‘পারমিট নেই, তবুও যাব’ এক শ্রেণির পর্যটকের বেপরোয়া আচরণই ডেকে আনছে বিপদ

নিজস্ব প্রতিনিধি: সকাল থেকে মেঘলা আবহাওয়া গ্যাংটকে। আগের দিন রাতে বৃষ্টি হয়েছে। খবর আসছে ছাঙ্গু লেকে তুমুল তুষারপাত হয়েছে। হয়তো ছাঙ্গু যাওয়ার পারমিট পাওয়া যাবে না। কলকাতা থেকে আসা ১০ জনের পর্যটক দলটা অপেক্ষা করছে ছাঙ্গু যাওয়ার। কিছুক্ষণ পর ট্যুর অপারেটরের মারফত খবর এল ছাঙ্গু যাওয়ার পারমিট সত্যিই দেওয়া হচ্ছে না। খবরটা শুনে রেগে লাল হয়ে গেল দলটি। সঙ্গে সঙ্গে ফোন ট্যুর অপারেটরকে। পর্যটক দলটির দলপতি বিশ্বাস করছেনই না যে পারমিট দেওয়া হচ্ছে না।

ট্যুর অপারেটরকে ফোন করে রীতিমতো ধমক দিচ্ছেন ওই ব্যক্তি। পারমিট দেওয়া যে হচ্ছে না, কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না তাঁর। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করছেন একটাই কথা, খারাপ আবহাওয়ার সুযোগ নিয়ে লোক ঠকানোর ধান্দা করছেন ওই ট্যুর অপারেটর। কী ভাবে ওই ট্যুর অপারেটরকে ‘শায়েস্তা’ করা যায়, ভাবতে ভাবতে অব্যর্থ একটা জিনিস বের করলেন তিনি। ওই ট্যুর অপারেটরের গালমন্দ করে ফেসবুকে পোস্ট, বিভিন্ন গ্রুপে শেয়ার, একাধিক হ্যাশট্যাগ, ডাক দিলেন বয়কটের।

সঙ্গে সঙ্গে তাতে কমেন্ট এল, ‘এই জন্যই ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যাওয়া উচিৎ নয়,’ ‘আপনারা নিজেরাই চলে যান বেড়াতে ট্রাভেল এজেন্সির ওপরে ভরসা করতে হবে না,’ ‘আরে ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যাচ্ছেন কেন? অনেক বেশি খরচ তো?’

উল্লেখিত ঘটনাটি কাল্পনিক। কিন্তু এই ধরনের ঘটনা আকছার হচ্ছে সিকিমে। পর্যটকরা ট্যুর অপারেটর এবং ট্রাভেল এজেন্সিকে ভরসা করছেন না। পারমিট না পেলে ভাবছেন ট্রাভেল এজেন্সি ঠকাচ্ছে। এক শ্রেণির পর্যটকদল তো পারমিট না পাওয়ার পরেও এগোনোর চেষ্টা করছেন। আর তাতেই বিপদ বাড়ছে।

মঙ্গলবার সিকিমে যে ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটল, তাতে মৃতের সংখ্যা এড়ানো যেত যদি ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেটর এবং স্থানীয় প্রশাসনের কথা মন দিয়ে শুনতেন পর্যটকরা।

মার্চের শুরু থেকেই সিকিমের আবহাওয়া খারাপ। অনবরত তুষারপাতে রাস্তা প্রায় বন্ধ। গত এক মাসে খুব অল্প দিনই ছাঙ্গু হ্রদ যাওয়ার পারমিট দেওয়া হয়েছিল পর্যটকদের। ১ এপ্রিল থেকে আবার পারমিট বন্ধ। মঙ্গলবারও গ্যাংটক থেকে ছাঙ্গু যাওয়ার পারমিট দেওয়া হয়নি। ছাঙ্গুর পথে বড়োজোর ১৫ মাইল পর্যন্ত যেতে পারতেন পর্যটকরা।

তুষারধস নামবে কি না, আন্দাজ করা যায়নি। কিন্তু অবস্থা যে প্রতিকূল, সেটা বুঝতে বেশি অসুবিধা হচ্ছিল না। সে কারণেই ১৫ মাইলের পর পর্যটকদের যাওয়ার অনুমতি ছিল না। কিন্তু কিছু পর্যটক ১৫ মাইলের পর আরও একটু এগোনোর গোঁ ধরে বসেন। পর্যটকদের জেদের কাছে দমে যান তাঁদের গাড়ির সারথিরা। আর এর পরেই চলে এল বিপদ।

মঙ্গলবার সকাল ১১:১০ নাগাদ ১৩ মাইলের কাছে একটি পর্যটক বোঝাই গাড়ির ওপরে হুড়মুড় করে নেমে আসে তুষারধস। আরও বেশ কয়েকটি গাড়িও সেই ধসে চাপা পড়ে যায়। ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় ৭ জনের। চাপা পড়েন আরও অসংখ্য পর্যটক। সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধারকাজে নামেন সেনা জওয়ানরা। আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন সেনারা।

এই ধরনের ঘটনা কিন্তু নতুন নয়। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি না বুঝে পর্যটকদের এক ধরনের গোঁ বিপদ দেকে আনছে বার বার। আবার যদি বলা হয় দুপুরের পর আবহাওয়া খারাপ হয়ে যাবে, এখনই নেমে যেতে হবে, তখনও গোঁসা হয় পর্যটকদের। অথচ খারাপ আবহাওয়ার কারণে বিপদে পড়ার ঘটনা সিকিমে আকছার হচ্ছে।

পর্যটকদের আচরণ নিয়ে বিরক্ত পর্যটন ব্যবসায়ীরাও। সিকিমে একাধিক জায়গায় হোটেল রয়েছে, এমন একজন ভ্রমণ অনলাইনকে বলেন, “ছাঙ্গু যাওয়ার অনুমতি না মেলায় একটা দল বলল যে করেই হোক তারা বরফ দেখবেই। আমি তখন তাদের জুলুকের দিকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলাম। কিন্তু পইপই করে বলে দিয়েছিলাম যে করেই হোক দুপুরের পর জুলুকের ওপরে থাকা যাবে না, নেমে আসতেই হবে। ওঁদের মধ্যে কেউ কেউ সেটা শোনেননি। দুপুরের পর আবহাওয়া এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে ওঁদের জুলুক থেকে নেমে আসতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল।”

সিকিমকে অন্তর থেকে ভালোবাসেন, ভ্রামণিক সঞ্জয় গোস্বামী। গোটা ঘটনায় তিনি ক্ষুব্ধ। মঙ্গলবার নিজের ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, “প্রতি বছর এক ঘটনা। ফেসবুকে বরফ হাতে নিয়ে বরফি হওয়ার সাধে বংদের বরফ অভিযান।সিকিম সরকার নিশ্চুপ থাকেন ফি বছর। যত দায় ভারতীয় সেনার। তারা বহিঃশত্রু ঠেকাবে না নিজের দেশের ফেসবুক ফ্যানাটিক শত্রু ঠেকাবে। স্নো দেখতে হিমাচল যান, সিকিম নয় কারণ ভৌগোলিক কারণে এখানে স্নো ফল বিভিন্ন খারাপ পরিস্থিতি নিয়ে আসে। বাড়িতে ফ্রিজ আছে? খালি গায়ে কিছু বরফ মেখে বসে থাকুন। পারলে কিছু রিলস এ দিন।।।পয়সা আসবে।”

পর্যটকদের বুঝতে হবে, ট্যুর অপারেটররা রয়েছেন তাঁদের সাহায্য করার জন্য, ঠকানোর জন্য নয়। ঠকবাজ ট্যুর অপারেটর হয় ঠিকই, কিন্তু তারা হাতেগোনা। বেশির ভাগ ট্যুর অপারেটরই ভালো ভ্রমণ উপহার দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন।

পর্যটকদের প্রতি আমাদের তাই আবেদন, ট্যুর অপারেটরদের ওপরে ভরসা করুন, তাদের বিশ্বাস করুন। তাঁরা যদি বলেন পারমিট দেওয়া হচ্ছে না, অবিশ্বাস করবেন না। ভাববেন না যে ট্যুর অপারেটর ঠকাচ্ছে! স্থানীয় প্রশাসনের সতর্কতা মেনে চলুন। সর্বোপরি দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় পাকামো করবেন না। নইলে আজকের মতো ঘটনা ভবিষ্যতে আরও ঘটবে! মনে রাখবেন অন্য কিছুর থেকে আপনার প্রাণটা সবার আগে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *