পদব্রজে কলকাতা: ভাষা দিবসে উত্তরের অলিতেগলিতে ‘বর্ণপরিচয় ওয়াক’

শ্রয়ণ সেন

চমৎকার একটি বাড়ি। সাবেকি। লম্বা টানা রক। সবুজ খড়খড়ি আর দরজা। নামটাও তার চমৎকার– ‘চমৎকার বাড়ি।’

হাঁদাভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট, ছবিতে রামায়ণ, ছবিতে মহাভারত – সব কিছুই এই বাড়ি থেকেই প্রকাশিত হয়। কারণ এই বাড়িতেই যে রয়েছে দেব সাহিত্য কুটিরের প্রেস। উত্তর কলকাতার ঝামাপুকুর লেনের এই বাড়িটায় এক সময়ে বরেণ্য সব মানুষের যাতায়াত লেগে থাকত। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সেই গোলাপি মলাটের ‘বর্ণপরিচয়’ও তো পরবর্তী কালে এই বাড়ি থেকেই প্রকাশিত হয়।

‘বর্ণপরিচয়’-এর মধ্যে দিয়ে সংস্কৃত ভাষার অযৌক্তিক শাসনজাল থেকে বাংলা ভাষাকে মুক্ত করেন বিদ্যাসাগর। সেই সঙ্গে যুক্তি ও বাস্তবতাবোধ প্রয়োগ করে বর্ণমালাকে সংস্কার করেন তিনি। সেই কারণেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে উত্তর কলকাতা অলিতেগলিতে ঘুরিয়ে দেখানোর যে পরিকল্পনা ‘ওয়াক ক্যালকাটা ওয়াক’ করেছিল, তার নামকরণ হয়েছিল ‘বর্ণপরিচয় ওয়াক’।

সংগঠনের দুই কান্ডারি – দীপ ভট্টাচার্য আর অয়ন মণ্ডল। ২০১৯ সালে এই দু’ জনের উদ্যোগে জন্ম ‘ওয়াক ক্যালকাটা ওয়াক’-এর। উদ্দেশ্য ছিল, নিজেরা যেমন কলকাতার সঙ্গে পরিচিত হবেন, তেমনই অন্যদেরও শহরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন। আমার সঙ্গে দু’ জনেরই পরিচয় হল গত মাসে। ২৬ জানুয়ারিও এমনই একটা হাঁটা হেঁটেছিলাম আমরা। তেমনই আজ আবার পথে। আগের বারের মতো এ বারও কোভিডের সব রকম বিধি কঠোর ভাবে মেনেই হাঁটা হয়েছে।

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে মিলিত হয়ে হাঁটা শুরু। প্রথমে দাঁড়ানো হল সংস্কৃত কলেজের সামনে। বিদ্যাসাগর মহাশয় এই কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন এই কলেজের পরিচিতি বাড়ে। এই কলেজের নিয়মনীতি সংস্কার করে ১৮৫১-এর জানুয়ারিতে কায়স্থদের জন্য এবং ১৮৫৪-এর ডিসেম্বরে সব বর্ণের হিন্দুদের জন্য কলেজের দরজা খুলে দেওয়া হয়।

এ দিনের হাঁটায় মাঝেমধ্যেই ফিরে এসেছেন বাঙালির সমাজসংস্কারের অন্যতম কান্ডারি বিদ্যাসাগর। তবে সংস্কৃত কলেজের পর আমাদের গন্তব্য ছিল উত্তর কলকাতার এক বিখ্যাত মিষ্টির দোকান, পুঁটীরাম (দোকানের সাইনবোর্ডে এই বানানই লেখা)। উদ্দেশ্য প্রাতরাশ করা। আলুর তরকারি-সহ চারটে কচুরি, নতুন গুড়ের রসগোল্লা এবং ১০০ গ্রামের এক ভাঁড় মিষ্টি দই খেয়ে ফের হাঁটা শুরু।

কলেজ স্কোয়ারে ডেভিড হেয়ারের সমাধিস্থল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মৃত্যু বরণ করা বাঙালি সেনাদের সৌধটি দেখে চলে এলাম উত্তর কলকাতার বিখ্যাত গলিগুলিতে। এই রাস্তাগুলোর পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। এখান দিয়ে হাঁটলে এবং বাড়িগুলোর দিকে তাকালে সময় যে কয়েক দশক পিছিয়ে যাবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

হাঁটতে হাঁটতেই এগিয়ে চলা। ঝামাপুকুর লেন দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই চলে এল রামকৃষ্ণ সংঘ। এটা আদতে দিগম্বর মিত্রের বাড়ি, যা পরিচিত ছিল ঝামাপুকুর রাজবাড়ি হিসেবে। দাদা রামকুমারের হাত ধরে কলকাতায় পৌঁছে ঝামাপুকুর লেনের এই বাড়িতেই উঠেছিলেন গদাধর চট্টোপাধ্যায় তথা শ্রীরামকৃষ্ণ। বাড়িটি খুব ভালো ভাবে সংস্কার করা হয়েছে। ঠাকুর দালানে শ্রীরামকৃষ্ণ, জগজ্জননী সারদা দেবী এবং স্বামী বিবেকানন্দের ছবি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নিত্য পুজো হয় সেখানে।

