়েছিল। ভেতরে প্রবেশের জন্য সেলামি বা দাখিল দরওয়াজা। এই দেওয়াল বা পাঁচিলের নাম বাইশগজী দেওয়াল।
দেয়ালটা বাইশ গজ উঁচু। তাই ওই নাম। তিনকোনা দেওয়াল। অর্থাৎ নীচের দিকে বেশি চওড়া। উপরের দিকে কম চওড়া। সম্ভবত যাতে পাঁচিল বেয়ে ওঠা কঠিন হয় তাই এই রকম। নীচের দিকে পনেরো ফুট আর উপরের দিকে নয় ফুট চওড়া। কত যে ইঁট লেগেছে তার হিসাব নেই। পাশের শুঁড়িপথ পথ ধরে হাঁটা লাগলাম। দেখলাম বেশ কিছু জায়গা সরানো হয়েছে। কিছু জায়গা একেবারে ভগ্নপ্রায়। হেঁটে পাচিলের শেষ অংশে পৌঁছোলাম। সেই অংশটি একটু অন্য রকম দেখতে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই অংশ অনেক পরে তৈরি। (চলবে)
কী ভাবে যাবেন
ভারতের সব বড়ো শহরের সঙ্গেই মালদার ট্রেন যোগাযোগ আছে। কলকাতা থেকে মালদা যাওয়ার অজস্র ট্রেন। ছাড়ে হাওড়া, শিয়ালদহ আর কলকাতা স্টেশন থেকে। ট্রেনের সময়ের জন্য দেখে নিন erail.in ।
সংক্ষিপ্ততম সড়কপথে কলকাতা থেকে মালদার দূরত্ব ৩৬০ কিমি। এই পথ বর্ধমান, ভাতার, খড়গ্রাম, রমাকান্তপুর, ফারাক্কা হয়ে। নিজেরা গাড়ি নিয়ে গেলে এই পথে যেতে পারেন।
কলকাতা থেকে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে (পথ কৃষ্ণনগর, বহরমপুর, ফারাক্কা হয়ে) নিয়মিত বাস চলে মালদার।
কোথায় থাকবেন
পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের টুরিস্ট লজ রয়েছে মালদায়। অনলাইন বুকিং www.wbtdcl.com । এ ছাড়া মালদায় অনেক বেসররকারি হোটেল, রিসর্ট রয়েছে। গুগলে ‘accommodation in malda’ সার্চ করলে এদের সন্ধান পেয়ে যাবেন। পেয়ে যাবেন এদের সম্পর্কে রিভিউও।
ছবি: লেখক ও সংগৃহীত