শ্রয়ণ সেন
কলকাতার মধ্যেই রয়েছে আরও একটা কলকাতা। উত্তর কলকাতার অলিতেগলিতে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। যাকে চেনার জন্য হাঁটতে হয়। শহরের সেই ইতিহাস জানতেই সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়েছিলাম ‘ওয়াক ক্যালকাটা ওয়াক’-এর সঙ্গে। সাধারণতন্ত্র দিবসের সকালে কলকাতার বহু অজানা ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হতে।
কলকাতাপ্রেমিক দুই বন্ধু অয়ন মণ্ডল আর দীপ ভট্টাচার্য। কলকাতার অলিতেগলিতে হেঁটে শহরকে নতুন করে চেনার তাগিদ দু’ জনেরই। ২০১৯ সালে এই দু’ জনের উদ্যোগে জন্ম ‘ওয়াক ক্যালকাটা ওয়াক’-এর। উদ্দেশ্য ছিল, নিজেরা যেমন কলকাতার সঙ্গে পরিচিত হবেন, তেমনই অন্যদেরও শহরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন।
কোভিডের কারণে প্রায় এক বছর বন্ধ থাকার পর ফের নতুন ভাবে হাঁটার পরিকল্পনা করল ‘ওয়াক ক্যালকাটা ওয়াক’। সাধারণতন্ত্র দিবসের সক্কালে। উত্তর কলকাতার গলি এবং রাজপথে লুকিয়ে থাকা কিছু ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হতে যোগ দিলাম সেই ‘ওয়াক ক্যালকাটা ওয়াক’-এ।

আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল ১০৮ অরবিন্দ সরণি। এক কালে এই বাড়ির ঠিকানা ছিল ৪৮ নম্বর গ্রে স্ট্রিট। আলিপুর বোমা মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে ১৯০৮ সালের ২ মে এই বাড়ি থেকেই গ্রেফতার হন বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ, যিনি পরিবর্তী কালে ঋষি অরবিন্দ হন। বাড়িটার রক্ষণাবেক্ষণ এত বেশি মাত্রায় হয়েছে যে ইতিহাসের সঙ্গে মেলাতেই কষ্ট হয় এখন। তবে বাড়িটির সামনে থাকা একটি ফলকই তার ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা জানান দেয়।
ফের বিধান সরণি দিয়ে হাঁটা। অভিমুখ শ্যামবাজার। এই রাস্তাটার ঐতিহাসিক গুরুত্বও অপরিসীম। এর ধারেই তো একাধিক ঐতিহাসিক বাড়ি রয়েছে। রাস্তা দিয়ে যে কত স্বাধীনতাসংগ্রামী, বিপ্লবী, ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হেঁটে গিয়েছেন, তার কোনো হিসেব নেই।

অরবিন্দ ঘোষের পর এ বার গন্তব্য যতীন দাস। বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের সহকর্মী যতীন্দ্রনাথ দাস লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়ে ১৯২৯ সালের ১৪ জুন গ্রেফতার হন। জেলবন্দিদের অধিকারের দাবিতে ওই বছরই ১৩ জুলাই অনশন শুরু করেন তিনি। ৬৩ দিন অনশনের পর ১৩ সেপ্টেম্বর মাত্র ২৪ বছর বয়সে জেলেই মৃত্যু হয় তাঁর।
‘১বি গনেন্দ্র মিত্র লেন’-এর বাড়িতে জন্মেছিলেন যতীন দাস। বাড়িটির অস্তিত্ব এখন আর নেই বললেই চলে। তবে তার সামনে যতীন দাসের একটি মূর্তি বসানো হয়েছে।
এর পর মোহনবাগান লেনে ঢুঁ মারলাম। ১৯১১ সালে সবুজমেরুনের সেই বিখ্যাত আইএফএ শিল্ড জয় স্মরণে এখানে সেই দলের ১১ জনেরই মূর্তি রয়েছে। মোহনবাগান ক্লাবের বীজ বপন হয়েছিল এই সব অলিগলির মধ্যেই। বিধান সরণিতে এসে ফের হাঁটা শুরু। তবে এ বার উলটো পথে।

থমকালাম ‘লক্ষ্মীনারায়ণ সাউ অ্যান্ড সন্স’-এর সামনে। দোকানকে ঘিরে রেখেছেন নেতাজি। জানা যায়, কলেজে পড়াকালীন সুভাষচন্দ্র বসু এই দোকানটিতে নিয়মিত আসতেন বিকেলবেলা। পেঁয়াজি আর আলুর চপ, সঙ্গে অল্প মুড়ি নাকি তাঁর খুব প্রিয় ছিল। প্রতি বছর নেতাজির জন্মদিনে বিনামূল্যে সবাইকে তেলেভাজা খাওয়ানো হয় এখানে। কোভিডের আবহেও সেই ধারা এ বারও বহাল ছিল এখানে।
এ বার গন্তব্য ২২ নম্বর ঈশ্বর মিল লেন। এই বাড়িতেই জন্মেছিলেন বিশ্বখ্যাত এক বিজ্ঞানী। আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে যৌথ ভাবে যিনি কাজ করেছিলেন, যা পরবর্তী কালে পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বলে বিবেচিত হয়। হ্যাঁ, উত্তর কলকাতার এই বিখ্যাত গলিতে এই বাড়িতেই থাকতেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু।

যে হেতু এক বছর পর নতুন করে হাঁটার এই ব্যাপারটা চালু করা হয়েছে, আর এখনও কোভিডের চোখরাঙানি যথেষ্টই রয়েছে, তাই সংগঠকরা বলেই দিয়েছিলেন দেড়-দু’ ঘণ্টার বেশি হাঁটা হবে না। অলিগলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে সময় পেরিয়ে গেল তা বুঝতেই পারিনি। তবে শেষ মুহূর্তে আরও একটি চমক অপেক্ষা করছিল।
আর্যসমাজ মন্দির। আজকের ঠিকানা ১৯ নম্বর বিধান সরণি। এক দিকে আর্যকন্যা উচ্চ বিদ্যালয়। অন্য পাশে হার্ডিঞ্জ হল। এই বাড়িটা আজও যে কোনো ভারতীয়ের কাছে আবেগের, শ্রদ্ধার। ১৯২৭-এর ১৭ ডিসেম্বর ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার জন স্যান্ডারসকে হত্যা করে ছদ্মবেশে কলকাতায় পালিয়ে আসেন ভগৎ সিং। উঠেছিলেন এই আর্যসমাজ মন্দিরে।
কলকাতা ছাড়ার আগে আর্য সমাজ মন্দিরের প্রহরী তুলসীরামকে নিজের থালা এবং লোটা দিয়ে যান ভগৎ সিং।জানা যায় যে তুলসীরাম সম্ভবত ওই অসামান্য সামগ্রীর মর্মই বোঝেননি। তিনি সেটা নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলেন এবং পরে সেগুলোর আর কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি।

ভগৎ সিং খ্যাত এই বাড়িতে এসেই আজকের মতো শেষ হল ‘রিপাবলিক ডে ওয়াক।’ একটা গ্রুপ ছবির মধ্যে দিয়ে শেষ হল ইভেন্ট। সেই সঙ্গে স্লোগান উঠল, “শহর চিনতে হলে, হেঁটে দেখো বন্ধু।”
তাঁদের নানা রকম উদ্যোগের কথা বলছিলেন দীপ এবং অয়ন। ভবিষ্যতে এই ধরনের আরও উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান দু’জনেই। ‘ওয়াক ক্যালকাটা ওয়াক’-এর ফেসবুক পেজে নজর রাখলেই সব তথ্য পাওয়া যাবে। তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত, আমি কিন্তু এই সঙ্গ আর ছাড়ছি না।
ছবি: লেখক
আরও পড়ুন: কলকাতা দর্শন: দেখে আসুন ‘রাজ-এর তাজ’ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল