দোটানায় পড়ে গিয়েছি। কোন দিকে মন দেব? বাইরের দিকে নাকি ভিতরপানে? চলেছি গঙ্গার ওপর দিয়ে। ডান দিকে কলকাতা শহর, বাঁ দিকে হাওড়া। এই জলযাত্রার সুযোগ তো সব সময় আসে না। তাই ঘুরেফিরে তাকাচ্ছি দু’ তীরের দিকে। কিন্তু মনের একাগ্রতায় ভাঙন ধরাচ্ছে ভিতরের এলাহি আয়োজন, ভুরিভোজের আয়োজন। কারণ জলযাত্রার উপলক্ষ্যটা তো ইলিশ উৎসব।
গঙ্গাবক্ষে লঞ্চে যাত্রা
হ্যাঁ, রবিবার গঙ্গাবক্ষে ইলিশ উৎসবের আয়োজন করেছিল ট্যুর প্ল্যানার গ্রুপ। পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের লঞ্চ ভাড়া করে জলযাত্রা। মিলেনিয়াম পার্কের জেটি থেকে যাত্রা শুরু হল সকাল সোয়া ৯টায়। আবহাওয়া যেন কিছুটা খামখেয়ালি। আকাশে মেঘের ঘনঘটা, বৃষ্টিও নামল ঝমঝমিয়ে। তারই মধ্যে আবার আলোর ঝলকানিতে বাজ পড়ার সে কী বিকট শব্দ। এই ভাবেই সব বাধা-বিঘ্নকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলল লঞ্চ।
শুরুটা হল এক কাপ চায়ে চুমুক দিয়ে, সঙ্গে বিস্কুট তো ছিলই। একটু একটু খিদে খিদে তো সকলেরই পাচ্ছে। প্রাতরাশে ফ্রুট কেক, ডিম, কলা আর সন্দেশ। লঞ্চ ততক্ষণে হাওড়া সেতুর তলা দিয়ে এগিয়ে চলেছে উত্তরের দিকে। পেরিয়ে গেলাম ডান দিকে আহিরীটোলা ঘাট। ইতিমধ্যে উদ্বোধনী সংগীত দিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও শুরু হয়ে গিয়েছে। তার মানে শুধু খাওয়াদাওয়া বা লঞ্চে গঙ্গাবক্ষে ভ্রমণই নয়, রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও।
আরও পড়ুন ছ’জন ভারতীয়ের ক্যামেরায় বন্দি রাশিয়াকে দেখতে চলুন গোর্কি সদন
মনে মনে ভাবছিলাম কেন এই ইলিশ উৎসবের বিপুল আয়োজন? উত্তর খুঁজতে আলাপ জুড়ে দিলাম গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য অভিব্রত ভক্তের সঙ্গে। অভিব্রত জানালেন, গঙ্গাবক্ষে তাঁদের ইলিশ উৎসব তিন বছরে পড়ল। প্রথম বছর একটি প্রাইভেট লঞ্চে ৬০ জনকে নিয়ে শুরু হয়েছিল এই উৎসব। গত বছর সিঙ্গল ডেকার লঞ্চে আয়োজিত উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন ১৩২ জন। আর এ বছরে সেই সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫০ জন।
ইলিশ উৎসব করার এই ভাবনা কী ভাবে এল মাথায়?
অভিব্রতর কথায়, “বাঙালি মানেই ভোজনরসিক। আর সেই ভোজন যদি ইলিশ দিয়ে হয় তা হলে তো কথাই নেই। তাই ঠিক করলাম ইলিশ মাছ নিয়ে একটা উৎসব করা যেতেই পারে। গঙ্গাবক্ষে লঞ্চে ইলিশ উৎসব করার ভাবনা এল মাথায়।” কথায় কথায় অভিব্রত জানালেন, তাঁরা এই উৎসবের জন্য কোনো স্পনসর নেন না।
সাংস্কৃতিক মঞ্চে চলছে গান-আবৃত্তি-নাচ আর তার তালে তালে লঞ্চ চলেছে এগিয়ে। তখন ঘড়িতে বাজে প্রায় পৌনে বারোটা। বাইরে ঘুরতে বেরোলে সবারই মন চায় একটু মুচমুচে কিছু খেতে। তাতেও ছিল না কোনো ত্রুটি। ছিল ভেজ পকোড়া, ছিল ফিশ বল। ইতিমধ্যে বেলুড় মঠ পেরিয়ে গিয়েছি। নিবেদিতা সেতু আর বিবেকানন্দ সেতুর তলা দিয়ে এগোতেই ডান দিকে পেয়ে গেলাম শ্রীরামকৃষ্ণের স্মৃতিধন্য দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দিরের ঘাট।
জানতে ইচ্ছে করছিল ট্যুর প্ল্যানার গ্রুপ সম্পর্কে। কী ভাবে এই গ্রুপের প্রতিষ্ঠা হল, কীসের উদ্দেশ্যে তৈরি হল এই গ্রুপ, গ্রুপের এ রকম নাম কেন, কত বয়স – এই সব সাত পাঁচ প্রশ্ন।
অভিব্রত সে সব কৌতূহলও মেটালেন। বললেন, এই গ্রুপের বয়স সাড়ে চার বছর, সদস্যসংখ্যা দেড় লাখেরও বেশি। দেড় লাখ! চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। অভিব্রত মনে করেন, যে কোনো ভ্রমণ প্রপার প্ল্যান ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান যদি পারফেক্ট হয় তখন বেরোনোর মজাটাই আলাদা। বেড়ানোর আগে প্ল্যানটা ঠিক করে নিতে হয় – কোথায় যাব, কী দেখব, কী ভাবে ঘুরব ইত্যাদি। অভিব্রতদের গ্রুপের মূল উদ্দেশ্য হল, বেড়াতে যাওয়ার আগে মেম্বারদের প্ল্যানিং এ হেল্প করা যাতে এক জন মেম্বার জায়গাটায় পৌঁছে কোনো অসুবিধের মুখে না পড়ে। সেখান থেকেই গ্রূপের নাম ট্যুর প্ল্যানার।
সাংস্কৃতিক মঞ্চে জোর অনুষ্ঠান চলছে। বাউলগীতি পরিবেশন করলেন শান্তিনিকেতনের উত্তম দাস বাউল, আবৃত্তি করে শোনালেন অহনা দে। নৃত্য পরিবেশন করলেন সাহানা দে, পৃথা পুততুন্ড আর চৈতালি বসু। এ ছাড়া গ্রুপের সদস্যরা তো আছেনই।
দুপুরের ভোজ
এ বার বেলা যত বাড়ছে মানুষের চোখে মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠছিল ক্লান্তির ছাপ। কেউ গান শুনতে শুনতেই লঞ্চের মধ্যে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলেন।
দুপুরের রান্না চলছে বেশ জোরকদমে। রান্নার সে এলাহি আয়োজন। ঘড়িতে তখন প্রায় তিনটে। রান্না শেষ। এ বার দুপুরের খাওয়ার পালা! শুরুটা হল ভাত আর সবজি ডাল দিয়ে, সঙ্গে ইলিশ মাছের লেজ ভাজা আর কাঁটা ও তেল, তার পর পুঁই ইলিশের লাবড়া, ইলিশ ভাপা, বেগুন ইলিশ। একা ইলিশে রক্ষে নেই, পাবদা দোসর – এল টমেটো পাবদা। শেষ পাতে পাঁপড় আর আনারসের চাটনি। আর এই ভুরিভোজ যদি হজমে বিঘ্ন ঘটায়, তাই হজমলা দিতে ভোলেননি উদ্যোক্তারা।
আরও পড়ুন হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা, করবেটে গেলে আর এই কাজটা করা যাবে না
ততক্ষণে লঞ্চ শ্রীরামপুর ছুঁয়ে মুখ ঘুরিয়েছে কলকাতার দিকে। ইতিমধ্যে আলাপ হয়ে গেল গ্রুপের আরেক সুশান্ত রায়ের সঙ্গে। সুশান্তবাবু বললেন, গ্রুপের সব সদস্যের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিতে এই উৎসব। এই উৎসব সফল ভাবে আয়োজন করতে প্রত্যেকেই কিছু না কিছু কাজের দায়িত্ব নেয়। যে যে কাজে পারদর্শী সে সেই কাজটা করে – কেউ ইলিশ আনার দায়িত্ব নিয়েছেন, কেউ বা অন্য বাজার, কেউ আবার লঞ্চ বুক করেছেন, কেউ বা বেলুন দিয়ে লঞ্চ সাজানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। সুশান্তবাবু স্পষ্ট জানালেন, এটা তাঁদের কোনো ব্যবসা নয়। সবাইকে আনন্দ দিতেই এই উৎসব। কথায় কথায় জানা গেল ইলিশ উৎসব ছাড়াও ট্যুর প্ল্যানার গ্রুপ নানা ধরনের উৎসবের আয়োজন করে – বসন্ত উৎসব, গ্রুপের জন্মদিন, বিজয়া উৎসব, শীতকালে পিকনিক ইত্যাদি। মূলত কলকাতাতেই উৎসবের আয়োজন করা হয়। তবে পুরুলিয়া, ভালকি মাচান, তালসারিতেও গ্রুপের নানা অনুষ্ঠান হয়েছে।
কথায় কথায় খেয়াল হয়নি কখন চলে এসেছি কলকাতার কাছাকাছি। ইতিমধ্যে আর এক বার চা-কফি পর্ব চলল। লঞ্চ যখন মিলেনিয়াম পার্কের জেটি ছুঁল ঘড়িতে তখন প্রায় সাড়ে পাঁচটা।