বাড়ির দালানে বেশ কিছুটা সময় জিরিয়ে নেওয়া গেল। ফের হাঁটা শুরু। এসে পৌঁছোলাম সেই ‘চমৎকার বাড়ি’তে।

দেব সাহিত্য কুটির-এর বীজ বুনেছিলেন বরদাপ্রসাদ মজুমদার। কলকাতার বটতলা অঞ্চলে থাকতেন তিনি। বটতলা তখন ছিল কলকাতার প্রকাশনার এক কেন্দ্র। তাঁর যে স্বল্প সঞ্চয় ছিল তা নিয়েই তিনি আবির্ভূত হলেন পুস্তকবিক্রেতা হিসাবে। এই কাজে আয়‌ও হচ্ছিল ভালোই।

বরদাপ্রসাদ শীঘ্র‌ই বেশ কিছু টাকা জমিয়ে নিজের একটা ছোটো প্রেস খুললেন। বরদাপ্রসাদের সেজো ছেলে আশুতোষ উত্তরাধিকারসূত্রে বাবার ব্যবসার অধিকারী হলেন। সেই সময় থেকেই তিনি ডিকশনারি প্রকাশের পরিকল্পনা করেন। শীঘ্র‌ই এই ডিকশনারি প্রকাশিত হল।

এর পর ১৯২৪ সালে তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অনেক পাঠ্যপুস্তকের স্বত্বও কিনে নেন। তার মধ্যে অবশ্যই ছিল বর্ণপরিচয়। ওই বছর‌ই প্রতিষ্ঠিত হল ‘দেব সাহিত্য কুটির’। ব্যাবসায় লক্ষ্মী মুখ তুলে চাইলেন। প্রচুর সম্পত্তি হল আশুতোষ দেবের।

প্রায় ৩০টি বাড়ির মালিক হলেন তিনি। ঝামাপুকুর লেনে ৫টি বাড়ি কেনেন তিনি। ২১ নম্বর লেনের বাড়ির নাম রাখলেন নিজের স্ত্রী, চমৎকার সুন্দরী দাসীর নামে – ‘চমৎকার বাড়ি’। আর তার পাশে ২১/১-এর নাম – বরদাকুটীর।

পথ চলতে চলতে ফের বিদ্যাসাগর মশাই এসে গেলেন। সেই সূত্র ধরেই এ বার তাঁর বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রথম জীবনে নিজের জন্য কোনো বাড়ি না করলেও পরে তাঁর বিপুল গ্রন্থসম্ভার রাখার জন্য ১৮৭৬-এ মধ্য কলকাতায় ২৫ বৃন্দাবন মল্লিক লেনে, অধুনা ৩৬ বিদ্যাসাগর স্ট্রিটে এক খণ্ড জমির ওপরে একটি দোতলা বাড়ি তৈরি করেন৷ জীবনের শেষ চোদ্দো বছর মাঝেমধ্যে তিনি কাটিয়েছেন এই বাড়িতে৷ এই বাড়িতেই মারা যান তিনি।

বাড়িটিতে এখন সংস্কারের কাজ চলছে। তাই সামনের বাগান ছাড়িয়ে বাড়ির ভিতরে ঢোকা গেল না। সংস্কারের কাজ শেষ হলে একদিন সবাই আসব, এই প্রতিজ্ঞা করে শেষ দফার হাঁটা শুরু হল। এ বার আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড পেরিয়ে ঢুকলাম গড়পাড় রোডে। কিছুটা এগোতেই ডান দিকে দেখলাম এক বিদ্যালয় ভবন।

ঢোকার দরজার ওপরে একটি ফলকে লেখা এথেনিয়াম ইনস্টিটিউশন। পাশেই রয়েছে তিন মহাপুরুষের মূর্তি। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায় এবং সত্যজিৎ রায়। ১৯১৪ সালে উপেন্দ্রকিশোর ১০০এ গড়পাড় রোডের ওপর এই বাড়িটি তৈরি করেন। এখানেই ১৯২১ সালের ২ মে জন্মগ্রহণ করেন সত্যজিৎ রায়। ঐতিহাসিক এই বাড়িটি এথেনিয়াম বিদ্যালয় কিনে নেয় ১৯৩১ সালে।

এখানেই শেষ হল রবিবারের ‘বর্ণপরিচয় ওয়াক।’ শেষ করার আগে ফের একবার স্লোগান উঠল, ‘শহর চিনতে হলে হেঁটে দেখো বন্ধু।’ সেই সঙ্গে আওয়াজ উঠল “আসছে মাসে আবার হবে।” ‘বর্ণপরিচয় ওয়াক’ হয়তো শেষ, কিন্তু হাঁটা শেষ করছে না ‘ওয়াক ক্যালকাটা ওয়াক।’ ফের রাস্তায় নামবে তারা, হয়তো সামনের মাসেই।

আরও পড়ুন: পদব্রজে কলকাতা: অরবিন্দ, যতীন দাস, ১১-এর বিজয়ী, নেতাজি, সত্যেন বসুকে প্রণাম করে ভগৎ সিংয়ের ডেরায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *