হারিয়ে গিয়েছে চিত্রভানুর সেই রঙ, জানে তা কি কালিম্পং

সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়

চার পাশে আগাছা জন্মেছে। ২০১১ সালের ভূমিকম্পের পরে দেওয়ালে বড়ো বড়ো ফাটল। বহুকাল শরীরে মাখেনি রঙের আদর। সুন্দর প্রকৃতির বুকে অবহেলায় অসুন্দর ভাবে উপেক্ষিত হয়ে পড়ে আছে রবির প্রিয় চিত্রভানু।

বাংলাদেশের ময়মনসিংহের জমিদার রায়চৌধুরী পরিবারের শৈলাবাস ছিল – ‘গৌরীপুর হাউস’। পরবর্তী কালে যা রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রভানু’ নামে পরিচিত হয়। ত্রিশের দশকে বার বার দীর্ঘ সময় কবি গ্রীষ্ম যাপন করেছেন এই বাড়িতে। সেই সময় বাড়িটি হয়ে উঠেছে নিসর্গের বুকে কবির সৃজনভূমি। কালিম্পং শহরে ‘চিত্রভানু’তে বাস করার সময় ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪০-এ ‘জন্মদিনে’ শীর্ষক কবিতাগুচ্ছের য় তিনি লিখেছেন –

“পাহাড়ের নীলে আর দিগন্তের নীলে

শূন্যে আর ধরা তলে মন্ত্র বাঁধে ছন্দে আর মিলে।

বনেরে করায় স্নান শরতের রৌদ্রের সোনালি।

হলদে ফুলের গুচ্ছে মধু খোঁজে বেগুনি মৌমাছি।

মাঝখানে আমি আছি,

চৌদিকে আকাশ তাই দিতেছে নিঃশব্দ করতালি।

আমার আনন্দে আজ একাকার ধ্বনি আর রঙ,

জানে তা কি এ কালিম্পং।…

chitrabhanu

হিমালয়ের বুকে বসবাস করা বিশেষ করে গ্রীষ্মের দিনগুলিতে কবির কাছে ছিল আনন্দের। উদযাপনের। তাই শিলং থেকে দার্জিলিং, আলমোড়া থেকে কালিম্পং বার বার ছুটে গিয়েছেন কবি। জীবনের শেষের দিকে কবিকে সঙ্গ দিয়েছেন পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী। প্রতিমাদেবীর উদ্যোগেই পরবর্তী সময়ে কালিম্পং-এর বাড়িতে গড়ে উঠেছিল পাহাড়ের মেয়েদের হস্তশিল্প শিক্ষাদান কেন্দ্র। কবির ৭৮তম জন্মদিন উদযাপন হয় চিত্রভানুতেই। সেই সূত্রে কালিম্পং শহরে প্রথম এল টেলিফোন। যার মাধ্যমে ‘জন্মদিন’ কবিতাটি পৌঁছে গেল আকাশবাণীতে সম্প্রচারিত হল দেশ জুড়ে। কালিম্পং-এ জন্মদিনের উদযাপনে জন্মদিন কবিতায় কবির কলমে উঠে এসেছিল আসন্ন মৃত্যুর পূর্বাভাস –

বৃথা বাক্য যাক। তব দেহলিতে শুনি ঘণ্টা বাজে

শেষ প্রহরের ঘণ্টা; সেই সঙ্গে ক্লান্ত বক্ষোমাঝে

শুনি বিদায়ের দ্বার খুলিবার শব্দ সে অদূরে

ধ্বনিতেছে সূর্যাস্তের রঙে রাঙা পূরবীর সুরে।…

২০১১ সালের ভূমিকম্পে ‘চিত্রভানু’র ভাঙন-পরবর্তী ঐতিহ্যবাহী স্থান সংরক্ষণের অপরিহার্য পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে, শুধু এমনটা জানা গিয়েছে। কিন্তু সেই পরিকল্পনা কোন দফতরে লাল ফিতের ফাঁসে বন্দি এখনও তা জানা যায়নি। তাই ‘চিত্রভানু’তে বেশিক্ষণ থাকলে অবাঙালি ড্রাইভার বিরক্ত হয়ে বলে – ‘ক্যায়া হ্যায় ইধার বাবু? কুছ নেহি’। প্রত্যুত্তরে কিছু বলার থাকে না। কারণ বাঙালির রবীন্দ্র-প্রেম ট্র্যাফিক সিগন্যালের গানে আটকে এখনও পাহাড়ের উচ্চতায় উঠতে পারেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *