
তিন বন্ধু আড্ডা মারতে গিয়েছিলাম আমাদের আড্ডার ঠেক ‘মাসির আইসক্রিমের’ দোকানে। কথা প্রসঙ্গে উঠল, অনেক দিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হচ্ছে না। ‘চলো যাই চলে যাই দূর বহু দূর’ গানের দু’টি কলি আমার মুখ থেকে খসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সর্ব সম্মত ভাবে গৃহীত হল প্রস্তাব।
এ বার কোথায় যাব? শুভজিৎ বলল, জঙ্গল। ব্যাস সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে ভেসে উঠল উত্তরবঙ্গ। কিন্তু পকেটের কথা মনে পড়তেই উত্তরবঙ্গ থেকে সরে আসতে হল। হঠাৎ করে আমার মনে পড়ে গেল বেথুয়াডহরীর কথা – নদিয়া জেলায় ১৬৭ একরের বনাঞ্চল। ঘরের কাছে দু’ দিনের জন্য এর থেকে ভালো কী হতে পারে!
যাত্রা সকাল ৬.৫০-এর হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেসে আর থাকা বেথুয়াডহরী বনবাংলোয়। একটু নেট ঘাঁটাঘাঁটি করতেই পেয়ে গেলাম বেথুয়াডহরী বনবাংলোর কেয়ারটেকার তথা বনরক্ষক শঙ্করবাবুর মোবাইল নম্বর। ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতেই সাদর আমন্ত্রণ জানালেন এবং জানিয়ে দিলেন খাওয়াদাওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা উনি করে দেবেন। আমরাও আশ্বস্ত হলাম। এ বার আর নিজেদের নড়াচড়া করে খেতে হবে না, বনের রাজার মেজাজে বসে বসে খাব।
হাজারদুয়ারিতে উঠে জানলার ধারটি দখল করে বসলাম। যথা সময়ে ট্রেন ছাড়ল আর আমাদেরও মুখ চলতে থাকল – ঝালমুড়ি, কেক, চানাচুর, চিপস, চা, বিস্কুট, গজা – যা পাওয়া যায় না। রানাঘাটের পর থেকেই বাইরের দৃশ্যপট বদলাতে থাকল, মনোরম সবুজ শান্ত পরিবেশ দিয়ে হুড়মুড় দুরদুর করে ট্রেন ছুটে চলল। মাঝে মাঝে চোখে পড়ল ফুলের খেত। এর মধ্যে কৃষ্ণনগর থেকে উঠল পানতুয়া, রসগোল্লা। সে-ও বাদ গেল না। যথা সময়ে এল ছোট্টো স্টেশন বেথুয়াডহরী। বাইরে বেরোতেই গাদাগাদা টোটো। একটি টোটো নিয়ে খানিকটা এবড়োখেবড়ো জাতীয় সড়ক দিয়ে চলে পৌঁছে এলাম একদম ফরেস্টের গেটের সামনে। আমাদের দেখেই শঙ্করবাবু সাদর অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেলেন ভেতরে।
গেট দিয়ে ঢুকেই বাঁ পাশে প্রকৃতিবীক্ষণ কেন্দ্র ও তার উলটো দিকেই আমাদের থাকার কটেজ। দু’টি কটেজ, খুব মিষ্টি নাম – ময়ূর আর ময়ূরী। দেখেশুনে ‘ময়ূর’ই বেছে নিলাম। দুপুরে কী খাব শঙ্করবাবুকে বলেই, ব্যাগপত্তর রেখে বেরিয়ে পড়লাম জঙ্গলে ভ্রমণে।
জঙ্গলের মধ্যে চলাফেরা করার জন্য নির্দিষ্ট পথ রয়েছে। সেই মতোই নির্দিষ্ট পথ ধরে এগিয়ে চললাম। নানা রকমের পাখির ডাক শুনতে শুনতে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে চললাম চোখ-কান খোলা রেখে। একটু এগোতেই হরিণবাবাজিদের খাওয়ার জায়গা, কিন্তু একটিও চোখে পড়ল না। খানিক এ-দিক ও-দিক ঘুরে ‘ময়ূর’-এ ফিরে এলাম। পেটে যে ছুঁচো দৌড়োচ্ছে। শঙ্করবাবু মুরগির মাংস নিয়ে তৈরিই ছিলেন। খেতে খেতে শঙ্করবাবুর সঙ্গে আলাপ হল। গল্পের ছলে জানতে পারলাম এই সময় জঙ্গলে কোনো হরিণ দেখতে পাওয়া যাবে না। বিকেল পৌনে পাঁচটায় বাইরের লোকের জন্য ফটক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর জঙ্গল শুধু জনাকয়েক বনরক্ষক ও বনবাংলোর অতিথিদের দখলে চলে যায়। বিকেল ৫টা আর সকাল ৭টায় হরিণদের খেতে দেওয়া হয়। সেই সময় অতিথিরা বনে ঘুরলে হরিণের দেখা পাবেন।
খাওয়াদাওয়া করে পৌনে পাঁচটার অপেক্ষায় বসে রইলাম বাংলোর বারান্দায়। অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান। ৫টায় জঙ্গলে বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম। শঙ্করবাবুর কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হল। একটু যেতেই খাওয়ার জায়গায় দেখা পেলাম তাদের, মনের আনন্দে খেয়ে চলেছে। আমরা খুব সাবধানে পা টিপে টিপে চলছিলাম। কিন্তু আচমকা শুকনো পাতায় পা পড়ে শব্দ হতেই আমাদের দেখে ফেলল ওরা। ভোজন থামিয়ে সোজাসুজি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ওদের খাওয়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে আমরা এগিয়ে গেলাম। একটা জায়গায় দেখি বেশ বড়োসড়ো শিং-ওলা একটা পুরুষ হরিণ দাঁড়িয়ে দেখছে আমাদের, যেন বলতে চাইছে, “কে বাপু তোমরা, আমাদের এলাকায় ঢুকেছ”। যাই হোক, অন্ধকার হতেই ফিরে চললাম বাংলোয়। ভূতের ভয় নেই কিন্তু শুনেছি এই বনে প্রচুর সাপ আছে। বিশেষ করে ময়াল সাপ। একটা ময়াল যদি হরিণ ভেবে জড়িয়ে ধরে তা হলেই চিত্তির।
সন্ধেয় তেমন কোনো কাজ নেই, বারান্দায় বসে টুকটাক মুখ চালাতে চলাতে জমাটবাঁধা অন্ধকারে বনের শোভা দেখতে লাগলাম। আচমকা ডান দিকে মাঠের দিকে চোখ পড়তে দেখি, কী একটা জীব আমাদের বাংলোর দেওয়ালের পাশে ঘুরছে। একটু ভয় পেয়ে গেলাম। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ভুল ভাঙল – এ জঙ্গলে তো আর বাঘ-ভাল্লুক নেই। অতি নিরীহ ৪-৫টা হরিণ খাবারের খোঁজে বাংলোর ধারে চলে এসেছে। বুঝতে পারলাম বনবাংলোয় থাকার এটাই মজা, বনের আসল স্বাদ বোঝা যায়। রাত ১০টার মধ্যে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম, সক্কাল সক্কাল আবার জঙ্গল-ভ্রমণে যেতে হবে যে!ভোর হতেই ক্যামেরাটা গলায় ঝুলিয়ে চললাম। সালিম আলি সাহেবের নামে নামাঙ্কিত বনপথে ঢোকার আগে ডান হাতে পড়ে বিশাল আকারের খাঁচা। তার মধ্যে আছে নানা জায়গা থেকে উদ্ধার করে আনা ময়ূর, বিভিন্ন প্রজাতির খরগোশ, প্রচুর ঘুঘু, কাঠবেড়ালি, মদনটাক পাখি, শামুকখোল পাখি ও নীল গাই। সেখানে দাঁড়িয়ে প্রাণ ভরে ময়ূর, খরগোশ, ঘুঘুর ছবি তুলে চললাম হরিণদের দেখতে। সেই বাবুরা নিশ্চিন্তে গপগপ করে ভোজন করছে। ওদের বিরক্ত না করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে খাওয়া দেখতে লাগলাম। দু’-একটি হরিণ মাঝেমাঝে তাকিয়ে দেখল বটে, কিন্তু ভয়ের কিছু নেই বুঝে ফের খাওয়ায় মন দিল।
‘সালিম আলি বনপথ’ দিয়ে এগিয়ে চললাম। হঠাৎ মনে হল সামনের রাস্তায় ঝোপের পাশে কিছু যেন আছে, আমাদের লক্ষ করছে। নিরাপদ দূরত্ব রেখে ক্যামেরা বাগিয়ে রাস্তার ওপরেই থানা দিয়ে বসলাম নিঃশ্বাস বন্ধ করে।
মিনিট দুই অপেক্ষা করার পর দেখি একটা বেশ বড়োসড়ো ঝাঁকড়া শিং-ওলা হরিণ। সে ঝোপঝাড় ভেঙে রাস্তার ওপর এসে সোজাসুজি আমার ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমিও ভিডিও চালু করে সোজাসুজি তাকিয়ে বসে আছি। অনেকক্ষণ পরে সে আবার ঝোপের দিকে তাকাল। এ বার দেখি আসল খেলা। বড়ো, মেজো, সেজো, ছোটো, কচি – এক পাল হরিণ রাস্তার এপার থেকে ওপারে গিয়ে ঝোপের মধ্যে মিলিয়ে গেল। বুঝতে পারলাম প্রথম হরিণটি হল দলপতি, রাস্তা যে নিরাপদ সেই সংকেত সে দিতেই বাকিরা এগিয়ে গেল।
এ বার আমাদের গন্তব্য ঘড়িয়াল-পুকুর। এক নজর পুকুরের দিকে তাকাতে কিছুই চোখে পড়ল না। একটু ভালো করে দেখতেই দেখি যে দু’ খানি ঘড়িয়াল একে অপরের পিঠের ওপর উঠে রোদ পোহাচ্ছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, শ্যাওলামাখা কাঠের গুঁড়ি।
এ বার আচমকা চোখ পড়ল পাশের সত্যিকারের কাঠের গুঁড়ির দিকে। দেখি দু’খানি কচ্ছপ বসে আছে, পিঠে পুরু শ্যাওলার স্তর। এর মধ্যেই ঠক ঠক শব্দ শুনে চমকে তাকিয়ে দেখি পাশের মরা গাছে একটা কাঠঠোকরা প্রাণপণে ঠোক্কর দিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে পেটের ছুঁচোগুলো লাফালাফি শুরু করতেই গুটিগুটি পায়ে ফিরতি পথ ধরলাম। পথে দেখতে পেলাম পুচকু পুচকু হরিণশিশু ঘুরে বেড়াচ্ছে, খুব সতর্ক, পায়ের একটু শব্দ হলেই লাফিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।
বেলার দিকে আমাদের খাওয়া বাদে তেমন কোনো কাজ নেই। ফরেস্ট গেটের বাইরে থেকে ঝালমুড়ি, পাপড়ি চাট এনে খরগোশের খাঁচার সামনে বসে ওদের খেলা দেখতে দেখতে মুখ চালাতে লাগলাম।
দুপুরে খাওয়ার পর একটু ভাতঘুম, তার পর আবার হরিণ দেখতে চলা। হরিণের শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন ভাবে খাবার খেতে দেখাটা একটা নেশার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে, আর সন্ধে হতেই আলো বন্ধ করে বারান্দায় বসে নিঃশব্দ ছায়ামূর্তির মতো হরিণের কার্যকলাপ দেখা।
রাতের দিকে বাংলোর সামনে হাঁটাহাঁটি করার সময় আলাপ হল বনরক্ষী দীনুবাবুর সাথে। গল্প জমে গেল ওঁর সঙ্গে। কিছু দিন আগে রাতে বনে টহল দেওয়ার সময় ওঁকে চন্দ্রবোড়া কামড়েছিল, বরাতজোরে বেঁচে ফিরেছেন। পরের বার এলে ওঁর বাড়িতে যাওয়ার নেমন্তন্ন করলেন। খানিকক্ষণের মধ্যে শঙ্করবাবু রাতের ভোজন নিয়ে হাজির। খেয়ে ভারাক্রান্ত মনে শুয়ে পড়লাম, কারণ কালকেই যে আমাদের ফিরে যাওয়া।
সকালে উঠে ফের অরণ্যপথে হাঁটা। এ বারের মতো এই শেষ। যথারীতি হরিণ দেখে ঘড়িয়াল-পুকুরের সামনে গিয়ে ঘড়িয়াল দেখতে দেখতে পড়ে থাকা পাকা বেল নিয়ে লোফালুফি খেললাম। ফিরতি পথে আমাদের পথ আটকাল হরিণের পাল। ওরা রাস্তা পার হয়ে যাওয়ার পর আমরা দুই বনপথের সংযোগস্থলে রাখা বেঞ্চে বসে পড়লাম। মাথার ওপরের গাছে পাখিদের ঝগড়াঝাঁটি চলছে। তাকিয়ে দেখি এক ঝাঁক মদনা টিয়া (রেড ব্রেস্টেড প্যারাকিট) গাছের দখল নিয়ে মারামারি করছে।
চরম অনিচ্ছা সত্ত্বেও বনের সমস্ত প্রাণী, সদা হাস্যমুখ শঙ্করবাবুকে বিদায় জানিয়ে ফিরে চললাম সেই গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যেতে।

কী ভাবে যাবেন
শিয়ালদা থেকে লালগোলাগামী ট্রেনে বেথুয়াডহরী আড়াই থেকে সোয়া তিন ঘণ্টার পথ। ট্রেনের সময়ের জন্য দেখে নিন erail.in । সড়কপথে কলকাতা থেকে বেথুয়াডহরীর দূরত্ব ১৩৬ কিমি। এসপ্ল্যানেড থেকে বাসে যেতে পারেন। গাড়ি ভাড়া করেও যেতে পারেন। পথ বারাসত-জাগুলিয়া-চাকদা-রানাঘাট-কৃষ্ণনগর হয়ে।
কোথায় থাকবেন
থাকার জন্য রয়েছে ডব্লিউএসএফডিএ-র দু’টি কটেজ। বেথুয়াডহরী ফরেস্ট গেট দিয়ে ঢুকেই। অনলাইন বুকিং wbsfda.gov.in । ফোনে যোগাযোগ ০৯৬০৯৪৫৯৩০৭ । অরণ্যের মধ্যে রয়েছে ‘বেদু-ইন’ যাত্রীনিবাস। কৃষ্ণনগরে নদিয়া-মুর্শিদাবাদের ডিএফও অফিসে যোগাযোগ করে বুক করতে পারেন। ফোন ৯৫৩৪৭২ ২৫২৩৬২।
এ ছাড়াও ফরেস্টের বাইরে রয়েছে বেশ কিছু বেসরকারি হোটেল। গুগলে গিয়ে ‘accommodation in bethuadahari’ সার্চ করলে সেগুলোর সন্ধান পেয়ে যাবেন।
আবেদন
যত খুশি বনে-জঙ্গলে ঘুরতে যান। কিন্তু মনে রাখবেন, যারা বনে থাকে তাদেরও আপনার মতো বাঁচার অধিকার আছে, সে যতই ক্ষুদ্র তুচ্ছ হোক না কেন। বনে গেলে ওখানের পরিবেশের উপযুক্ত মনোভাব নিয়ে চলুন।